এক বছরের মধ্যে অভূতপূর্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের পর ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের ঘোষণা দিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) রাত ৮টা ২০ মিনিটে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, “নির্বাচনের দিন হবে আনন্দ-উৎসবের দিন। আমরা চাই সেই দিনটি স্মরণীয় হোক সকল নাগরিকের জন্য।”
ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস জানান, নির্বাচন কমিশন যেন ২০২৬ সালের রমজানের আগে ভোট আয়োজন করতে পারে, সে বিষয়ে আগামী দিনে চিঠি দেওয়া হবে। তিনি বলেন, “এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা, নির্বাচন অনুষ্ঠান। এখন থেকে আমরা একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।”
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৬ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটেছিল। আদালতের একটি রায়ের মাধ্যমে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের পর ছাত্র-যুব সমাজে যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়, তা দমনপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের মুখে বিস্ফোরণে রূপ নেয়। সেই গণঅভ্যুত্থানে আত্মাহুতি দেওয়া ‘জুলাই শহীদদের’ গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “যাদের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের এই অতি মূল্যবান অধিকার ফিরে পেলাম, ভোটটা দেবার আগ মুহূর্তে যেন তাদের চেহারা আমাদের চোখে ভেসে ওঠে।”
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এই নির্বাচন হবে এক নতুন যুগের সূচনা। “নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজের ভিত্তি রচনা হবে এবারের নির্বাচনে,”—বলেন তিনি।
প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ঐতিহাসিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এবার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ নিশ্চিত করতে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। একই সঙ্গে নারী ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়াতে কেন্দ্রভিত্তিক ব্যবস্থাপনা জোরদারের কথাও জানান তিনি।
তিনি বলেন, “১৫ বছর ধরে নাগরিকেরা ভোট দিতে পারেননি। এবার মহাআনন্দে ভোট দিতে চাই। ঈদের উৎসবের মতো এই দিন উদযাপন করতে চাই।”
নির্বাচনে কারও ভোটাধিকার যেন খর্ব না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে একটি অ্যাপ চালুর পরিকল্পনার কথাও জানান প্রধান উপদেষ্টা। নাগরিকরা এই অ্যাপের মাধ্যমে মতামত, অভিযোগ ও উদ্বেগ জানাতে পারবেন।
ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের তিনটি প্রধান দায়িত্ব ছিল—সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন। এর মধ্যে সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে যাচ্ছে দৃঢ়ভাবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত কমিশনের মাধ্যমে প্রণীত 'জুলাই সনদ' ইতিমধ্যে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। অচিরেই রাজনৈতিক দলগুলো এতে স্বাক্ষর করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, “জুলাই সনদ একটি ঐতিহাসিক দলিল। এই সনদ সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর, জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গঠন এবং নাগরিক অধিকারের বাস্তবায়নে পথনির্দেশনা দেবে।”
অধ্যাপক ইউনূস দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “রাষ্ট্রকে এমনভাবে মেরামত করতে হবে যাতে ভবিষ্যতের কোনো সরকার আর ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে।”
বাংলাদেশের অর্থনীতি এক বছর আগে ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায়—এমনটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আজ আমরা সফলভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। মূল্যস্ফীতির হার দ্রুত কমছে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ স্থিতিশীল। আশা করছি ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে আসবে।”
শুল্ক নীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্প্রতি সম্পাদিত আলোচনাকে তিনি অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত হিসেবে উল্লেখ করেন।
গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্বাধীন গণমাধ্যমের গুরুত্ব তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “যে কেউ এখন সরকারের সমালোচনা করতে পারছেন—চলমান প্রক্রিয়ায় এমনকি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমেও। এটা আগে ছিল কল্পনাতীত। আমরা প্রেস কাউন্সিল পুনর্গঠন করেছি সাংবাদিকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য।”
শেষে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা আর কখনো জাতিকে বিভক্ত হতে দেব না। এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই আমাদের সামনে এগোতে হবে।” তিনি মাইলস্টোন কলেজ দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণ করে আহতদের সুস্থতার কামনা জানান এবং সংশ্লিষ্ট দেশের চিকিৎসক ও সেবাকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
ভাষণে তিনি নতুন ভোটার, নারী, প্রবাসী, তরুণসহ সব নাগরিককে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান। বলেন, “ফেব্রুয়ারি বেশি দূরে নয়। সবাই প্রস্তুতি নিন। এই পরীক্ষায় আমরা যেন সফল হই।”