হালদার পানি দুষিত হচ্ছে বিষাক্ত বর্জ্যে

এফএনএস (কেশব কুমার বড়ুয়া; হাটহাজারী, চট্টগ্রাম) : | প্রকাশ: ২২ অক্টোবর, ২০২৫, ০৬:০৪ পিএম
হালদার পানি দুষিত হচ্ছে বিষাক্ত বর্জ্যে

বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের  হালদা নদী। প্রতিদিনই হালদা পাড়ের হাটবাজারের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। এটি যেন ময়লা-আবর্জনার ডিপো। এতে হুমকির মুখে পড়েছে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রটি।

জানা যায়, হালদা নদীতে প্রতিবছর জাতীয় রুই, কাতলসহ বিভিন্ন প্রজাতির মা মাছ ডিম ছাড়ে। যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দখল-দূষণ অব্যাহত থাকলে শীঘ্রই প্রাণ হারাবে হালদা নদী, হ্রাস পাবে মৎস্য প্রজনন।

এই সব বর্জ্যগুলো নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খাল উপখাল হয়ে হালদা নদীতে এসে মিশে যাচ্ছে। এতে মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে এই নদী। নদীর পাড়ের মানুষের অভিযোগ নদী ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ রক্ষায় যাদের ওপর দায়িত্ব রয়েছে তাদের উদাসীনতায় বিশেষায়িত এই নদীটি এখন দূষণের কবলে পড়ে মরতে বসেছে। নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতে এশিয়ার বৃহত্তর প্রাকৃতিক এই মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রে গত কয়েক বছর থেকে একের পর এক মা মাছ, ডলফিন মরে ভেসে উঠছে।

দুষনের কারনে সুপেয় পানি সংকটে পড়তে পারে চট্টগ্রামের ৭০ লক্ষ মানুষ। হালদা পাড়ের একশ্রেণির পরিবেশ অসচেতন মানুষের অব্যাহত বর্জ্য ফেলার কারণে হালদার স্বচ্ছ পানি এখন  দুর্গন্ধময়। এছাড়া হালদার মৎস্য প্রজননের স্থানগুলোও রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, দখল আর দূষণে হালদা নদীর প্রাণ বর্তমানে যায় যায় অবস্থা। হালদার পাড়ে বিষাক্ত দুর্গন্ধময় বর্জ্য আর একশ্রেণির দখলবাজদের কবলে পড়ে একসময়ের শীতল হালদা এখন অস্থির হয়ে উঠছে। হালদার পাড়ে এক সময় মানুষ বিশুদ্ধ নিশ্বাস নিতে ছুটে গেলেও এখন আর বিশুদ্ধ নি:শ্বাস নিতে পারেনা আশপাশের মানুষ।হালদা নদীর হাটহাজারী, রাউজান,  ফটিকছড়ির বিভিন্ন  অংশ এখন দখল আর দূষণের কবলে পড়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছে। বিষাক্ত বর্জ্যরে অত্যাচারে শীতল হালদা এখন আর বিশুদ্ধ বাতাস দিতে পারছেনা হালদা পাড়ের মানুষদেরকে। স্থানীয় সূত্র এবং পরিদর্শনে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, নাজিরহাট বাজারের পশ্চিম পার্শ্বে হালদা পাড়ে গরু জবাই করার পর গরুর বিভিন্ন প্রকার বর্জ্যে ফেলা হচ্ছে অবাধে নদীতে।  এছাড়া নাজিরহাট বাজারের সমস্ত ময়লা আবর্জনাগুলোও ফেলা হয় হালদায়।বাজারের পশ্চিম পার্শ্বে মাছ বাজারের ময়লা, কাঁচা বাজারের ময়লাসহ সকল প্রকার ময়লার নিরাপদ স্থান হচ্ছে হালদার পাড়! ময়লাগুলো ফেলার পর এগুলো ধীরে ধীরে হালদার পানিতে পতিত হয়ে পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। 

এছাড়া, আবর্জনাগুলো পচে হালদার পানির সাথে মিশে হালদার স্বচ্ছ পানিকে করছে বিষাক্ত। সূত্র জানায়, জোয়ার ভাটার হালদায় এসব বর্জ্য পানিতে মিশে নিচের দিকে চলে যায়। যতই নিচে যায় ততই পুরো হালদার পানিই হয় দূষিত।নাজিরহাট  বাজারে ময়লা ফেলার নির্ধারিত ডাস্টবিন না থাকায় ব্যবসায়ীরা ময়লাগুলো হালদার পাড়ে ফেলে।  এতে হালদার পানি দূষিত হলেও বাধ্য হয়েই তারা হালদায় ময়লা বা বর্জ্য ফেলে। বাজারের সমস্ত ময়লা হালদার পাড়ে ফেললেও হালদা দূষণ হচ্ছে এ ব্যাপারে তাদের কোন ধারণা ছিলনা। এছাড়া বাজার কমিটি বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদেরকে কোনভাবে সচেতন করা হয়নি। বিষাক্ত বর্জ্য হালদার পানিতে মিশে পানি দূষিত হওয়ার কারণে হালদা পাড়ের যেসব মানুষ হালদার পানি ব্যবহার করে তাদের মধ্যে এলার্জি, চর্মরোগসহ নানা ধরণের জটিল রোগের সংক্রমণ দেখা যায়।এদিকে, একশ্রেণির দখলবাজদের কবলে পড়ে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে হালদার প্রস্থ। বাঁশের দোকান বা বাঁশ স্টক করা, লাকড়ির দোকান, গাছের স্টকসহ নানা অজুহাতে দিন দিন হালদাকে গ্রাস করছে সংঘবদ্ধ চক্র। এতে করে হালদার অস্তিত্ব অনেকটা বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

সম্প্রতি হালদা নদীর সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি খালের পাড় ঘুরে খবর নিয়ে   দেখা গেছে দুই পাড়ে রয়েছে সারি সারি মুরগির খামার। এসব খামারের সৃষ্ট মুরগির বিষ্টা প্রতিদিন ফেলা হচ্ছে খালের পানিতে। খালে সদ্য নিক্ষিপ্ত বিষ্টা পানিতে পড়ে রাসায়নিক ক্রিয়ায় পানির মধ্যে ধুয়ার সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। কোনো কোনো স্থানে দুগন্ধে এলাকার পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছে। বিষ্টা ফেলার কারণে পানি বিষাক্ত হয়ে কালো চিকচিকে রং ধারণ করেছে। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন শহর, বন্দর, গ্রাম সবখান থেকে নানা বর্জ্য নদীতে পড়ছে। অক্সিজেন, বালুচড়া, খন্দকিয়াসহ হাটহাজারীর বিভিন্ন এলাকায় থাকা ছোট ছোট শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য বামনশাহী, খন্দকিয়া, কাটাখালী, মাদারী খালসহ উপখাল হয়ে এসে পড়ছে, বুড়িশ্চর, মোহরা, মাদার্শা, মদুনাঘাট এলাকায় নদীর সংযোগ হয়ে। সরেজমিনে দেখা যায়, বামনশাহী ও কাটাখালী খালে বর্জ্য পড়ে থাকার ভয়াবহতার চিত্র। নগরীর অন্যান্য আবাসিক এলাকার পাশ দিয়ে প্রবাহমান এই উপখালের সঙ্গে যুক্ত আছে নানা দিক থেকে বহু নালা নর্দমা। এই পথে পঁচা বিষাক্ত বর্জ্য এসে জমা হচ্ছে খন্দকিয়া খালে। এই খালের পঁচা বিষাক্ত পানি পড়ছে হালদা নদীতে।

এ ব্যাপারে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হালদা বিশেষজ্ঞ মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদায় যেহেতু জোয়ার-ভাটা আছে সেজন্য নদীর উপরিভাগে কোন বর্জ্য বা ময়লা পড়লে তা পুরো নদীর পানিকেই বিষাক্ত করে তোলে। এছাড়া চট্টগ্রামের ৭০ লক্ষ বসবাসকারীর সুপেয় পানির একমাত্র ভরসা হালদা নদী।তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ওয়াসা হালদার পানি দিয়েই চট্টগ্রামের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সুপেয় পানির প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। হালদায় বর্জ্য ফেলা অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রামের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিতে পারে। এছাড়া হালদায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র বিলুপ্তিসহ পরিবেশেরও ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।

মাছের মা খ্যাত হালদা নদীর এমন দশা নিয়ে কথা বললে হালদা বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে আরো বলেন, হালদার দূষণ নিয়ে আমরা বহু বছর থেকে কথা বলে আসছি। দূষণ প্রতিরোধে করণীয় নিয়ে সুপারিশ করেছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলতা পেয়ে আসলেও এখনও এই বিশেষায়িত নদীটিকে দূষণের কবল থেকে মুক্ত করতে পারিনি। আমাদের পরিদর্শনের অভিজ্ঞতায় দূষণের স্পটগুলো চিহ্নিত করে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধও করি। 

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে