খুলনায় সেতুর পূর্ব পাড়ে সরকারি রাস্তার ক্ষতি করে বালুর রমরমা ব্যবসা

এফএনএস (এম এ আজিম; খুলনা) : | প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর, ২০২৫, ০৬:৩৪ পিএম
খুলনায় সেতুর পূর্ব পাড়ে সরকারি রাস্তার ক্ষতি করে বালুর রমরমা ব্যবসা

মেইন সড়কের পাশে বালুর স্তুপ। সেখানেই চলছে বালু বেচাকেনা। বালু নিতে আসা ট্রাক-পিকআপসহ বিভিন্ন হেভিওয়েট বালু বহনকারী গাড়ির কারণে প্রায়ই যান চলাচল ও সাধারণ পথচারীদের ব্যাঘাত ঘটছে। সেইসাথে ব্যক্তি স্বার্থে রূপসা নদী থেকে বালু সরবরাহ পাইপ সড়ক বিভাগের রাস্তা কেটে বসানো হয়েছে। ফলে রূপসা সেতুতে বেড়াতে আসা হাজারও মানুষের দুর্ভোগ, তেমনই ব্রীজ এবং সড়ক ও জনপদের সরকারি রাস্তার হচ্ছে চরম ক্ষতি। মেইন সড়কের দু-পাশে বালুর রমরমা অবৈধ বাণিজ্য করছেন খাজুরা এলাকার সাগর শেখ, জাবুসার মেহেদী হাসান ও শামিম নামের স্থানীয় তিন ব্যক্তি।

এদিকে, বালুর কারণে ব্রীজের টোলপ্লাজার দায়িত্বশীলদেরও শিকার হতে হচ্ছে ভোগান্তি। প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন টোলপ্লাজা থেকে যাওয়া আসার মুহুর্তে গাড়িতে থাকা যাত্রীদেরও হতে হয় ভোগান্তি এমনটি মন্তব্য করেছেন ব্রীজ কর্তৃপক্ষের লোকজন ও ভোগান্তির শিকার যানবাহনের যাত্রীরা। এমনই চিত্র দেখা যায়, খুলনার রূপসা খানজাহান আলী (রহঃ) ব্রীজের নিচে পূর্ব পাড় ঘেঁষা সড়ক ও জনপদ সড়কের দু-পাশে। মেইন সড়ক ঘেঁষে দু-পাশে ৩টি স্থানে চলছে বালুর রমরমা ব্যবসা। এতে করে ছোট-বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পথচারী ও স্থানীয়রা।

ফকিরহাট উপজেলার খাজুরা এলাকার বাসিন্দা সাগর শেখ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন থেকে এখনও পর্যন্ত এ সড়কটির দু-পাশ ঘেঁষে বহাল তবিয়তে চালিয়ে যাচ্ছে বালুর অনিয়ম তান্ত্রিক ব্যবসা। রূপসা উপজেলার নৈহাটী ইউনিয়নের জাবুসা এলাকার মেহেদী হাসান এবং শামিমও চালিয়ে যাচ্ছে একই সড়কের পাশে বালুর ব্যবসা।

দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী রূপসা সেতু অন্যতম বিনোদনের যায়গা। আর এখানে বিশেষ করে শুক্রবার বিকেলে বিনোদনের জন্য এই ব্রীজে ঘুরতে আসা হাজারও লোকের সমাগম সৃষ্টি হলেও এ বালুর কারণে তাদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আবার সরকারি রাস্তার যেমন ক্ষতি, তেমনি পথচারীদের ভোগান্তি এবং নাকেমুখে বালু গিয়ে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি এমন অভিযোগ অনেকের।

অভিযোগ রয়েছে, বালু ব্যবসায়ী সাগর ৫ আগষ্টের আগে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় বালুর ব্যবসা গড়ে তুলেছে বলে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছেন। আবার ৫ আগষ্টের পর থেকে শামিম ও মেহেদী একইভাবে শুরু করেছে বালুর ব্যবসা। বালু বাতাসে ও যানচলাচলের মুহুর্তে ব্রীজের আশপাশ এলাকায় দোকানের বিভিন্ন ধরনের খাবারের সাথে মিশে যাচ্ছে বালু। সেই খাবারেও স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে বলে পথচারীরা ও স্থানীয়রা অনেকেই জানান। মেইন সড়কের দু-পাশে বালু ব্যবসায়ীদের হাত থেকে রেহাই পেতে প্রতিকারের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী ও সাধারণ পথচারীরা।


সরেজমিনে গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, মেইন রাস্তার পাশে বালুর ব্যবসা দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম তান্ত্রিক ভাবে খাজুরার আওয়ামী লীগের সাগর নামের একজন ও জাবুসার মেহেদী ও শামিম ক্ষমতার অপব্যবহার করে বালুর ব্যবসা করে আসছে। যার কারণে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি এবং ব্রীজ এবং সরকারি সড়কেরও হচ্ছে ক্ষতি। আর এই ক্ষতির কারণে এক বছর আগে সরকারি সড়কের পাশে বালু ব্যবসা করার অপরাধে পুলিশ আইনি পদক্ষেপ নিতে ব্যবসায়ী শামিমকে হ্যান্ডকাপ পরিয়েছিলো। কিন্তু শামিম ক্ষমতার প্রভাব খাঁটিয়ে ওই সময় পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পায় বলেও অভিযোগ রয়েছে। সড়কের পাশ দিয়ে হাঁটতে স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্রীজে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীসহ এখানের অনেক খাবারের দোকানীরা রয়েছে ভোগান্তিতে।

ব্রীজে ঘুরতে আসা পথচারী শিহাব, মুনির, দেলোয়ার ও ফাহিম বলেন, এ সড়ক দিয়ে অনেক লোকজন চলাচল করে। রাস্তার পাশ ঘেঁষে বালুর ব্যবসা করা সম্পূর্ণ গায়ের জোর এবং খামখেয়ালি। এখানে বালুর ব্যবসা করা সম্পূর্ণ বেআইনী। এখানে সরকারি রাস্তারও ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে সড়কের পাশে বালুর স্তূপ রাখা কিছুতেই কাম্য নয়। যেকোনো মুহুর্তে ঘটতে পারে দূর্ঘটনা। এমনকি ধুলাবালি নাকে মুখে গেলে স্বাস্থ্যেরও ব্যাপক ঝুঁকি রয়েছে। প্রশাসনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ উচিৎ।

এর আগে এ বছরের জানুয়ারি মাসে সেতু রক্ষা বাঁধ সরকারি রাস্তা ভাঙার অভিযোগ ওঠে একই বালুর ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজন বিষয়টি প্রশাসনকে অবহিত করলে রূপসা উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশে তাৎক্ষণিক ভাবে নৈহাটী ইউনিয়ন ভূমি অফিসের নায়েব মো. আবু সাঈদ ঘটনাস্থলে এসে বালু সরবরাহ বন্ধ করে দেন। পরে পুনরায় পাইপের মাধ্যমে বালু সরবরাহ করতে গেলে থানা পুলিশ তাও বন্ধ করে দেন।

জানতে চাইলে বালু ব্যবসায়ী সাগর শেখ বলেন, আমি এখানে ৭ বছর ধরে বালুর ব্যবসা করি। আমার ট্রেড লাইসেন্স আছে। সরকারী রাস্তার যায়গা ছেড়ে দিয়ে আমি মালিকানা যায়গায় ব্যবসা করি। বালু উড়ে পরিবেশের ক্ষতি না হয়, সেজন্য প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী ট্রাকে করে বালু নিয়ে বের হওয়ার সময় নেট দিয়ে ঢেকে রাখি। তবে সড়ক বিভাগের রাস্তা কেটে বালু উঠানো পাইপ লাইন বসানোর বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন। আ’ লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকা এবং প্রভাব খাঁটিয়ে ব্যবসা করার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেন, এ গুলো মিথ্যা। তবে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন শেখ সোহেলের লোকজন তার কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়েছে বলে স্বীকার করেন তিনি। বালু ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান ও শামিমের সাথে বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাদের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

রূপসা উপজেলার নৈহাটী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. ইলিয়াস শেখ বলেন, এভাবে সড়কের পাশে বালুর ব্যবসা করার কারনে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়া যেমন যানযট সৃষ্টি হচ্ছে, আবার মানুষের শরীরে বালু গিয়ে স্বাস্থ্যেরও অনেক ক্ষতি। সড়কের পাশে বালু বিক্রি করাটা অন্যায়। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিকারের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: মো. মাজেদুল হক কাওসার বলেন, ধুলাবালি নাকে ও মুখে গেলে ফুসফুসের রোগ যেমন ব্রংকাইটিস, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, হাঁপানি এবং সাইনোসাইটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এই রোগগুলোর সাধারণ লক্ষণের মধ্যে রয়েছে কাশি, শ্বাসকষ্ট, হাঁচি, নাক বন্ধ থাকা, নাক দিয়ে পানি পড়া এবং ঘ্রাণশক্তি কমে যাওয়া।

রূপসা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইফতেখাইরুল ইসলাম শামিম বলেন, এ ভাবে সরকারি রাস্তার পাশে বালুর ব্যবসা করা সম্পূর্ণ অন্যায়। রাস্তার পাশে বালুর ব্যবসা করলে সড়কের ক্ষতি হচ্ছে এবং পথচারীদের পোহাতে হচ্ছে দূর্ভোগ। এ বিষয়টি দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রূপসা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সানজিদা রিক্তা’র কাছে ফোন করে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি অফিসে আসেন। অফিসে আসলে আপনাকে জানাবো। তিনি বাইরে আছেন বলে কোনকিছু না বলে ফোনের সংযোগ কেটে দেন।

খুলনার সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সাঈদ রহমান বলেন, আমাদের সড়কের পাশে বালুর ব্যবসা করতে সবসময় নিষেধ করে আসছি। তাদেরকে মৌখিক ভাবে বার বার সতর্ক করা হলেও তাঁরা ইচ্ছামত আমাদের রাস্তার ক্ষতি করে বালুর ব্যবসা করে আসছে। এবার লিখিতভাবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে