বৈচিত্রময় পৃথিবীতে জীবনযুদ্ধ বড়ই বিচিত্র। ভয়কে অতিক্রম করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম যেমন মানুষের, তেমনি প্রকৃতির কোলে বাস করা প্রাণীকুলেরও। সিলেটের শহরতলীর উঁচুনিচু চা-বাগানের মাঝেই প্রতিদিন চোখে পড়ে এমন সব দৃশ্য, যা প্রথম দেখায় সাধারণ মনে হলেও ভেতরে লুকিয়ে আছে বিচিত্র জীবনকথা। ঠিক তেমনই এক অদ্ভুত দৃশ্যের দেখা মেলে সিলেট শহরের অদূরে হিলুয়া ছড়া চা-বাগানে। মানুষ আর বন্য প্রাণীর সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ; যেখানে মুখপোড়া হনুমানরা মানুষের ঘরকে নিজেদের আবাস মনে করে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়।
ইংরেজ শাসনামলে ১৮৫৪ সালে প্রায় ১,৫০০ একর টিলা-বেষ্টিত জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় হিলুয়া ছড়া চা-বাগান। পরবর্তী সময়ে এটি প্রসারিত হয়ে মালনীছড়া নামে আরেকটি বাগানের উৎপত্তি হয়। উঁচুনিচু টিলার বুক চিরে বয়ে যাওয়া ছড়ার পানি, চারপাশে ঘন সবুজ চা বাগান, আর পাখির কিচিরমিচির এই এলাকার নিসর্গকে করে তোলে আরও মনোমুগ্ধকর। মাঝে মধ্যে দেখা মেলে শিয়াল, কিংবা বানরের দলের আনাগোনা। টিলার ওপর রয়েছে শ্রমিকদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আধাপাকা ও কাঁচা ঘর, আছে বাঁশঝাড় ও নানা ফলজ গাছ যেন ছোট্ট এক প্রাকৃতিক গ্রাম।
এই শ্রমিক পল্লীতেই প্রতিদিন সকাল হলে দেখা মেলে এক অনন্য দৃশ্য। দল বেঁধে ছুটে আসে মুখপোড়া হনুমানরা। দলে থাকে ৫ থেকে ৭ টির মতো সদস্য পুরুষ, স্ত্রী, এমনকি বাচ্চাও দেখা যায়। মূলত খাবারের খোঁজেই তাদের এই দৈনন্দিন পথচলা। গৃহস্থদের দেওয়া বিস্কুট, বাদাম, কলা বা ফল খায়; আবার কখনো পরিবারের অগোচরে কিছু খাবার নিয়ে চলে যায়। তবে সাধারণ বানরের মতো দুষ্টুমি করে না, হিংস্রও নয়। বরং মানুষের সাথে একধরনের বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গেছে। পেট ভরলে বাঁশঝাড় বা গাছের ডালে লেজ ঝুলিয়ে বিশ্রাম নেয়। কখনো কখনো সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের অবস্থান থাকে শ্রমিকদের ঘরবাড়ির আশপাশে।
টিলায় বসবাসরত চা শ্রমিক বাসনা ভাট্টি জানান, শীতকালে এদের আনাগোনা বেড়ে যায়, কারণ তখন বনে পর্যাপ্ত ফলমুল থাকে না।
বাসনা বলেন, “আমরা সাধ্যমতো কিছু খাবার দেই। তবে ওরা কিছুটা ভয়ও পায়। হয়তো যদি কেউ ফাঁদ পাতে শিকার করে, এমন ভয়ের কারণে কাছে আসতে কখনো সংকোচ করে।”মাঝে মাঝে শ্রমিকরা বাগানে কাজে গেলে হনুমানরা তাদের টিফিন বাটি পর্যন্ত নিয়ে গাছে উঠে যায়।
পরিবেশ সংরক্ষণকারী সংগঠন ’ভুমি সন্তান’ কর্মী আনিস মাহমুদ বলেন, আমরা এবং আমাদের সন্তানদের জন্য বাসযোগ্য পরিবেশ রেখে যেতে সচেতনতার বিকল্প নাই। আমরা যদি পরিবেশের অংশীদারদের ধ্বংস করি ! তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্মেরও টিকে থাকা সম্ভব হবেনা। তাই প্রকৃতিকে তার নিজের মতো বাচতে দিতে হবে।
পরিবেশ কর্মী শেখ আশরাফুল আলম নাসির বলেন, বন জঙ্গল দখল করে মানুষ গৃহ নির্মাণ করছে। যেখানে একসময় ওদের আবাস্থল ছিল।যারজন্য বন্যপ্রাণী তাদের আবাস্থল হারাচ্ছে।বর্তমানে খাবার সংকটে পরায় ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে পর্যায় ক্রমে পরিবেশের ভারসাম্য হারাচ্ছে।যার প্রভাব আমরা দেখতি পাচ্ছি।বন উজাড় করে কোনো প্রকল্প নিতে হলে আগেই ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভাবতে হবে।
প্রজাতির বৈশিষ্ট্য:
মুখপোড়া হনুমান (ঞৎধপযুঢ়রঃযবপঁং ঢ়যধুৎবর) প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে বর্ণনা করা হয় ১৮৩৭ সালে। ধূসর দেহ, লম্বা লেজ, মাথায় খাড়া লোম (যা দেখতে ক্যপের মতো) এবং লোমবিহীন কালো বর্ণের মুখমণ্ডলের জন্যই এরা বাংলাদেশে ‘মুখপোড়া হনুমান’ নামে পরিচিত পেয়েছে। ইংরেজি নাম (উঁংশু খবধভ গড়হশব), যাকে (ঈধঢ়ঢ়বফ খধহমঁৎ) ও বলা হয়।
এরা মূলত বৃক্ষচারী; অধিকাংশ সময়ই গাছে কাটায়। খাদ্যের তালিকায় থাকে পাতা, কচি ডাল, ফুলের পাপড়ি, ও ফল। সামাজিকভাবে এরা থাকে এক পুরুষ ও একাধিক স্ত্রী নিয়ে গঠিত দলে যাকে ইংরেজীতে (ঐধৎবস এৎড়ঁঢ়) বলে। শিশুর জন্মের সময় ওজন হয় ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম; ৭ থেকে ৮ মাস পর্যন্ত মায়ের দুধেই বেড়ে ওঠে। ৫ থেকে ৬ বছর বয়সে যৌবনে পৌঁছে প্রজননে সক্ষম হয়।
দৈর্ঘ্য ও ওজন:
পুরুষ: ৫৫ থকে ৬৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ, ওজন ৭ থেকে ১০ কেজি। স্ত্রী: ৪৫ থেকে ৫৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ, ওজন ৫ থেকে ৭ কেজি হয়। লেজ: পুরুষ ও স্ত্রী যথাক্রমে ৭৫ থেকে ৯৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ হয়। গড়ে এরা ২০ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে (যত্নের পরিবেশে ৩০ বছর পর্যন্ত)। দলের প্রধান পুরুষই প্রজনন করে থাকে। দল বদল হলে বা নতুন পুরুষ গ্রুপ দখল করলে ব্যতিক্রম ঘটতে পারে তবে এটি খুবই বিরল ঘটনা।
বিস্তৃতি:
মুখপোড়া হনুমান দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঘন জঙ্গলে বেশি দেখা যায়। মালয়েশিয়া (পেনিনসুলা), থাইল্যান্ড, মায়ানমার এবং সিঙ্গাপুরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বসবাস রয়েছে।
বাংলাদেশে এদের দেখা মেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, খাগড়াছড়ি, মধুপুর (টাঙ্গাইল), লাউয়াছড়া (মৌলভীবাজার) ও রেমা কালেঙ্গা, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান (হবিগঞ্জ), পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের কাঁঠালতলী, বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা, কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা, দিনাজপুরের হিলি এলাকা (অনেক সময় পার্শ্ববর্তী ভারত থেকে আসে) হাকিমপুর ও গাইবান্ধার কিছু এলাকায় মুখপোড়া হনুমানের দেখা যায়।