কালীগঞ্জে নানা সংকটে গ্রামআদালত

এফএনএস (টিপু সুলতান; কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ) : | প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৫:৩৭ পিএম
কালীগঞ্জে নানা সংকটে গ্রামআদালত

আপন দুই ভাইয়ের মধ্যে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে আদালতে করা মামলা পাঠিয়ে দেওয়া হয় নিউ ইউনিয়নে বাড়ির সন্নিকটে থাকা গ্রাম আদালতে। সেখানে উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে মামলাটির নিস্পত্তি হয়। এতো সহজে মামলার নিস্পত্তি হবে ভাবতেও পারেননি ঐ মামলার বাদি। গ্রাম আদালতের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার এ গল্পটি করছিলেন উপজেলার বারোবাজার ইউনিয়নের বাদেডিহি গ্রামের মৃত সাব্দার আলীর ছেলে রুস্তম আলী। গ্রাম আদালত গতিশীল থাকলে স্থানীয় অনেক মামলা রুস্তম আলীর মামলার মতো নিস্পত্তি হতো। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে দৈনন্দিন কার্যাবলীর ন্যায় গ্রাম আদালত পরিচালনা করার কথা থাকলেও তা যথাযথ ভাবে করা হয় না। মূলত মানুষের অসেচতনতা,এজলাস না থাকা,জনপ্রতিনিধিদের নানাঅনিহাসহ বিভিন্ন কারণে গ্রাম আদালতের সুফল সেভাবে পাচ্ছেনা গ্রামের সাধারন মানুষ। মানুষ গ্রাম আদালত থেকে কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছে না তা গত ১বছরে কালীগঞ্জ উপজেলার ১১ টি ইউনিয়নের চিত্রই বলে দেয়। ২০২৪ এর ১ জানুয়রী থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১টি ইউনিয়নে সর্বমোট মাত্র ১২৪ টি মামলা গ্রহন করে গ্রাম আদালত। এরমধ্যে ১০৬ টি মামলা মিমাংসা হয়। ইউনিয়ন গুলোতে এখনো মামলা চলমান রয়েছে ১৮টি। এদিকে সবচেয়ে বেশি মামলা গ্রহনকারী ইউনিয়ন হলো উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নটিতে গ্রাম আদালতে গতবছর সর্বোচ্চ ৪০ টি মামলা গ্রহন করা হয়। এরমধ্যে ৩৩ টি মীমংসায়িত হয়, ৭টি মামলা এখনও চলমান রয়েছে। এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ঋতু গ্রাম আদালতের এজলাসে বসে নিয়মিত মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অপরদিকে, গত ১বছরে আদালত থেকে ইউনিয়ন গুলোর গ্রাম আদালতে  ১১টি মামলা পাঠানো হয়। গ্রামের সর্বস্তরের জনগনকে কম সময়ে নামমাত্র খরচে বিচারিক সেবা প্রদান করার জন্য  গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ জারি হয় ১৯৭৬ সালে। গ্রাম আদালত আইনে রুপ নেই ২০০৬ সালে, এরপর থেকে ইউএনডিপি এবং ইউরোপিয় ইউনিয়ন এর আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় প্রকল্প আকারে তা মাঠ পর্যায়ের কার্যকর হয়। বর্তমানে স্থানীয় সরকার বিভাগের তত্বাবধানে গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ (সংশোধনী-২০০৪) কার্যকর করার মাধ্যমে পল্লী এলাকার নারী,দরিদ্র অনুগ্রসহ ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর বিচারিক সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে গ্রাম আদলত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সর্বশেষ সংশোধনী ২০২৪ অনুযায়ী গ্রাম আদালতের আর্থিক ক্ষমতা ৭৫ হাজার টাকা থেকে পরিবর্তন করে ৩ লক্ষ টাকা করাসহ তফসিলের দ্বিতীয় অংশে (দেওয়ানী) ৭ নং ক্রমিকে নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখ ঝিনাইদহ জেলা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ রায় স্বাক্ষরিত একটি পত্রের মাধ্যমে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও অধিকতর গতিশীল করনের জন্য বলা হয়। বর্তমানে আলাদত থেকেও বিভিন্ন মামলা নিস্পত্তির জন্য গ্রাম আদালতে পাঠাচ্ছেন বিচারকগণ। নানাবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো আর জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসার ব্যপারে সরকারের উদ্যোগ মাঠ পর্যায়ে সেভাবে কার্যকর হচ্ছে না। কালীগঞ্জ উপজেলায় ৪ টি ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত পরিচালনার জন্য এজলাস নেয়। এজলাস না থাকার কারণে এইসব ইউনিয়ন পরিষদে আদালত কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। ফলে গ্রাম আদালতের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এইসব ইউনিয়নের জনগণ। আদালত থেকে পাঠানো মামলা গ্রাম আদালতের মাধ্যমে  নিস্পত্তির নজির খুব বেশী না হলেও কিছু কিছু মামলা এখন গ্রাম আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হতে দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে উপজেলার ১১ টি ইউনিয়নের মধ্যে মালিয়াট ইউনিয়ন এবং ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং রায়গ্রাম ইউনিয়ন ও কাষ্ঠভাঙ্গা ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করছেন। বাকি ৭ টি ইউনিয়ন উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাগণ অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গত এক বছরে কালীগঞ্জ থানায় ধর্তব্য  অপরাধে ২২২ টি মামলা হয়। অপরদিকে, গ্রাম আদালতে মামলা হয়েছে ১২৪ টি। গ্রাম আদালত যদি আরো গতিশীল হয়, সেক্ষেত্রে আদালত কিংবা ধানায় মামলার সংখ্যা অনেক কমে যাবে বলে মনে করেন সচেতন মহল।  গ্রাম আদালতের কালীগঞ্জ উপজেলা সমন্বয়ক মনিরুজ্জামান উজ্জল বলেন, গ্রাম আদালতের কার্যক্রমে প্রসার না হওয়ার প্রধান কারণ হলো স্থানীয় পর্যায়ে সাধারণ জনগণের মাঝে গ্রাম আদালত সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। অধিকাংশ লোকজন গ্রাম আদালতের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে অবগত নয়, সে কারণে তারা গ্রাম আদালতে না যেয়ে থানা বা আদালতের দিকে ধাবিত হয়। সেক্ষেত্রে থানা বা পুলিশ ক্যাম্প গুলো যদি তাদেরকে প্রাথমিক পর্যায়ে গ্রাম আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেন তাহলে মানুষ এই আদালত সম্পর্কে আরো বেশি অবগত হবে এবং গ্রাম আদালতের সকল সুযোগ সুবিধা নিতে পারবেন। উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ঋতু বলেন, আমি মনে করি গ্রামের সাধারণ মানুষ তাদের সমস্যা নিয়ে যখন থানায় যাই থানা থেকে তখন যদি তাদেরকে গ্রাম আদালতের কথা বলে, তাহলে প্রাথমিক ভাবে তাদের সমস্যা নিয়ে গ্রাম আদালত কাজ করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে গ্রাম আদালত ব্যর্থ হলে চেয়ারম্যানের লিখিত প্রত্যায়নে  থানা মামলা গ্রহন বা আইনগত ব্যবস্থা নেবে। এভাবে কাজ করলে গ্রাম আদালত আরও গতিশীল হবে। পাশাপাশি গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে গ্রাম আদালতের সুফল সম্পর্কে সচেতনামূলক প্রচারনা চালাতে হবে। কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শহিদুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, অধর্তব্য অপরাধের যেকোন অভিযোগ পেলে বাদিকে আমি প্রথমে গ্রাম আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেই। কিন্তু অনেকেই সেখানে যেতে চান না। এলঅকার মানুষ সচেতন হয়ে গ্রাম আদালত সক্রিয় হলে আদালত ও থানার উপর মামলার চাপ কমবে। কালীগঞ্জ উপজেলা গ্রাম আদালত ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেদারুল ইসলাম বলেন, গ্রাম আদালতকে শক্তিশালী করার জন্য ইতিমধ্যে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং প্রশাসকদের নানা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যে ইউনিয়ন গুলোতে এজলাস নেই সেখানে আমরা তৈরি করে দেবো। গ্রাম আদালতেও বিবাদমান সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান বা নিষ্পত্তি হতে পারে প্রথমত এই বিশ্বাসটি মানুষের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে। সাধারণ মানুষ গ্রাম আদালত সম্পর্কে জানেন। এখন প্রয়োজন গ্রাম আদালতের প্রতি তাদের আস্থা জায়গাা তৈরি করা। সর্বোপরি নানামুখী প্রচার প্রচারনা এবং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় গ্রাম আদালতকে আরো গতিশীল করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে