বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ: উন্নয়নের নামে লুটপাটের মহোৎসব

সম্পাদকীয় : | প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৮:৫৫ পিএম
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ: উন্নয়নের নামে লুটপাটের মহোৎসব

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার কথা ছিল। প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল চাষিদের পানির চাহিদা মেটানো, কৃষি উৎপাদন বাড়ানো এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। কিন্তু এই সংস্থা এখন দুর্নীতি, অনিয়ম এবং লুটপাটের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পরিকল্পনার অভাব, অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং দুর্নীতির মহোৎসবের কারণে বিএমডিএর কার্যক্রম কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ নয়, বরং অভিশাপে রূপ নিয়েছে। খাল খননের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের জীবনে। অপরিকল্পিত খনন কাজের ফলে অনেকের ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে, অথচ জলাবদ্ধতা নিরসন কিংবা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে তেমন কোনো ফল মেলেনি। শাহাপুর-কাটাখালী-ছত্রগাছা খালটি আজ ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের খালগুলোতেও পানি থাকে না বর্ষা মৌসুম ছাড়া। এদিকে তালগাছ রোপণের প্রকল্পেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অনেক জায়গায় বীজ ঠিকমতো লাগানো হয়নি; আবার কোথাও ঠিকাদাররা দায়সারা কাজ করে পালিয়ে গেছেন। বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের জন্য সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি হলেও বিএমডিএর প্রকল্পগুলোতে দেখা গেছে বিপরীত চিত্র। নিম্নমানের পাইপ, ভাল্ব ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করায় প্রকল্পের কার্যকারিতা নষ্ট হয়েছে। এমনকি কাজ না করেও বিল পরিশোধের অভিযোগ উঠেছে। একটি প্রকল্পে প্রায় ১০০ কোটি টাকার পাইপ ও গেট ভাল্ব কেনায় ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুধু সংস্থার ভাবমূর্তিই নষ্ট করেনি, বরং কৃষকদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। দুর্নীতি ঢাকতে অডিট প্রতিবেদন উপেক্ষার ঘটনাও বিএমডিএর জন্য নতুন কিছু নয়। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার অনিয়ম উঠে এসেছে অডিট রিপোর্টে। কিন্তু সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদন আমলে নেওয়ার পরিবর্তে লুটপাট অব্যাহত রেখেছেন। অফিসে আগুন দিয়ে প্রমাণ মুছে ফেলার মতো চাঞ্চল্যকর অভিযোগও পাওয়া গেছে।

বিএমডিএর কর্মকর্তাদের বেতন স্কেল জালিয়াতির ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। ৭৩ জন প্রকৌশলী নিজেদের বেতন স্কেল বাড়িয়ে মাসের পর মাস বাড়তি বেতন তুলেছেন। এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট, বিএমডিএর ভেতরে একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবাজ চক্র সক্রিয় রয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি খাত রক্ষায় এবং বিএমডিএর কার্যক্রম স্বচ্ছ করতে অবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ছাড়া এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। কৃষি মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব নিতে হবে, যেন বিএমডিএ প্রকৃতপক্ষে কৃষকের কল্যাণে কাজ করতে পারে। দেশের অর্থনীতি এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতো একটি সংস্থা যদি কৃষি উন্নয়নের বদলে দুর্নীতির আখড়া হয়ে ওঠে, তবে তা শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলের নয়, পুরো দেশের জন্যই এক ভয়াবহ সংকেত। তাই এ সংস্থাকে পুনর্গঠন করে কৃষকদের আস্থার জায়গায় পরিণত করাই হবে সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW