বাংলাদেশের রাজশাহীতে উৎপাদিত রেশম পণ্যের নাম রাজশাহী সিল্ক। এটি বিখ্যাত কারণ এটি পোশাকের জন্য, বিশেষ করে শাড়ির জন্য ব্যবহৃত একটি উচ্চমানের কাপড়। ২০২১ সালে, এটিকে বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে ভৌগোলিক নির্দেশক মর্যাদা দেওয়া হয়। রেকর্ড অনুসারে, এই অঞ্চলে রেশম উৎপাদন শুরু হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। তখন এটি বেঙ্গল সিল্ক বা গাঙ্গেয় সিল্ক নামে পরিচিত ছিল। পাকিস্তান সরকার ১৯৫২ সালে রাজশাহীতে রেশম উৎপাদন শুরু করে। রাজশাহী সিল্ক ফ্যাক্টরি ছিল একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কারখানা যা ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে এটি বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তখন থেকে এটি লোকসানে চলে আসছে। এটি ৩০ নভেম্বর ২০০২ সালে বন্ধ হয়ে যায়। ২০০২ সালের আগে এই কারখানায় ৩০০ টন সুতা তৈরি হত। ২০১১ সালে এটি ছিল মাত্র ৫০ টন। ২০১১ সালে বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত রাজশাহী সিল্ক ফ্যাক্টরি পুনরায় চালু করার আগ্রহ প্রকাশ করেন কিন্তু বেসরকারিকরণ কমিশন এটিকে লোকসানের উদ্বেগ বলে প্রত্যাখ্যান করে।
কাপড়ের রানি রেশম। রেশম বা সিল্ক পৃথিবীর সবচেয়ে শৌখিন পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে খ্যাত। সিল্কের মতো সমাদৃত ও আরামদায়ক পরিধেয় বর্তমানে নেই, পূর্বেও কোনো সময় ছিল না। বিশ্ব বাজারে আজও সিল্ক অপ্রতিদ্বন্দ্বী বস্ত্র। এর সাথে জড়িয়ে আছে আভিজাত্য।
ব্যবহারকারীদের অনেকেই জানেন না সিল্ক কীভাবে তৈরি হয়। জানলে চমকে উঠবেন। পৃথিবী খ্যাত একটা ইটালিয়ান টাই তৈরি করতে জীবন উৎসর্গ করতে হয় আড়াইশোর বেশি পলু পোকার জীবন। আর একটা শাড়ির জন্য পাঁচ হাজার ও শার্টের জন্য আড়াই হাজার রেশম পোকার জীবন দিতে হয়।
রেশমের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর পূর্বে চীনারা এ বস্ত্রের আবিষ্কার করে। ব্যবসায়িক কারণে তারা পরবর্তী দুই হাজার বছর পর্যন্ত চাষের গোপনীয়তা রক্ষা করেছিল। সে সময় তারা এককভাবে কাঁচা রেশম ও রেশম বস্ত্র রফতানি করত। চীন থেকে আফগানিস্তান হয়ে পারস্য উপসাগরীয় দেশসমূহের ইরান, তুরস্ক হয়ে ইউরোপ, রাশিয়ার কাজাখস্তানে রপ্তানি হতো এ বস্ত্র। তিব্বত-কাশ্মীর হয়ে ভারতবর্ষে রেশম বস্ত্র আসতো। পরবর্তীতে ওই পথ ধরেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রেশম প্রযুক্তি পাচার ও রেশম চাষ শুরু হয়।
ভারত উপমহাদেশে রেশম চাষের ইতিহাস সম্পর্কে কথিত রয়েছে, এক চীনা রাজকুমারী কাশ্মীরের এক যুবরাজের সঙ্গে বিবাহ করে গোপনে মাথার চুলের খোঁপার মাধ্যমে রেশম পোকার ডিম প্রথম কাশ্মীর উপত্যকায় নিয়ে আসে। পরবর্তীকালে হিমালীয় পাদদেশ হয়ে গঙ্গা অববাহিকায় রেশম চাষ শুরু হয়। রেশম শিল্পের কলাকৌশল চীন থেকে তিব্বত ও কাশ্মীর হয়ে ভারতে আসে। ইতিহাসবিদদের মতে, মোঘল শাসনামলে অবিভক্ত বাংলায় রেশম চাষের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। বেঙ্গল সিল্ক নামে এ শিল্প ছিল আর্থ-সামাজিক অবস্থানের মাপকাঠি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ঘন ঘন মারাঠি আক্রমণের কারণে আত্মরক্ষার্থে মুর্শিদাবাদ থেকে অনেকে পরিবারসহ পদ্মা নদী পেরিয়ে রাজশাহীতে বসতি গাড়ে। তারা জীবিকার তাগিদে ডাচদের ব্যবসার শ্রমিক ও কর্মচারী হিসেবে কাজ করলেও ওলন্দাজরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে রাজশাহীতে রেশম শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটতে শুরু করে। রেশম ইউরোপীয় বণিকদের আকৃষ্ট করে। তারা এখানে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে।
ব্রিটিশ ঐতিহাসিক হান্টারের মতে, রাজশাহী জেলায় রেশম সুতায় তৈরি রেশম বস্ত্র বুনন বহু শতাব্দী পূর্ব থেকে হয়ে আসছে। মোঘল আমলে শিল্পটি পৃষ্টপোষকতা পেয়ে এগিয়ে যায়। ওলন্দাজ বণিকরা রাজশাহীতে পদ্মার তীরে বাণিজ্যিক কুঠি স্থাপন করে। এখনো সেটি বড়কুঠি হিসেবে উল্লিখিত হয়ে থাকে। হান্টারের মতে, রাজশাহী জেলা প্রাচীনকাল থেকেই রেশম ও রেশমজাত পণ্য তৈরি এবং রপ্তানিতে ভারতবর্ষের যে কোনো অঞ্চলের তুলনায় শীর্ষস্থানে অবস্থান করে এসেছে। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত রেশম সুতা তৈরির ক্ষেত্রে রাজশাহী ছিল একমাত্র বাণিজ্য কেন্দ্র। ওলন্দাজ ও ডাচদের পরে ইংরেজরা রাজশাহীতে এসে রেশম ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তার করে।
ইংরেজি ১৮৭১ সালে রাজশাহীর তৎকালীন কালেক্টর জে এস কার্সটৈয়ারসের দেয়া রিপোর্টে জানা যায়, সে সময় মোঘল ও ওয়াটসন এন্ড কোম্পানির কারখানায় প্রতিদিন আট দশ হাজার মানুষ রেশম গুটি থেকে সুতা তৈরি করতো।
১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর ভাগাভাগি হয়ে যায় রেশমও। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শিবগঞ্জ, ভোলাহাট ও রহনপুর, মালদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়। রেশম শিল্পের দক্ষ কারিগরদের বেশিরভাগ চলে যায় ভারতে। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা ষাটের দশকে দেশে বারোটি রেশম নার্সারি, কুড়িটি সম্প্রসারণ কেন্দ্র, একটি রেশম কারখানা এবং গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট করে। তবে দক্ষ জনবল, প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও তহবিলের অভাবে রেশমের কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বিধ্বস্ত নার্সারিগুলোর মেরামতের পদক্ষেপ নেয়া হয়। তবে পরবর্তীতে মুখ থুবড়ে পড়ে রেশম শিল্প।
রেশম শিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য দৃষ্টি দেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি অনুধাবন করেন, রেশম চাষ এমনি এক কৃষি-শিল্প, যা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সার্বক্ষণিক কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে পারে এবং পরিবারের অধিক আয়ের নিরাপত্তা দিতে পারে। এ শিল্পে সমাজের দুর্বল শ্রেণিকে কাজ দেবার উপযুক্ত মাধ্যম। এখানে পরিবারের সবাইকে কাজ দেয়া যেতে পারে। রেশম শিল্পের বিভিন্ন স্তরের কাজ নিজের পছন্দ ও উপযোগিতা অনুযায়ী বেকারত্ব মোচন ও উপার্জন বাড়ানো সম্ভব। তাই, ১৯৭৭ সালে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে রেশম বোর্ড গঠন করেন তিনি। ১৯৭৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে রেশম বোর্ডের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়। শুরু হয় হারানো রেশমের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার। বাংলাদেশ-সুইস যৌথ প্রকল্পে নেয়া হয় ক্র্যাশ প্রোগ্রাম। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলতো বটেই, উত্তরের ঠাকুরগাঁও থেকে দক্ষিণে সাতক্ষীরা এবং পূর্বে বান্দরবান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে রেশম চাষ। দেশের ৪২টি জেলার একশ’ নব্বই থানায় বিস্তার লাভ করে রেশম চাষ। গড়ে তোলা হয় সম্প্রসারণ জোন। রাজশাহী, ভোলাহাট, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া, যশোর, কুষ্টিয়া, ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লায় আটটি মিনিফিলিয়েচার গড়া হয়। নেয়া হয় ক্ষুদ্র তুঁত বাগানসহ বিভিন্ন প্রকল্প। রেশম নিয়ে শুরু হয় নানা কর্মকাণ্ড। বন্ধ হয়ে যাওয়া রেশম তাঁতগুলো চালু হয়। বিদেশ থেকে উন্নত জাত এনে পরিবর্তন ঘটানো হয় রেশম চাষে। রাজশাহী ও ঠাকুরগাঁওয়ের কারখানা দুটি ভালোই চলছিল। বিধিবাম ১৯৯১ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপসানে মন্ত্রণালয় ঢালাওভাবে সুতা আমদানির সুযোগ করে দেয়। সাথে আমদানিতে ট্যাক্স মুক্তির সুযোগ দেওয়া হয়। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত সুতা আমদানি করতে থাকে। ভারতে পাচার হয় সুতা। পথ হারিয়ে ফেলে স্থানীয়ভাবে সুতা উৎপাদনকারীরা। তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে রেশম চাষ ছেড়ে দেয়। সুতার বাজার হয়ে পড়ে আমদানিনির্ভর। চীন, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সুতা আসতে থাকে। সরকারি কারখানা দুটো অচল হয়। কোটি কোটি টাকা খরচ করে আনা তাতে প্রাণ ফেরানো যায়নি। এদিকে রেশম বোর্ডের সাথে রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের শীতল সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে বিশ্ব ব্যাংক ১৯৯৭ সালে রেশমের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। এখানকার কিছু উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে সিল্ক ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলে। প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি টাকা নিয়ে রেশম উৎপাদনের নামে তোড়জোড় শুরু করে। সাথে যোগ দেয় বড় বড় কয়েকটি এনজিও। রেশম বোর্ডের বাগান, মিনি ফিলিয়াচারসহ বিভিন্ন স্থাপনা তাদের দখলে নেয়। কিছুদিন রেশম নিয়ে হৈচৈ করে তাদের দখলে নেয়া মিনি ফিলিয়াচারসহ বিভিন্ন স্থাপনা নিয়ে তৎপরতা চালায়। পরবর্তীতে সবকিছু লন্ডভন্ড করে যে উদ্দেশ্যের কথা বলে ফাউন্ডেশন কাজ শুরু করেছিল তার কোনো বাস্তবায়ন না করে পাত্তাড়ি গোটায়।
১৯৭৮ সালে রেশম বোর্ড গঠন হবার পরপর উদ্যোগী হয়ে দু’তিনজন সিল্ক ব্যবসায়ী বেসরকারি উদ্যোগে সিল্ক ফ্যাক্টরি গড়ে তোলেন। রাজশাহীর মরা বিসিকে (সপুরা) প্রাণ সঞ্চার ঘটে। একে একে ৭৬ টি কারখানা গড়ে ওঠে। সপুরা সিল্ক এলাকা হিসেবে পরিচিত লাভ করে। রং ডিজাইনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। চোখ ধাঁধানো শোরুমে শোভা পেতে থাকে বিচিত্র ধরনের রেশম পণ্য। রাজধানীতো বটে বিদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রাজশাহী সিল্কের শোরুম করা হয়। শুরু হয় প্রতিযোগিতা। সুতার চাহিদা বাড়ে। আড়াইশো মেট্রিক টন সুতার বিপরীতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় চল্লিশ মেট্রিক টন সুতা। ১৯৯১ সালে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে মন্ত্রণালয় ট্যাক্সমুক্তভাবে অবাধে সুতা আমদানির সুযোগ করে দেয়। সুযোগ নেয় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এলোমেলো হয় সুতার বাজার। স্থানীয় বাজারে আমদানি করা সুতার সাথে দামে টিকতে না পেরে স্থানীয় চাষিরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তুঁতের জমিতে অন্য ফসলের আবাদ করতে শুরু করে। অস্তিত্ব সংকটে পড়ে রাজশাহী সিল্ক। সুতা বিদেশনির্ভর হয়ে পড়ে। বিশেষ করে চীনা সুতার উপর। চাহিদা চারশ’ মেট্রিক টন। বিপরীতে দেশে উৎপন্ন হতো চল্লিশ মেট্রিক টন। সুতো সংকটের কারণে ৭৬ কারখানার মধ্যে ৫৮টি বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি কারখানা দুটো বন্ধ প্রায়। যে সমস্ত কারখানা টিকে আছে তারাও বেশ কষ্টে রাজশাহী সিল্কের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
‘রেশম উন্নয়ন বোর্ড’’ ১৯৭৮ সালে বেশ জাঁকজমকভাবে তৎপরতা শুরু করলেও গত ৪৬ বছরে নানা কারণে রেশমের উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। প্রচারণা রয়েছে রেশম বোর্ডে একজন চেয়ারম্যান যোগদানের পর তিনি পার্শ্ববর্তী তুঁত বাগানে গিয়ে রেশমের গুঁটি খুঁজছিলেন। তার ধারণা ছিল আম লিচুর মতো রেশম গুঁটি গাছে ঝোলে। এমনিভাবে অনেকের যাওয়া-আসা চলেছে। রেশমের উন্নয়ন নিয়ে বড় বড় স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে। গত দশ বছরে রেশম সুতার উৎপাদন বাড়াতে শতকোটি টাকার বেশকিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। দুটো প্রকল্পের কাজ শেষ হবার পথে। পনেরো কোটি টাকার সবুজ পাতা নামে আরেকটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায়। গত দশ বছরে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। চল্লিশ টনের বেশি সুতা উৎপাদনের কথা বলা হচ্ছে। তবে রেশম বোর্ডের এই হিসাবকে গোঁজামিল বলে উল্লেখ করছেন সংশ্লিষ্টরা। বেসরকারি হিসাবে কোনোক্রমেই পাঁচটনের বেশি নয়। রেশম শিল্পমালিক সমিতির সভাপতি লিয়াকত আলী দীর্ঘদিন ধরে রেশম নিয়ে কাজ করছেন। তার অভিমত হলো, রেশম এমন একটি শিল্প, যাকে কুটির, ক্ষুদ্র, মাঝারি, ভারী সকল শিল্পে রূপ দেয়া যায়। রেশম একটি শ্রমঘন কৃষিভিত্তিক শিল্প। অল্প সময়ে এ ফসল ঘরে তোলা যায়। বাড়ির আশেপাশে যে কোনো পতিত জমিতে তুঁত গাছ লাগানো যায়। রেশম শিল্পকে কৃষিখাতভুক্ত করা হয়েছে।
সুতা সংকটের কারণে ৭৬ টির মধ্যে বর্তমানে আঠারোটি কোনো রকমে টিকে রয়েছে। রেশমের সুতি কাপড় বহুকাল ধরে রাজশাহীর সিল্ক সম্পর্কে এ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো দালিলিক তথ্য-প্রমাণের মধ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুজন কর্মকর্তার পাঠানো দুটি প্রতিবেদন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি হল ওয়েল কর্তৃক ১৭৫৯ সালের লেখা থেকে রাজশাহীর কালেক্টর ও’ম্যালার উদ্ধৃতি তুলে ধরছি, ‘১৭৫৯ সালে মিস্টার হলওয়েল লিখেছেন, মোট ছয় ধরনের রেশম বস্ত্র এবং সুতা নাটোর থেকে ইউরোপসহ বসরা, মক্কা, জেদ্দা, পেগু, আচিন ও মালাক্কার বাজারে রপ্তানি করা হতো।’
দ্বিতীয় রিপোর্টটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান সেরেস্তাদার জেমস গ্রান্ট কর্তৃক ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৭৮৮ সালে সদর দপ্তর ফোর্ট উইলিয়াম কলকাতায় প্রেরিত। ইতিহাসে এটি গৎ. ঔধসবং এৎধহঃ’ং অহধষুংরং ড়ভ ঃযব ঋরহধহপবং ড়ভ ইবহমধষ নামে পরিচিত। ‘ফিফথ রিপোর্ট’ নামক ১৮১২ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের ২৫৯ পৃষ্ঠায় রাজশাহী সিল্ক সম্পর্কে বর্ণনার কিয়দংশ তুলে ধরা হলো, ‘জধলবংযধযু, ঃযব সড়ংঃ ঁহরিবষফু বীঃবহংরাব তবসরহফধৎৎু ড়ভ ইবহমধষ, ড়ৎ ঢ়বৎযধঢ়ং রহ ওহফরধ; রহঃবৎংবপঃবফ রহ রঃং যিড়ষব ষবহমঃয নু ঃযব মৎবধঃ এধহমবং ড়ৎ ষবংংবৎ নৎধহপযবং, রিঃয সধহু ড়ঃযবৎ হধারমধনষব ৎরাবৎং ধহফ ভবৎঃরষরুরহম ধিঃবৎং, ঢ়ৎড়ফঁপঃরহম রিঃযরহ ঃযব ষরসরঃ ড়ভ রঃং ঔঁৎরংফরপঃরড়হ, ধঃ ষবধংঃ ভড়ঁৎ-ভরভঃযং ড়ভ ধষষ ঃযব ংরষশ, ৎধি ড়ৎ সধহঁভধপঃঁৎবফ, ঁংবফ রহ ড়ৎ বীঢ়ড়ৎঃবফ ভৎড়স ঃযব বভভবসরহধঃবফ ষীঁঁৎরড়ঁং বসঢ়রৎব ড়ভ ঐরহফড়ংঃধহ’.
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে দেওয়া এই রিপোর্ট রাজশাহী সিল্কের গৌরবগাঁথার একটি অনন্য প্রামাণিক দলিল হিসেবে স্বীকৃত। ইউরোপীয় বণিকেরা এ দেশে ব্যাপকভাবে আসা শুরু করে সপ্তদশ শতাব্দী থেকে। এরা আসার আগে বাংলাদেশে গ্রামকেন্দ্রিক অসংখ্য বাজার-বন্দরে দেশীয় কৃষিজাত ও কুটিরশিল্পজাত দ্রব্যাদির বেচাকেনা চলত। বৃহত্তর রাজশাহীতে বোয়ালিয়া, নাটোর, তাহিরপুর, মীরগঞ্জ, চারঘাট, কাপাশিয়া এসব নদীবন্দর রেশম ও কার্পাস সুতা এবং বস্ত্র কেনাবেচার জন্য বিখ্যাত ছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত, বিশেষ করে রেশমের সুতা প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে ‘বোয়ালিয়া’ ছিল উত্তরবঙ্গের মধ্যে একমাত্র বাণিজ্যকেন্দ্র। রাজশাহীর বোয়ালিয়া বন্দরকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে তুঁতের চাষ হতো। গঙ্গা (পদ্মা)-তীরবর্তী বোয়ালিয়ায় ওলন্দাজদের বাণিজ্যিক কুঠিটি তৈরি হয়েছিল মূলত রেশমের কারবারের জন্যই। এটি ছিল এই শহরের প্রথম বড় পাকা স্থাপনা। সম্ভবত আঠারো শতকের প্রথম দিকে এটি স্থাপিত হয়। পলাশী যুদ্ধের পরে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক কুঠিটির দখল পেয়েছিল। ওলন্দাজরা গঙ্গা-তীরবর্তী রাজশাহী জেলার সারদাতে ১৭৮০ থেকে ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ফ্যাক্টরিসহ বৃহদাকারের বাণিজ্যিক কুঠি নির্মাণ করে রেশমের পাশাপাশি নীলের ব্যবসা শুরু করে। ১৮২৫ সালে ডাচদের (ওলন্দাজ) কাছ থেকে সারদার ফ্যাক্টরি এবং কুঠি ইংরেজ ব্যবসায়ীরা চুক্তির ভিত্তিতে পেয়ে রেশম ও নীলের কারবার শুরু করে। রবার্ট ওয়াটসন অ্যান্ড কোম্পানি এ সময়ে রাজশাহীতে প্রায় একচেটিয়া রেশম ও নীলের ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল। এই কোম্পানির আওতাধীন বৃহত্তর রাজশাহীসহ কাছাকাছি অঞ্চলে ১৫২টি রেশম ও নীলকুঠি ছিল। রেশমকুঠিগুলো ছিল পদ্মা, বড়াল, নারদ, হোজা, মুসাখান, আত্রাই, ইছামতী, বারাহী, বারনই এসব নদ-নদীর তীরে। ওলন্দাজদের পরে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়ীরা রাজশাহীতে প্রথম দিকে কোনো বাণিজ্যিক কুঠি স্থাপন করেনি। তবে একটি কারখানা স্থাপনপূর্বক দেশীয় রেশমের সুতা প্রস্তুত, ক্রয় ইত্যাদির কারবার শুরু করে। ওলন্দাজ ও ডাচদের পরে ইংরেজরা রাজশাহীতে এসে রেশম ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তার করে। ইংরেজি ১৮৭১ সালে রাজশাহীর তৎকালীন কালেক্টর জে এস কার্সটেয়ারসের দেওয়া রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে মেসার্স ওয়াটসন অ্যান্ড কোম্পানির কারখানায় ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার লোক দৈনিক রেশমগুটি থেকে সুতা প্রস্তুত করত। কারখানায় প্রতিবছর ১৬ থেকে ১৭ লাখ পাউন্ড মূলধন বিনিয়োগ হতো। তৎকালীন রাজশাহী জেলায় ইউরোপীয় এবং দেশি কারখানাগুলোতে ৫ হাজার মণ বা ১৮০ টন কাঁচা সিল্ক উৎপাদিত হতো, যার মূল্য ছিল ৩৭ লাখ পাউন্ড। মেসার্স ওয়াটসন কোম্পানির পরে মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানি এবং সবশেষে বেঙ্গল সিল্ক কোম্পানি রাজশাহীতে বড় কুঠিকে কেন্দ্র করে রেশমের ব্যবসা পরিচালনা করে। এর পাশাপাশি দুটি ফরাসি কোম্পানি মেসার্স এন্ডারসন ও মেসার্স লুই পেইন অ্যান্ড কোম্পানি রাজশাহীতে রেশমের কারবার পরিচালনা করে।
১৮৮৮ সালে ওই তিন কোম্পানির রাজশাহীতে মোট ১৪টি কারখানায় উৎপাদিত রেশমি সুতার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৫২ পাউন্ড। বেঙ্গল সিল্ক কোম্পানির বোয়ালিয়ার বড় কুঠিসহ ছিল ১০টি বাণিজ্যিক কুঠি। পক্ষান্তরে মেসার্স লুই পেইন অ্যান্ড কোম্পানির ছিল ৩টি বাণিজ্যিক কুঠি। এগুলো হলো কাজলা, খোজাপুর ও সাহেবগঞ্জে। পরবর্তী সময়ে খোজাপুর ও সাহেবগঞ্জের কুঠি পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মেসার্স এন্ডারসন কোম্পানির একমাত্র কুঠিটি শিরইলে ছিল, যার চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে।
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বোয়ালিয়া শহর ও সন্নিহিত এলাকায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ছোট ছোট দেশীয় কোম্পানি গঠন করে কুঠি ও আড়ত স্থাপন করে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে রেশমসুতা ও রেশমজাত পণ্যের ব্যবসা পরিচালনা করত। দেশি এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে ১৯ জন ব্যবসায়ীর নামের একটি তালিকা পাওয়া যায়, খাঁ সাহেব সাগরপাড়া ও রেশমপট্টিতে কুঠি ছিল, গদু বাবু রেশমপট্টিতে কুঠি ছিল, জয় রাম সিংহ ও রাম রতন সিংহ ভারতী সপুরাতে মঠ ও কুঠি স্থাপন করেন, দুলাল সাহা সপুরাতে কুঠি ছিল, রাম রতন ও মদন গোপাল মাড়োয়ারিপট্টির কুঠি ও আড়ত, নগেন দাস ও ফুল চাঁদ রেশমপট্টিতে কুঠি, লাল বিহারি শিরোইলে কুঠি, খেতু বাবু আলুপট্টিতে কুঠি, কার্তিক সাহা সপুরাতে কুঠি ও আড়ত, কোকারাম মণ্ডল বায়া বাজারের কাছে কুঠি, অনাথবসু মণ্ডল মির্জাপুরে কুঠি ও কারখানা, এনায়েত মণ্ডল বোয়ালিয়াতে কুঠি ও কারখানা, নবির উদ্দীন সংসাদীপুরে কুঠি ও কারখানা, হরেকৃষ্ণ সরকার খোজাপুরে কুঠি ও কারখানা, মোহাম্মদ নুরুদ্দীন বশরীতে কুঠি ও কারখানা, শাহবাজ তালুকদার কাপাশিয়াতে কুঠি ও আড়ত, হাজি নফরুদ্দীন মণ্ডল মহানন্দখালীতে কুঠি ও আড়ত, মিয়াজান রেশমপট্টিতে আড়ত, হাজি মনিরুদ্দীন সপুরাতে আড়ত।
রাজশাহী সিল্কের বিশালত্বের তুলনায় এসব বর্ণনা অতি সামান্য। তবু যেটুকু আলোচনা হয়েছে, তাতে বর্তমান বাংলাদেশে রেশমের চাষ, এর বিস্তার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের যে ঐতিহাসিক পরম্পরা, সেটি ধারণ করে এই শিল্পকে এককভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব বৃহত্তর রাজশাহী জেলার। রাজশাহীর ঐতিহ্য হিসেবে খ্যাত। ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। বিশ্ব বাজারে আজও রেশম অপ্রতিদ্বন্দ্বী বস্ত্র। একে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হবে।
লেখক : মোঃ হায়দার আলী; প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়