ভারতে থেকেও হবিগঞ্জের হয়ে ত্রিশালে জন্মনিবন্ধ!

ইউপি প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল লতিফের ভূয়া জন্ম নিবন্ধন কেলেংকারী

এফএনএস (ত্রিশাল, ময়মনসিংহ) : : | প্রকাশ: ২১ এপ্রিল, ২০২৫, ০৫:০৬ পিএম
ইউপি প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল লতিফের ভূয়া জন্ম নিবন্ধন কেলেংকারী

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রারের আদেশ উপেক্ষা করে ভূয়া জন্ম নিবন্ধন করে আলোচনা সৃষ্টিকারী ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার কানিহারী ইউনিয়ন পরিষদের সমালোচিত প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল লতিফের বিরুদ্ধে অদৃশ্য কারণে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গড়িমসি করছেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। 

আব্দুল লতিফ অবৈধ পন্থায় ভূয়া জন্ম নিবন্ধন, জন্ম ও মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশান সনদ ও কর্মরত ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে কোটি কোটি টাকার নামে মাত্র এবং কাগজে কলমে পাওয়া প্রকল্পের মাধ্যমে গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। তার বিরুদ্ধে অবৈধ জন্মনিবন্ধনের সত্যতা মিললেও দীর্ঘদিনেও মেলেনি প্রশাসনিক কোন ব্যবস্থা। তাতে করে একদিকে শুরু হয়েছে ব্যাপক  আলোচনা-সমালোচনা আবার অন্যদিকে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ। 

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য ও প্রশাসন সূত্র জানায়, বুলবুল চৌধুরী নামের এক ব্যক্তির জন্মনিবন্ধন ব্যবহার করে হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলায় কোটি টাকার জমি বিক্রি করা হয়। ৫২ শতক ওই জমি নিয়ে ওয়ারিশদের আপত্তির পর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জন্মসনদটি ভূয়া এবং এটি ইস্যু করা হয়  ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার কানিহারী ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। 

ভূয়া জন্মনিবন্ধনের তথ্য ঘাঁটতে গিয়ে জানা যায়, গত বছরের ২৪ এপ্রিল বাহুবল উপজেলার পুটিজুরী ইউনিয়নের দক্ষিণ ডুবাঐ গ্রামের বানোয়ারী লাল চৌধরী ও শীলা রানী চৌধুরীর সন্তান পরিচয়ে বুলবুল চৌধুরীর নামে ত্রিশালের কানিহারী ইউপি থেকে একটি অনলাইন জন্মনিবন্ধন নিবন্ধিত হয়। এরপর ওই জন্মনিবন্ধন ও পুটিজুরী ইউপি থেকে দেওয়া ওয়ারিশান সনদপত্রের মাধ্যমে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ৫২ শতক জমি বাহুবল সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দলিলের মাধ্যমে বিক্রি হয়; যার দলির নং-২৯৪৫/২৪। 

বুলবুল চৌধুরীর চাচাতো ভাই হিরক চৌধুরী বলেন, ‘বুলবুল চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে ভারতে অবস্থান করছেন। তিনি ভারতে যাওয়ার পর আর দেশে আসেননি। এখন ভূয়া জন্মনিবন্ধন ও ওয়ারিশান সনদের মাধ্যমে একজনকে বুলবুল চৌধুরী সাজিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। রেজিস্ট্রি দলিলে যে ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা বুলবুল চৌধুরীর নয়। যে জমি বিক্রি করা হয়েছে, তা আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি। আমাদের এই সম্পদ গ্রাস করার জন্য এই মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।’ বিষয়টি প্রশাসনের নজরে এলে ভূয়া জন্ম নিবন্ধন ইস্যুর দায়ে কানিহারী ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল লতিফের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও আইডি কেড়ে নেওয়ার নির্দেশ দিলেও উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের আদেশকে অমান্য করে বহাল তবিয়তে রয়েছেন তিনি। জন্ম নিবন্ধনের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে অবৈধভাবে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তা করে দিয়েছে তা প্রমাণিত হওয়ার পরও উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের আদেশ বাস্তবায়নে বিলম্ব হওয়ায় জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। 

তারা মনে করছেন, যেহেতু আব্দুল লতিফের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও এখনো রয়েছেন বহাল তবিয়তে। তাই প্রমাণিত অভিযোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থেকে বাঁচতে অবৈধ আয়ের মোটা অংকের টাকা খরচ করে তিনি লঘু দন্ডতেই পাড় পেয়ে যেতে পারেন বলে সচেতন মহল মনে করছে।

নিজেকে বাঁচাতে তিনি মোটা অংকের অর্থ খরচ করছেন বলে স্থানীয়রা জানান। সচেতন মহলের দাবি কোনভাবেই যেনো সরকারের দায়িত্বশীল পদে বসে এধরনের অপরাধ করা ব্যক্তিরা দায়মুক্তি না পায়। তারা অপরাধীর কঠোর শাস্তির দাবি জানান।

স্থানীয় সরকার বিভাগ পরিবহন পুলের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার জেনারেল সামিউল ইসলাম রাহাদ স্বাক্ষরিত এক আদেশের মাধ্যমে প্রায় একমাস পূর্বে ত্রিশাল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল বাকিউল বারির কাছে উপজেলার কানিহারী ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল লতিফের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমের আইডি, পাসওয়ার্ড কেড়ে নেওয়া এবং তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ সংবলিত একটি চিঠি প্রেরণ করে।

কানিহারী ইউনিয়নের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আনোয়ার হোসেন ইকবাল জানান, কানিহারী ইউপি সচিব আব্দুল লতিফের বিরুদ্ধে জন্ম নিবন্ধন কেলেংকারির বিষয়টি প্রকাশ্যে থাকলেও অদৃশ্য শক্তির কারণে এর কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি। তাতে করে জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি ও অনলাইন যুগেও দীর্ঘদিন যাবত ভারতে অবস্থানরত দেশের অন্যপ্রান্তে অবস্থান করা ব্যাক্তির নামে আমাদের ইউনিয়ন থেকে সচিবের সহযোগিতায় অবৈধভাবে  জন্মন নিবন্ধন করে দেওয়ার কেলেঙ্কারির মতো অপরাধ করলেও দীর্ঘদিনেও তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

কানিহারী ইউপি প্রশাসক মুশফিকুর রহমান জানান, ‘সচিবের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও আইডি স্থানান্তরে বিষয়ে আমি অবগত নয়। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইডি প্রশাসকই চালাচ্ছেন, আমি এপ্রুভাল দেই। আগের মতোই চলছে।’

এবিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও আব্দুল্লাহ আল বাকিউল বারি বলেন, ‘সচিবের বিরুদ্ধে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ডিডিএলজি স্যার তো বদলি হয়েগেছেন। নতুন যিনি এসেছেন তাঁর সাথে কথা বলে আসবো। 

প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্যই চিঠি দেওয়া হয়েছে, প্রশাসনিক ব্যবস্থাটা হচ্ছে তার আইডিটা চেইঞ্জ করে আরেকজনকে দেওয়া। অর্থাৎ হিসাব সহকারীকে দেওয়া। ওখানে হিসাব সহকারী নাই। হিসাব সহকারী একজন পোস্টিং দেওয়ার জন্যই আমি চিঠি দিয়েছি। 

আদেশের চিঠিতে জন্মনিবন্ধনের আইডি চেইঞ্জ  ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি আলাদা ভাবে উল্লেখ আছে জানালে ইউএনও বলেন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা তো আমি নিতে পারবো না, ওইটা নিতে হবে ডিসি অফিস থেকে। কারণ হচ্ছে যে তাকে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। আমি ওইটার বিষয়েই কথা বলবো। তার বিষয়ে দুইটা ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয় আছে। হয় তাকে এখান থেকে ক্লোজ করতে হবে বা তাকে শোকজ করতে হবে বা বরখাস্ত করতে হবে কিছু একটা করতে হবে। পাশাপাশি তার আইডি এখান থেকে ট্রান্সফার করতে হবে।

এবিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগ ময়মনসিংহের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) লুৎফুন নাহার বলেন, ‘এখানে আমি নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। এবিষয়ে অবগত না। সংশ্লিষ্ট উপজেলা থেকে এবিষয়ে কোন চিঠি এসেছে কি-না তা খোঁজ নেবো’।

স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার জেনারেল সামিউল ইসলাম রাহাদ বলেন, আমরা যে চিঠি দিয়েছিলাম তার এ্যাকশন এখন পর্যন্ত পায়নি। বিষয়টি আপনারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে খোঁজ নেন।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW
আপনার জেলার সংবাদ পড়তে