বাংলাদেশের শিল্প খাত বর্তমানে এক ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। গ্যাস সংকটের মরণ থাবায় দেশের ছোট, মাঝারি এবং বৃহৎ শিল্পকারখানাগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় একদিকে যেমন শিল্প মালিকরা ঋণের ভারে জর্জরিত হচ্ছেন, তেমনি অন্যদিকে শ্রমিক ছাঁটাই, কারখানা বন্ধ এবং বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা হারানোর মতো সমস্যাগুলোও প্রকট হয়ে উঠছে। গ্যাস সংকটের ফলে শিল্প খাতের ক্ষতি বহুমুখী। প্রাকৃতিক গ্যাসের অভাবে সিরামিক, পোশাক এবং স্টিল খাতে উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) এক সেমিনারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন জানান, গ্যাসের অভাবে সিরামিক কারখানায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। পোশাক খাতে উৎপাদন কমেছে ৩০-৩৫ শতাংশ এবং স্টিল খাতে ২৫-৩০ শতাংশ। উৎপাদন কমে যাওয়ায় শিল্প মালিকরা সময়মতো বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার সরবরাহ করতে পারছেন না। এতে ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করছেন, যা রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি, বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা হারানোর কারণে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। গ্যাস সংকটের কারণে কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের বেতন দিতে মালিকরা হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটছে, যা বেকারত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে। গ্যাসের অভাবে অনেক কারখানায় কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ছে। বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, যা ডলারের চাহিদা বাড়িয়ে রিজার্ভ সংকটও তীব্র করছে। সিরামিক শিল্প প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। গ্যাস সংকটের কারণে এই খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের একাধিক কারখানা ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। অপরদিকে, নিটওয়্যার শিল্পে গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা আমদানিনির্ভর রপ্তানি শিল্পে রূপ নিচ্ছে। এতে স্থানীয় ভ্যালু এডিশন কমে যাচ্ছে এবং ডলারের ওপর চাপ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত উদ্যোগ প্রয়োজন। কিছু প্রস্তাবিত সমাধানের মধ্যে রয়েছে, গ্যাস সরবরাহের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্প খাতে গ্যাসের যথাযথ বরাদ্দ নিশ্চিত করা, এবং বিকল্প জ্বালানি উৎসের ব্যবহার বাড়ানো। একইসঙ্গে, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এবং রপ্তানি খাতের আস্থা পুনরুদ্ধারে যথাযথ নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। গ্যাস সংকট সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নিলে, দেশের শিল্প খাতের বিপর্যয় গভীরতর হবে, যা জাতীয় অর্থনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সংকট নিরসনে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।