মহাকাশে লো-আর্থ অরবিটে স্থাপিত উপগ্রহের মাধ্যমে তারহীন ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়াকেই বলা হয় স্যাটেলাইট ইন্টারনেট। ভূপৃষ্ঠের বেশ কাছাকাছি অবস্থান করে এই ধরনের স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক। তবে সেগুলো সব সময় জিওস্টেশনারি নয়। এরূপ কয়েক শ থেকে কয়েক হাজার স্যাটেলাইট একত্র করে তৈরি করা হয় স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক, কনস্টেলেশন নামেও তা পরিচিত।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট যেভাবে কাজ করে
সেবাটি নিয়ে একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে। তা হলো, স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত হলে দেশীয় ইন্টারনেট গেটওয়ে এবং আইন-কানুনকে পাশ কাটানো যায়। আসলে তা নয়। স্যাটেলাইটগুলো শুধু সংযোগের মাধ্যম, ইন্টারনেট সংযোগ অবশ্যই দেশের মূল গেটওয়ের মাধ্যমেই হবে এবং তার নিয়ন্ত্রণ থাকবে সে দেশের রেগুলেটরি সংস্থার হাতে। স্যাটেলাইটগুচ্ছের মধ্যে কিছু উপগ্রহের কাজ ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত ইন্টারনেট গেটওয়ের সঙ্গে ভি-স্যাটের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করা। তারহীন সংযোগের জন্য স্যাটেলাইটগুলো রেডিও ওয়েভ ব্যবহার করে থাকে। বাকি স্যাটেলাইটগুলো একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তৈরি করে মেশ নেটওয়ার্ক। এরপর ব্যবহারকারীরা তাদের স্যাটেলাইট রিসিভার অ্যান্টেনার মাধ্যমে স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করে থাকে। আগে এ ধরনের সংযোগের জন্য বিশাল আকৃতির অ্যান্টেনার প্রয়োজন হলেও বর্তমানের স্যাটেলাইট রিসিভারের আকৃতি খুবই ছোট।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের সমস্যা
স্যাটেলাইট থেকে ভূপৃষ্ঠের দূরত্ব প্রায় ২২ হাজার ৩০০ মাইল। ফলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করলে সিগন্যাল প্রচুর দূরত্ব পেরিয়ে তবেই গেটওয়েতে হাজির হয়। ফলাফল, অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগের চেয়ে স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের লেটেন্সি বা কালক্ষেপণ অনেক বেশি। সেটা অনেক সময় ৫০০ মিলিসেকেন্ড পর্যন্তও হতে পারে।
স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের রক্ষণাবেক্ষণ খরচও অনেক। তাই স্যাটেলাইট ইন্টারনেট উচ্চগতির হলেও লেটেন্সি ও খরচের জন্য ব্যবহারকারীরা ফাইবারের বদলে স্যাটেলাইট ব্যবহারে উৎসাহী হয় না।
সরকারি ভাবনা
বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা প্রদানে ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক আগ্রহী। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশে স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার নীতিমালা চূড়ান্ত করতে তৈরি করা একটি খসড়া গাইডলাইনের ওপর মতামত সংগ্রহ করছে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। সম্প্রতি স্টারলিংকের একটি দল ঢাকায় এসে বিনিয়োগ বোর্ডের সঙ্গে বৈঠক করে গেছে। কয়েক বছর ধরেই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে সেবাদানের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবার লাইসেন্স পেতে হলে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে, জানিয়েছে বিটিআরসি। প্রধান শর্তটি হচ্ছে দেশীয় ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে বা আইআইজি ব্যবহার করতে হবে। মূলত তথ্যপ্রবাহের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে এবং প্রয়োজনীয় নজরদারি ও সেন্সরশিপের ব্যবস্থা যাতে থাকে সে জন্যই নীতিমালায় ধারাটি রাখা হয়েছে। এ ছাড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে জরুরি প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবাও সরকার বন্ধ রাখতে পারবে। তবে সুনির্দিষ্ট, আইনি ও যৌক্তিক কারণ ছাড়া বন্ধ করা যাবে না। এ ছাড়া আরো কিছু সীমাবদ্ধতাও সরকার চূড়ান্ত নীতিমালায় যুক্ত করতে পারে।
কাদের জন্য স্যাটেলাইট ইন্টারনেট
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট মূলত দুর্গম এলাকার জন্যই তৈরি, যেখানে সহজে ফাইবারের মাধ্যমে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক ব্যবহারকারী অবশ্য এলাকায় মানসম্মত ইন্টারনেট সেবা না পেয়েও স্যাটেলাইট সেবায় আগ্রহী হয়। ব্যক্তি পর্যায়ের বাইরে স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের বড় গ্রাহক ইন্টারনেটনির্ভর সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। ফাইবার ইন্টারনেট নানা কারণে ডাউন থাকতে পারে, সেই চিন্তা থেকেই স্যাটেলাইট ইন্টারনেটকে অন্তত ব্যাকআপ সংযোগ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমানে এ ধরনের গ্রাহকের চাহিদা মিটছে মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। তবে ফোরজি বা ফাইভজি ইন্টারনেটের চেয়ে স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের স্পিড বেশি এবং খরচও হবে কম, আশা করছে ব্যবহারকারীরা। বিশেষ করে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারে ব্যান্ডউইডথের সীমাবদ্ধতাকে বড় অন্তরায় মনে করে তারা, যা স্যাটেলাইট সংযোগে থাকবে না।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে স্টারলিংক আনলিমিটেড ব্যবহারের জন্য মাসে ১২০ মার্কিন ডলার চার্জ করে থাকে। চাইলে ৫০ ডলারে ৫০ জিবির প্যাকও কেনা যেতে পারে। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলে মূল্য কত হতে পারে তা এখনো জানা যায়নি। বর্তমানে নাইজেরিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে মাসে সর্বনিম্ন ২৩ ডলারেও সেবা দিচ্ছে স্টারলিংক। হয়তো বাংলাদেশেও এরূপ দাম হতে পারে। তবে ফাইবার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের মূল্যের সঙ্গে তার তুলনা করা যাবে না। স্টারলিংকের পাশাপাশি অন্যান্য সেবাদাতারাও একদিন হয়তো ব্যবসা চালু করবেন, কিন্তু মূল্য খুব বেশি কমার সুযোগ নেই। তাই স্টারলিংক চালু হলেই সবাই ব্রডব্যান্ড বাদ দিয়ে স্টারলিংক কেনার জন্য হুমড়ি খাবে, তা ভাবার কারণ নেই। দুর্গম এলাকার ব্যবহারকারীদের জন্য মূল্য আরো বড় চ্যালেঞ্জ হওয়াই স্বাভাবিক। স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের জন্য প্রয়োজনীয় রিসিভারের মূল্যও কম নয়। স্টারলিংক শুরুতে ৫৯৯ ডলারে রিসিভার বিক্রি করলেও বর্তমানে তা ৩৪৯ ডলারে পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় ৪০ হাজার টাকা মূল্যে শুধু রিসিভার কিনতে হলে অনেক ক্রেতাই আগ্রহ হারাবে।
দেশীয় আইএসপিদের ওপর প্রভাব
শুধু কিছু ব্যাবসায়িক সংযোগের গ্রাহক হারানো ছাড়া স্যাটেলাইট ইন্টারনেটকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন না আইএসপি ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে যেসব দুর্গম স্থানের গ্রাহকরা স্যাটেলাইট সেবা নেবে, তারা এমনিও আইএসপিদের নাগালের বাইরেই ছিল। ভবিষ্যতে যদি কোনো কারণে নীতিমালা পরিবর্তন হয় বা স্যাটেলাইট সেবার খরচ হঠাৎ কমে যায়, তাহলে ব্যাপারটি ভিন্ন। যেমন—দেশের ডিশ ব্যবসার পটভূমি বদলে দিয়েছে স্যাটেলাইট ও এইচডিটিভি সংযোগ।
স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহারে যা লাগবে
ফিক্সড ও রোমিং, দুই ধরনের সংযোগই দিচ্ছে স্টারলিংক। তবে যারা রিসিভার নিয়ে চলার পথে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে ইচ্ছুক তাদের গুনতে হবে বাড়তি ফি। ফিক্সড সংযোগের জন্য রিসিভারটি খোলা আকাশের নিচে বসাতে হবে। সে ক্ষেত্রে বাড়ির ছাদে বা বারান্দা থেকে আকাশের দিকে মুখ করে বসাতে হবে রিসিভার। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে বা সৌরঝড়ের সময় ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হতে পারে, সেটা মাথায় রাখতে হবে। বাসার মধ্যে বা চালের নিচে রিসিভার অ্যান্টেনা বসালে কাজ করবে না।
ভবিষ্যৎ
স্টারলিংক হয়তো দেশের প্রথম স্যাটেলাইট সেবাদানকারী হতে যাচ্ছে, কিন্তু তারাই শেষ নয়। অ্যামাজনের প্রজেক্ট কাইপারও হয়তো স্টারলিংকের হাত ধরে দেশে হাজির হতে পারে। এ ছাড়া দেশীয় উদ্যোক্তাদেরও স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবাদানে এগিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নীতিমালা চূড়ান্তকরণ এবং প্রথম স্যাটেলাইটভিত্তিক আইএসপি চালুর ওপর সবটুকু নির্ভর করছে।