বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধে বন্ড ছাড়তে যাচ্ছে সরকার

এফএনএস এক্সক্লুসিভ: : | প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০৫:১৪ এএম : | আপডেট: ৪ জানুয়ারী, ২০২৫, ১২:৩৯ পিএম
বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধে বন্ড ছাড়তে যাচ্ছে সরকার

বিদ্যুতের বিপুল বকেয়া পরিশোধে বন্ড ছাড়তে যাচ্ছে বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকার। বিগত সরকারও বন্ডের মাধ্যমে বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছিলো। মূলত সরকার বিদ্যুতের বকেয়া মেটাতে এক ঋণ পরিশোধে অন্য ঋণের দ্বারস্থ হচ্ছে। আর এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এ ঋণের বোঝা আরো বাড়বে। কারণ এমনিতেই দেশের ঋণের বোঝা ক্রমাগত বাড়ছে। ঋণ বাড়তে বাড়তে ঋণের ভার এমন পর্যায়ে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে যা পরিশোধ করা কঠিন হবে। বরং রাজস্ব আয় বাড়িয়ে নিজস্ব অর্থায়নের মাধ্যমে বকেয়া বা ঋণ পরিশোধের মতো টেকসই সমাধানই বেশি ফলদায়ক হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দাতা সংস্থা আইএমএফ রাজস্ব আহরণ বাড়িয়ে নিজস্ব অর্থায়নের মাধ্যমে ঋণ বা বকেয়া পরিশোধের পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সক্ষমতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তা কোনো বছরই পূরণ করতে পারে না। এর অন্যতম কারণ প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করের ওপর বেশি নির্ভরশীলতা। সরকারের রাজস্বের ৭০ শতাংশই আসে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও শুল্কের মতো পরোক্ষ খাত থেকে। প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে বাকি ৩০ শতাংশ। আবার প্রত্যক্ষ করের ৮৫ শতাংশই উৎসে কর কর্তন ও অগ্রিম কর থেকে আসে। মূলত কর প্রদানে সক্ষম দেশের মানুষের বড় একটা অংশ করজালের বাইরে থাকায় তাদের কাছ থেকে রিটার্নের ভিত্তিতে আয়কর আহরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া আয়কর আহরণ ও আদায় পদ্ধতি অনেকটা ঝামেলাপূর্ণ হওয়ায় করদাতারাও আয়কর প্রদানে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। ফলে সরকারকে ব্যয় মেটাতে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভর করতে হয়। সূত্র জানায়, কর-জিডিপির অনুপাত বাংলাদেশের এখনো ১০ শতাংশের ঘরে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। এনবিআরের রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জরুরি। মূলত কর-জিডিপি অনুপাত কম থাকার কারণেই সরকার নাগরিকদের পেছনে বেশি অর্থ ব্যয় করতে পারছে না। ফলে বিভিন্ন উৎস থেকে সরকারকে ঋণ করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্ব আহরণ হতাশাজনক। কর-জিডিপি অনুপাতের ক্ষেত্রে একেবারে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। গত এক দশকে কর-জিডিপি অনুপাত না বেড়ে বরং কমে এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সত্ত্বেও রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা ঘোচেনি। কর কর্মকর্তাদের অসীম ক্ষমতা দেয়া হলেও কর ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়েনি। সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক কোটির বেশি মানুষ করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন)। টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়লেও সেভাবে কর আহরণ বাড়েনি। ওই অর্থবছরে টিআইএনধারী প্রায় ৫৯ শতাংশই আয়কর রিটার্ন দাখিল করেনি। অর্থাৎ নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়লেও রিটার্ন জমা দেয়া ব্যক্তির সংখ্যা ওই তুলনায় কম। গত অর্থবছর শেষে দেশে টিআইএন ছিল ১ কোটি ৪ লাখ। আর আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছে মাত্র ৪৩ লাখ। এটি আগের বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি। কমসংখ্যক রিটার্ন জমা দেয়ার জন্য অপর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ ও আইনের প্রয়োগ, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত করদাতা জরিপের অনুপস্থিতি এবং কর প্রশাসনের অটোমেশনের ধীর গতিই দায়ি। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে রাজস্ব আহরণে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে কর ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনার পাশাপাশি কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। কর আহরণে অটোমেশন পদ্ধতি চালুর পাশাপাশি দুর্নীতি কমিয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ কর-জিডিপির অনুপাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যেসব দেশে কর-জিডিপির অনুপাত বেশি সেসব দেশে বিনিয়োগের পরিমাণও বেশি। এদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, বন্ডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি বাবদ বকেয়া পরিশোধের সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি। যে পরিমাণ অর্থ বন্ড হিসেবে ইস্যু করা হবে, সেটি অন্য খাতে বিনিয়োগ করা হলে কর্মসংস্থান তৈরি ও অর্থনীতি আরো গতিশীল হতো। কিন্তু বন্ডের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করায় সরকারের ঋণ না কমে আরো বোঝা বাড়ছে। বন্ড মাধ্যমে বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে সমস্যা সৃষ্টি করবে। তাই সরকারের উচিত রাজস্ব আহরণ বাড়িয়ে নিজস্ব অর্থায়নে ঋণ পরিশোধে উদ্যোগী হওয়া।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW