স্ত্রীর দেনমোহর নিয়ে ইসলামে যা বলে

এফএনএস ধর্ম: : | প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর, ২০২৪, ০৭:০৯ পিএম : | আপডেট: ২৮ নভেম্বর, ২০২৪, ০৭:০৯ পিএম
স্ত্রীর দেনমোহর নিয়ে ইসলামে যা বলে

মহর (مهر‎‎) হল বিয়ের মাধ্যমে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের খাতিরে ইসলাম স্বামীর ওপর যে আর্থিক জিম্মাদারী আরোপ করেছেন তারই নাম দেনমোহর। দেনমোহরের মাধ্যমেই বিবাহ পূর্ণাঙ্গ ও বৈধ হয়। প্রাচীন আরবে যৌতুক দেয়ার প্রথা চালু ছিল, নবুয়াত প্রাপ্তির পর মোহাম্মদ (সা.) এই মোহর আদায় করা স্বামীর অবশ্য পালনীয় কর্তব্য এবং বিয়েতে স্ত্রীর জন্য মোহর নির্ধারণ এবং তাতে নারীর পূর্ণ মালিকানা প্রদান ইসলামি বিধানের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। দেনমোহর বিবাহের সাথে সম্পৃক্ত এক গুরুত্বপূর্ণ হক বা অধিকার। দেনমোহর নারীদের অস্তিত্বের বিনিময় নয়। বরং মানবতা রক্ষার্থে দেনমোহর আদায় করা হয়ে থাকে। কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন আয়াতে দেনমোহরের কথা উল্লেখ রয়েছে। দেনমোহর বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য আবশ্যকীয় করা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন:

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَحْلَلْنَا لَكَ أَزْوَاجَكَ اللَّاتِي آتَيْتَ أُجُورَهُنَّ

হে নবী! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদের আপনি মোহরানা প্রদান করেন।’ (সুরা আহযাব : আয়াত ৫০)

{ وَآتُواْ النَّسَاء صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً فَإِن طِبْنَ لَكُمْ عَن شَيْءٍ مِّنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَّرِيئًا}[النساء: ৪]

‘আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশীমনে। তারা যদি খুশী হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৪) হযরত আয়শা রা. (نِحْلَةً) নিহলার তরজমা (فَرِيضَةً) ফারিজাহ করেছেন। আরেক জন প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ বলেন, আরবী ভাষাতে (نِحْلَةً) শব্দটি ওয়াজিবের অর্থে ব্যবহৃত হয়। এজন্য দেনমোহর ধার্য্য করা এবং তা আদায় করা ওয়াজিব। যদি কেউ দেনমোহর না দেওয়ার শর্তে বিবাহ করে তারপরও মোহরে মিসল (পারিবারিক দেনমোহর) দেওয়া ওয়াজিব হবে। ইমাম মালেক রহ. এর নিকট তো এমন অবস্থায় বিবাহই সংঘঠিত হবে না।

দেনমোহরের পরিমাণ

দেনমোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ দশ দিরহাম। যদি কেউ তার চেয়ে কম দেনমোহর নির্ধারন করে তাহলে তা ধর্তব্য হবে না; বরং দশ দেরহাম ওয়াজিব হবে। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন: দশ দেরহামের চেয়ে কম দেনমোহর নেই। ১০ দিরহাম বর্তমান হিসাবে ৩০ গ্রাম ৬১৮ মিলি গ্রাম হয়। বর্তমান টাকার হিসাবে সর্বনিম্ন দেনমোহরের পরিমাণ ২ হাজার ৮৩৫ টাকা। যদি ১ তোলা রৌপ্যের মূল্য ১ হাজার ৫০ টাকা হয়, তাহলে ৩০ দশমিক ৬১৮ গ্রাম রৌপ্যের মূল্য ২ হাজার ৮৩৫ টাকা। ইমাম মালেক (রহ.) এর নিকট দেনমোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ এক চতুর্থাংশ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) অথবা তিন দিরহাম খাটি রৌপ্যমুদ্রা। এক চতুর্থাংশ দিনার বর্তমান হিসাবে (প্রায় সাড়ে চার মাশা স্বর্ণ) এবং তিন দিরহাম। অর্থাৎ প্রায় ১১ গ্রাম। ইমাম মালেক (রহ.) কিছু হাদিসকে সামনে রেখেই এই মত পেশ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এর নিকট দেনমোহরের কোনো সর্বনিম্ন পরিমাণ নেই। সর্বনিম্ন মূল্যবান জিনিসই তাদের নিকট দেনমোহর হতে পারে। তবে সর্বোচ্চ দেনমোহরের ক্ষেত্রে সকলেই একমত যে, তার কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই। কেননা কুরআনুল কারীমে দেনমোহরের ক্ষেত্রে قِنْطار (ক্বিনতার) শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে। যার অর্থ অনেক সম্পদ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ১২ হাজার দিরহাম অথবা এক হাজার দিনারকে (قِنْطار) বলেছেন। সুতরাং নববী যামানা ও সাহাবিদের যামানাতে অনেক সময় অঢেল পরিমাণে দেনমোহর নির্ধারণ করা হতো। স্বয়ং নবী কারীম (সা.) এর পবিত্র স্ত্রীদের মধ্যে হযরত উম্মে হাবিবাহ (রা.) এর দেনমোহর চার হাজার দিরহাম ধার্য করা হয়েছিল, যা হাবশার বাদশাহ নাজাশী ধার্য করে নিজের পক্ষ থেকে তা আদায়ও করে দিয়ে ছিলেন। এ ব্যাপারে এক ঘটনা উল্লেখযোগ্য, আর তা হল: হযরত উমর রা. দেখলেন যে, লোকেরা আর্থিক স্বচ্ছলতার কারণে অধিক পরিমাণে দেনমোহর ধার্য করা শুরু করেছে, তাই তিনি মনে করলেন যে, দেনমোহরের একটা সর্বোচ্চ পরিমান ধার্য করে দেওয়া দরকার, আর তা ৪০০ দেরহামের চেয়ে বেশি হতে পারবে না। একথা তিনি মিম্বরে উঠে খুতবার মধ্যে উল্লেখ করেন। এরপর যখন তিনি খুতবাহ শেষে মিম্বর থেকে নেমে আসেন তখন এক কুরাইশী নারী বললেন: হে আমিরুল মু’মিনীন! আপনি এটা কিভাবে নির্ধারণ করলেন যে, ৪০০ দেরহামের বেশি দেনমোহর দেওয়া যাবে না? অথচ কুরআনে আল্লাহ তাআলা দেনমোহরের ব্যাপারে قِنْطار (ক্বিনতার) শব্দ উল্লেখ করেছেন, যার অর্থ প্রচুর পরিমাণ। অর্থাৎ তোমরা যত ইচ্ছা পারো দেনমোহর দাও। সুতরাং সেই অধিকারকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবেন না। হযরত উমর (রা.) এর মন নির্দিধায় সত্যকে গ্রহণ করার ছিল। সুতরাং ততক্ষণাৎ তিনি ইরশাদ ফরমান:

فقالَ عُمَرُ -رضي الله عنه-: كُلُّ أَحَدٍ أَفقَهُ مِن عُمَرَ. مَرَّتَينِ أَو ثَلاثًا، ثُمَّ رَجَعَ إِلَى المِنبَرِ فقالَ لِلنّاسِ: إِنِّي كُنتُ نَهَيتُكُم أَن تُغالوا في صَداقِ النِّساءِ، أَلَا فليَفعَلْ )السنن الكبرى للبيهقي ت التركي (১৪/ ৪৮০)

অনুবাদ: আল্লাহ আমাকে মাফ করেন, সকলেই উমরের চেয়ে বড় জ্ঞানী। অতপর তিনি পুনরায় মিম্বরে ওঠেন এবং ফরমান: হে লোকসকল! আমি তোমাদেরকে ৪০০ দেরহামের চেয়ে বেশি দেনমোহর দেওয়া থেকে মানা করেছিলাম, কিন্তু এখন তোমরা যত চাও তোমাদের সম্পদ থেকে দেনমোহর দিতে পার। আল্লাহ তাআলা যখন সাহাবায়ে কেরামকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করেছিলেন এবং তাদের অবস্থা ভালো হয়ে গিয়েছিল তখন তারা অধিক পরিমাণে দেনমোহর ধার্য করতেন। স্বয়ং হযরত উমর (রা.) এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে, যখন তিনি হযরত আলী (রা.) এর কন্যা হযরত উম্মে কুলসুমকে বিবাহ করেন তখন চল্লিশ হাজার দিরহাম দেনমোহর হিসাবে ধার্য করেছিলেন। সম্ভবত তা নববী খান্দানের ইজ্জত এবং সম্মানের জন্য ছিল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) এর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি তার কন্যাদের দেনমোহর এক হাজার দিনার রাখতেন। পরে ১৫০০ দিনারের কথা উল্লেখ রয়েছে। হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) এক নারীকে বিশ হাজার দেনমোহরে বিবাহ করেছেন। হাদীসের শব্দে সাধারণভাবে বিশ হাজারের কথা উল্লেখ রয়েছে। সম্ভবত তার দ্বারা উদ্দ্যেশ্য বিশ হাজার দিরহাম। কিন্তু বেশির থেকে বেশি দেনমোহর রাখা শুধু লোক দেখানো এবং নিজের বড়ত্তের জন্য যেন না হয়, বরং সত্যিকার ভাবে তা স্ত্রীকে দেওয়ার ইচ্ছা থাকে এবং তা আদায় করার মত সামর্থও থাকে; তাহলে বেশি ধার্য করাতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থাতে দেনমোহর এত কম না হওয়া উচিৎ যার কোন গুরুত্বই থাকে না। আবার না এত বেশি পরিমাণ ধার্য করা উচিৎ যা আদায় করা কষ্টকর হয়ে যায় অথবা আদায় করার ইচ্ছাই না থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পবিত্র স্ত্রীদের সাধারণত ৫০০ দিরহাম দেনমোহর ছিল। বেশি গ্রহণযোগ্য অভিমত হল, হযরত ফাতেমা (রা.) এর দেনমোহর ৫০০ দিরহাম ছিল। এজন্য এটাকে মোহরে ফাতেমী বলা হয়। কিছু উলামায়ে কেরাম লিখেছেন যে, ৫০০ দিরহামের বেশি দেনমোহর না হওয়া উচিৎ। ৫০০ দিরহাম বর্তমান বাজারের হিসাব হবে: ১ দিরহাম=৩ দশমিক ৯৭৫ গ্রাম। অতএব ৫০০ দিরহাম ১৪৮৭ দশমিক ৫০ গ্রাম। আমরা জানি, ১১.৩৩ গ্রাম-১ তোলা/ভরি। ১৪৮৭ দশমিক ৫০গ্রাম (৫০০দিরহাম)=১৪৮৭ দশমিক ৫০/১১ দশমিক ৩৩=১৩১ দশমিক ২৮ তোলা/ভরি। সুতরাং বর্তমান বাজারে প্রতি তোলা রুপা ১১০০ টাকা হলে, মোহরে ফাতেমী (১৩১ দশমিক ২৮ তোলা/ভরির) মূল্য হবে= ১ লাখ ৪৪ হাজার ৩৭৮ টাকা। স্বর্ণ ও রৌপ্যের মাধ্যমে দেনমোহর দেনমোহর ধার্যের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উচিত। দেনমোহর এত কম পরিমাণ না হওয়া উচিৎ যার কোন মূল্যই বাকি থাকে না। আবার এত বেশি পরিমাণ হওয়া যাবে না যা স্বামীর জন্য আদায় করা অসম্ভব বা দুষ্কর হয়ে যায়। এজন্য ফুকাহায়ে কেরাম স্ত্রীর পরিবারের অন্য সদস্যদের দেনমোহরের পরিমাণটা সামনে রেখেছেন। অর্থাৎ নারীর পিতার খান্দানের মেয়েদের দেনমোহরের পরিমাণ খেয়াল রাখতে হবে। ফিকহি পরিভাষায় তাকে মোহরে মিসাল বলা হয়ে থাকে। মোহরে মিসাল দ্বারা শুধু পরিমাণ উদ্দ্যেশ নয়, বরং তার মূল্যমানও দেখা হবে। যেমন: বিশ বছর পূর্বে যদি ফুফুর দেনমোহর দশ হাজার টাকা হয়ে থাকে এজন্য বর্তমানেও তার ভাতিজিকে দশ হাজার টাকাই দেনমোহর ধার্য করা হলে তা ইনসাফপূর্ণ কাজ হবে না। কারণ বিশ বছর পূর্বে দশ হাজার টাকা দ্বারা প্রায় দুই ভরি স্বর্ণ ক্রয় করা যেত আর আজকের বাজারে দশ হাজার টাকা দ্বারা আধা ভরিও পাওয়া যাবে না। সুতরাং শুধু মাত্র টাকার পরিমাণ দেখলে হবে না বরং বাজার মূল্যও দেখতে হবে। দু:খের বিষয় হল, আমাদের সমাজে আজ-কাল দেনমোহরের ব্যাপারে অনেক বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি দেখা যায়। এখনো অনেক এলাকাতে ও খান্দানে মাত্র পাঁচ, দশ হাজার টাকা দেনমোহর হিসাবে ধার্য করা হয়ে থাকে। যা মোটেই ঠিক না। আবার অনেক এলাকা এবং খান্দানে লোক দেখানোর জন্য লাখ লাখ টাকা ধরা হয়ে থাকে এবং তা আদায় করার ইচ্ছাও রাখে না। আজকাল যেহেতু কারেন্সির মুল্যের মাঝে স্থিতিশিলতা নেই বরং দিন দিন শুধু চড়া হতে চলছে এবং বিশ বছর পূর্বে পাঁচ হাজার অথবা দশ হাজার টাকার মূল্যায়ন ছিল, কিন্তু আজ এ পরিমাণ টাকা দিয়ে একটি গরিব পরিবারও চলতে পারেনা এবং আমাদের দেশে এ পরিমাণ টাকা কোথাও দেনমোহর হিসাবে দেওয়ার রেওয়াজও নেই; সুতরাং এ পরিস্থিতিতে স্বর্ণ বা রৌপ্যের মাধ্যমে দেনমোহর ধার্য করাই উচিৎ হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর যামানাতে দিনার স্বর্ণের হতো এবং দিরহাম রৌপ্যের হতো। স্বর্ণ ও রৌপ্যের মূল্যের মাঝে এখনো স্থিরতা রয়েছে। ফলে তা নারীদের হকের ক্ষেত্রে ইনসাফের বিষয় হবে। উদাহরণ স্বরুপ, আজ যদি কারো দেনমোহর টাকার পরিবর্তে পাঁচ তোলা স্বর্ণ ধার্য করা হয়, (যার বাজার মূল্য হবে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা)। আর বিশ বছর পর যদি সেই দেনমোহর আদায় করতে চায় তাহলে তাকে সেই পাঁচ তোলা স্বর্ণই আদায় করতে হবে। তখন তার বাজার মূল্য আজকের মূল্য থেকে অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও নারী তার ধার্যকৃত দেনমোহরের সেই পাঁচ তোলা স্বর্ণই পাবে। কিন্তু এর বিপরীত যদি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেনমোহর হিসাবে ধার্য করা হয়, তাহলে বিশ বছর পর যদি তা আদায় করতে চায় তাহলে তার উপর ২ লাখ ৫০ হাজার টাকাই আদায় করা ওয়াজিব হবে। অথচ যেই টাকা দ্বারা তখন দুই তোলা স্বর্ণ ক্রয় করা যেত, আজ সেই টাকা দ্বারা এক আনা স্বর্ণও পাওয়া যাবে না। ফলে নারী এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়াটাই নিশ্চিত এবং এটা তাদের সঙ্গে বেইনসাফি করা হবে। এক তো তাদের দেনমোহরকে সময়মত আদায় করা হয়নি, দ্বিতীয়ত যখন আদায় করতে যাচ্ছে তখন তার মূল্য আগের তুলনায় খুব কম। সুতরাং এ ব্যাপারে ‘ইসলামী ফিকহা একাডেমি ইন্ডিয়া’ ১৯৮৯ সালে এক ফিকহী সেমিনারের আয়োজন করে এবং নিম্নের বিষয়গুলো পাশ করা হয়: দেনমোহর স্বর্ণ এবং রৌপ্যের মাধ্যমে দেওয়া উচিৎ, যাতে করে নারীদের হকসমূহ পরিপূর্ণভাবে আদায় হয় এবং মুদ্রার মূল্যের ঘাটতির কারণে যেন নারীদের হকসমূহ নষ্ট না করা হয়। 

দেনমোহর-স্বামীর কাছে এক প্রকার ঋণ

এ কথা মনে রাখা দরকার যে, দেনমোহরও স্বামীর উপর অন্যান্য ঋণের ন্যায় এক প্রকার ঋণ। এজন্য সঠিক নিয়ম হল, বিবাহের সময়ই দেনমোহর আদায় করা। সাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তী যামানাতে বিবাহের সময়ই দেনমোহর আদায় করার প্রচলন ছিল। যদি পুরা দেনমোহর আদায় না করতে পারত তারপরও বিবাহের সময় কিছু দেনমোহর আদায় করত। এ বিষয়টি আরবের ইসলামী সমাজে এত মজবুত ভাবে পালনীয় ছিল যে, ফুকাহায়ে কেরাম লিখেছেন: যদি কোন নারীর বিবাহ হওয়ার পর এমন দাবী করে যে, আমার স্বামীর সাথে মিলন হয়েছে কিন্তু সে দেনমোহর আদায় করেনি, তাহলে তার এ দাবিটি বিশ্বাসযোগ্য ছিলনা। কারণ তা সমাজ ও পরিবেশে প্রচলিত আমলের বিপরিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত আমাদের এই উপমহাদেশে (ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে) বিবাহের সময় দেনমোহর আদায় করার কোন প্রচলন নেই। এখনতো অবস্থা এতোই খারাপ যে, যদি কেউ বিবাহের সময় দেনমোহর আদায় করে তাহেল সবাই মনে করে যে, স্বামীর মনে হয় তালাক দেওয়ার ইচ্ছা আছে!।

দেনমোহর আদায় করার নিয়ত যদি না থাকে

অনেক সময়তো দেনমোহর আদায় করার নিয়তই থাকে না। শুধু নামে মাত্র দেনমোহর ধার্য্য করা হয়ে থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন: যে বিবাহ করল এবং দেনমোহর শুধু ধার্য্য করল কিন্তু তার অন্তরে দেনমোহর আদায় করার নিয়ত নেই, তাহলে আল্লাহর দরবারে তাকে যিনাকারী হিসাবে গণ্য করা হবে। (নাউযুবিল্লাহ)

مَا مِنْ رَجُلٍ يَنْكِحُ امْرَأَةً بِصَدَاقٍ، وَلَيْسَ فِي نَفْسِهِ أَنْ يُؤَدِّيَهُ إِلَيْهَا إِلَّا كَانَ عِنْدَ اللَّهِ زَانِيًا،) مصنف عبد الرزاق الصنعاني (৬/ ১৮৫)

অন্য হাদিসে আছে যে, সে স্ত্রীর সাথে ধোকা বাজী করেছে, এজন্য সে কিয়ামতের দিন একজন যিনাকারী হয়ে উঠবে। কোন কোন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণে তাকে অনেক যুলুম নির্যাতন করতে থাকে, যাতে করে স্ত্রী নিজেই দেনমোহর মাফ করতে বাধ্য হয়ে নিজেই চলে যায়। এটা খুবই নিম্ন স্বভাবের ও কলঙ্কময় কাজ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন: আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে খারাপ লোক ঐ ব্যক্তি, যে কোন নারীকে বিবাহ করে এবং তার প্রয়োজনকে পুরা করে তালাক দিয়ে দেয়, অথচ তার দেনমোহরও আদায় করে না। এজন্য পুরোপুরি ঋণ মনে করে বিবাহের সময়ই তা আদায় করার নিয়ত রাখা উচিৎ, কেননা যখন কোন ব্যক্তি তার ওপর ঋণকে আদায় করার নিয়ত করে তাহলে আল্লাহ তাআলা তার দিকে সাহায্যের হাতকে প্রসারিত করে দেন। খোদা না করুন, যদি তালাকের পরিস্থিতি সামনে আসে তাহলে দেনমোহর আদায় করা থেকে বাঁচার জন্য বাহানা খোঁজা ঠিক না। বরং দেনমোহর ছাড়া আরো কিছু অতিরিক্ত দিয়ে স্ত্রীকে সসম্মানে বিদায় দেওয়া উচিৎ। যাকে কুরআনে ‘মাতাউন’ বলা হয়েছে। ফুকাহায়ে কেরাম লিখেছেন যে, কোন নারী যদি তার স্বামীর কাছে খুলআ কামনা করে, আর তা স্বামীর যুলুম ও নির্যাতনের কারণে হয়ে থাকে, তাহলে সে অবস্থাতেও স্বামীর জন্য দেনমোহরকে মাফ করানোর বাহানা করা একটি অপছন্দনীয় কাজ। যদি নারীর ত্রুটির কারণে তালাকের পরিস্থিতি সামনে আসে, তাহলে দেনমোহর পরিমাণ ফেরত নেয়া অথবা মাফ করা জায়েজ আছে। এমনকি যদি দেনমোহর বিবাহের সময়ই আদায় করে থাকে তাহলে উত্তম হল সেই অবস্থাতেই রাখা। দেনমোহরের পরিমাণের চেয়ে বেশি আদায় করা মাকরুহ। 

ত্যাজ্য সম্পত্তি থেকে আগে দেনমোহর আদায় করা

যদি কোন কারণে স্বামী জীবদ্দশাতে দেনমোহর আদায় না করতে পারে, তাহলে অনেক এলাকাতে মৃত্যুর পর স্ত্রী থেকে দেনমোহরকে মাফ করানো হয়ে থাকে। কখনো এমন হয় যে, নারীর সামনে লাশ রেখে স্ত্রীকে জোরপূর্বক বলা হয়ে থাকে যে, তোমার প্রাপ্য দেনমোহরকে মাফ করে দাও। সেই সময় নারী অনেক দুঃখ এবং ভারাক্রান্ত অবস্থায় থাকে, এমন অবস্থায় যদিও মন থেকে মাফ করতে না চায় তারপরও লোকমুখে লজ্জা-শরমের কারনে মাফ না করে উপায় থাকেনা। এমনটা করা অনেক ঘৃণিত ও শরীয়তের খেলাফ কাজ। শরীয়তের উসূল বা পন্থা হল, যদি কোন ব্যক্তি ইন্তেকাল করে তাহলে প্রথমে তার ত্যাজ্য সম্পত্তি থেকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এরপর ওয়ারিশদের মাঝে বন্টন করা হবে। সুতরাং যেমনিভাবে অন্যান্য ঋণ আদায় করা ওয়াজিব এবং তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হতে হবে, তেমনিভাবে দেনমোহরও এক প্রকার ঋণ এবং তার ব্যাপারেও আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসিত হবে। এজন্য দেনমোহর মাফ করানোর কোন অর্থই হয় না। সুতরাং অন্যান্য ঋণের ন্যায় স্ত্রীর ঋণও পরিশোধ করতে হবে। এরপর যা অবশিষ্ঠ থাকবে তা ওয়ারিশদের মাঝে বন্টন করা হবে।


0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW