কষ্ট কবুল করে, ত্যাগ স্বীকার করে হলেও জীবনে সৎ থাকতে হবে। সততার আলাদা সুঘ্রাণ আছে। ন্যায়পরায়ণের ভিন্ন রকম শক্তি ও সম্মান আছে। একই অফিসে কর্মরত সমকক্ষ সহকর্মীর অনেক খাত থেকে বৈধ-অবৈধ আয় অথচ আপনার সম্বল শুধু বেতন- এতে আপনার জীবন ও জীবিকা পরীক্ষাধীন হবে, তবে জীবনে বরকত থাকবে। অবৈধ পথের আয়ে মানুষের অভিশাপ লেগে থাকে, স্রষ্টার লানত মেখে থাকে। সুতরাং অন্যায় পথে উপার্জিত অর্থ দিয়ে জীবনে কখনোই সুখী হতে পারবেন না। আপনার যে আয়ের টাকায় বাবা-মায়ের ওষুধ কেনেন, যে টাকা দিয়ে সন্তানের জন্য দুধ ক্রয় করেন সেই টাকা হারাম- আপনি এর পরিণাম ভাবতে পারছেন? অবৈধ অর্থের ব্যবহারে সম্পদ মানুষ হবে না বরং বিপথে যাবেই। সেই সন্তান অসম্মান-অপমানের শুরুটা আপনার থেকেই আরম্ভ করবে। ঘুষ-দুর্নীতির অর্থে খুব ভালো পোশাক পরিধান করলেন, চমৎকার আবাসনের ব্যবস্থাও হলো, তেলে-ঝালের চমৎকারিত্বে খেলেন কিংবা সম্পদের পাহাড় গড়লেন! এরপরেও নিরাপদ জীবনের আশা করছেন? এর সবকিছু আপনার জন্য বোঝা হবে, বিষ হবে। অন্যায়ভাবে উপার্জিত সম্পদ সর্বপ্রথম মানুষের মস্তিষ্কে দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে এবং কেড়ে নেয় ঘুম। নরম বিছানায় শুয়েও ঘুমের দেখা পেলেন না, জীবদ্দশাতেই সব মজাদার খাবার আপনার শরীরের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেল- টাকাপয়সা দিয়ে কী হবে? সম্পদ কতদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারবে? বাহিরে চাকচিক্যের জীবনযাপন করেন অথচ দাম্পত্যে সম্পর্ক নাই, বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে আগেই কিংবা সন্তান বেপরোয়া জীবন যাপন করছে- এখনো কী জীবনের সফলতা সম্পদ দিয়ে মাপবেন? বুড়ো বয়সে যদি জেলের ভাত খাওয়ার দুশ্চিন্তা করতে হয়, চেনাজানা সব লোকে আপনাকে বাজে মানুষ হিসেবে চেনে তবে সেই জীবনকে সুন্দর বলার সুযোগ নাই। এর চেয়ে মেথর-মজুরের জীবন অনেক বেশি উৎকৃষ্ট। অনেক বেশি সম্মানের। আপনি এমন কোনো অন্যায় করতে পারেন না, যে অন্যায়ে অন্যকেউ কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বান্দার হক ঠকালে, রাষ্ট্রীয় আমানত নষ্ট করলে খোদাও আপনাকে ক্ষমা করার সুযোগ নিজের কাছে রাখেননি। অবৈধভাবে ফাইল আটকিয়ে, জমিজমা দখল করে দুনিয়াতে যাদেরকে সীমাহীন দুর্ভোগ-কষ্ট দিয়েছেন, তারা আপনাকে আপনা-আপনি ক্ষমা করে দেবে- মানুষকে এতো মহান ভাববেন না। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিতদের চেয়ে কথিত শিক্ষিত নাগরিকরা রাষ্ট্রের বেশি ক্ষতি করছে। শিক্ষিত বেকারের চেয়ে অসৎ চাকুরিজীবী, নীতিহীন ব্যবসায়ী এবং আদর্শহীন, দেশপ্রেমহীন মুখোশধারী অসভ্য রাজনীতিবিদরা সমাজ-রাষ্ট্রের ভিত নড়বড়ে করে দিচ্ছে। আপনি আপনার পরিচিতজনদের মধ্য থেকে, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পদ-পদবীধারীদের থেকে বেছে বেছে সৎ মানুষগুলোকে আলাদা করতে পারবেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, সমাজে সততার চর্চাকারীর সংখ্যা নেহায়েত কম। অনেকেই চাকুরিকে, রাজনৈতিক পদপদবীকে এবং ক্ষমতাকে অবৈধ পথে সম্পদের পাহাড় গড়ার লাইসেন্স মনে করছে। সম্পদ জমা করার প্রবৃত্তি দেখে মনে হয় তারা দেশকে ইজারা নিয়েছে। আবার তাদের অনেকেই কুনীতি-দুর্নীতি করে এবং অন্যায়কে সমর্থন দিয়েও আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে পাড় পেয়ে যাচ্ছে। তবে আশার কথা, দুনিয়ার চোখ এড়ানো যায় কিন্তু আখেরাতের দাঁড়িপাল্লা ন্যায্যতার প্রতীক। আমাদের পরিবার, আত্মীয়স্বজন কিংবা সমাজের মধ্যে যারা বিত্তশালী তাদের কয়জন কেবল বেতনের টাকায় চলছে? রাষ্ট্র নির্ধারিত বেতনের টাকা দিয়ে, নীতি সমর্থিত ব্যবসার মুনাফা দিয়ে কত সম্পদ গড়া সম্ভব? অথচ কেউ চাকুরির মধ্যযুগে, কেউ সামান্য ব্যবসা করে কিংবা কেউ ছোটখাট নেতা হয়ে শত-হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়েছে। বৈধভাবে আয় করে অন্তত সরকারি চাকুরিজীবীদের অনেককিছু করার সুযোগ নাই। ছেলে-মেয়ে পড়াশুনা করিয়ে, ডাল-ভাতে খেয়ে এবং সাদামাটা পোশাকাদিতে সহজ-সরল জীবনযাপনে জিন্দেগি কাটানোর কথা। অথচ কতজনের কতকিছু দেখা যায়। কোন কোন সাংবাদিক-সম্পাদক নাকি শতকোটি টাকার মালিক! খবর লিখে, খবর বেচে এতো টাকা হতে পারে? যাতে তারাই খবরের শিরোনাম হয়! এতো এতো অসৎ লোকের মাঝেও সৎ-সজ্জন আছে। সাদামাটা পোশাক, সহজ-সরল জীবনযাপন দেখে তাদেরকে আমরা চিনতে পারি। তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয়। সিস্টেমের মূল থেকে পচে যাওয়ার কারণে সৎ-সততার আদর-কদর খুব কম। সৎ ঘুষ দিতে পারে না বলে পদোন্নতি-পদায়ন আটকে থাকে কিংবা কাঙ্ক্ষিত আঙিনা পায় না। সৎ ঘুষ দিতে পারে না বলে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা দাঁড় করাতে পারে না। সৎ খুশি করতে পারে না বলে দলীয় পদ-পদবীতে নাম ওঠে না। এভাবে সৎ মানুষগুলো জীবনের গল্পে পিছিয়ে পড়ে। সৎদের পিছিয়ে পড়া মানে রাষ্ট্রের পিছিয়ে যাওয়া। সৎ মানুষ কারো জন্য অন্যায় সুপারিশ করে না বলে আত্মীয়-স্বজনও তাদেরকে চোখে দেখতে পারে না, ভালো জানে না। যারা সৎ এবং বেতনে চলে তারা অনুষ্ঠান-আয়োজনে মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে পারে না বলে আয়োজকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না এবং সমাজ তাদের সম্পর্কে জানতেও পারে না। যে যত অসৎ তার দম্ভব তত বেশি। ক্ষমতায় নগর-বন্দর কাঁপে! অথচ ঘটনা উল্টো ঘটার কথা ছিল। কিন্তু প্রথা-রীতি মিথ্যান্ধদের করায়ত্তে যাওয়ার পরে সৎ পদানত এবং অসৎ সিংহ শাবকের মত সমাজে বুক চিতিয়ে চলছে। একে ওকে হুমকি দিচ্ছে। আইন-আদালত তাদের কাছে নস্যি! নিয়ম শৃঙ্খলা তারা তৈরি করে। কেউ তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে কণ্ঠনালি আহত করে। প্রকাশ্যে কিছু করতে না পারলেও কাগজের হয়রানিতে জীবন বিষিয়ে তোলে। সমাজে সৎরা বিচ্ছিন্ন। অসৎসরা সব ঐক্যবদ্ধ। কাণ্ড দেখে মনে হয়, “উলোট-পালট করে দে মা লুটেপুটে খাই”- কবি মনে হয় এদের কথা ভেবেই লিখেছিলেন। তবে কী সমাজ এভাবেই চলবে? আমি আশাবাদীদের দলে। এই সমাজ বদলাবে। ইতোমধ্যে বদলের কিঞ্চিৎ হাওয়া বইতে শুরু করেছে বটে। রাতারাতি সিস্টেম বদলাবে না। নাগরিক সচেতনতা, সরকারের কঠোরতার মাধ্যমে সমাজের অসৎ জঞ্জালদের দমিয়ে দেওয়া সম্ভব! ভাবতে পারেন- একজন লোকের বেতন ৫০ হাজার টাকা অথচ তার মাসিক খরচ দুইলাখ টাকা! অর্থ আসে কোথা থেকে? এদের সংখ্যা এক দু’জন বরং নয় বহু-বিস্তর। এদের সম্পদ জড়ো করলে বাংলাদেশের অর্ধেক সম্পদের সমপরিমাণ হবে! দাম বাড়ানোর জন্য যে দেশের বাজার থেকে বোতলজাত সয়াবিন হাওয়া হয়ে যায় সেদেশের ভাগ্য রাতারাতি বদলাবে- অন্তত সে আশা করছি না। তবে সৎ মানুষদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। নিজে অসততার কাছে আত্মসমর্পণ করবো না- একজন ভালো মানুষের কেবল এটাই একমাত্র দায়িত্ব নয় বরং আরও দু’জন মানুষের অসৎ কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে বাধ্য করবো। একজন তৃতীয় সারির নেতা হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে, একজন পানি বহনকারী কর্মচারী ৪০০ কোটি টাকা কামাই করলে কিংবা একজন ড্রাইভার ডজন ডজন ফ্ল্যাটের মালিক হলে সেদেশের প্রথম ও দ্বিতীয় সারির নেতাদের ঝোলায় কত সম্পদ গিলেছে? সব পেশাতেই ভালো মানুষ আছে কিন্তু মন্দের লাইনটাই তো লম্বা দেখছি। ব্যবসায়ীদের একাংশ সিন্ডিকেট গড়ছে, কেউ কেউ কোটি কোটি ডলার বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে- যেভাবে চলছে তাতে এই দেশের মেরুদন্ড কতদিন সোজা থাকবে? এলিটদের মধ্যে যারা বলে বাংলাদেশের কোন ভবিষ্যৎ নাই তাদের সম্পদের খোঁজ সবার আগে করা দরকার। সরকার সম্পদ বিবরণী থেকে তাদের ফাইলগুলো সবার আগে আলাদা করুক! রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিয়ে সৎ মানুষদেরকে পুরস্কৃত করতে হবে। সততার পৃষ্ঠপোষকতা করলে রাষ্ট্রটি অচিরেই ঘুরে দাঁড়াবে। কোন থানায় একজন সৎ ওসি নিয়োগ পাওয়া মানে ওই থানাধীন নাগরিকদের জীবনে ন্যায্যতা নিশ্চিত হওয়া। অফিস প্রধান যদি সৎ মানুষ হন তবে সে অফিসের দুর্নীতি নিম্নগামী হতে বাধ্য। রাষ্ট্র থেকে ঘুষ-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি-সুপারিশ দূর করতে পারলে এই দেশের চেহারা বদলাতে এক সিজনও লাগবে না। আয়বহির্ভূত সম্পদের তালাশ করে দোষী সাব্যস্ত হলে তৎক্ষণাৎ ডিসমিস করে দিলে অনেকগুলো রোগ এই এক চিকিৎসায় সারবে। প্রতিটি দপ্তরে, কার্যালয়ে একটি দুর্নীতি বিরোধী সেল প্রতিষ্ঠা করা দরকার। যারা গোপনে নির্দিষ্ট দপ্তরে দুর্নীতির তথ্য দেবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত অফিস দিয়ে বিস্তৃত করতে হবে এবং দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। রাষ্ট্র থেকে শুধু দুর্নীতি দূর করতে পারলে এই দেশের অনেকগুলো রোগ চিকিৎসাবিহীনভাবে ভালো হয়ে যাবে। দুর্নীতি কমালে বেকারত্বের চাপ থাকবে না। চাকুরি কিংবা ব্যবসা, পদ কিংবা ক্ষমতা যাতে কারো অবৈধ কাজ কিংবা অবৈধ আয়ের লাইসেন্স না হয়- সে ব্যাপারে রাষ্ট্র, সচেতন নাগরিক সমাজকে সচেতন থাকতে হবে। এই বাংলাদেশ বৈষম্যহীন হলে আমাদের আগামী প্রজন্মের মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিজয়ের মাসে আশা করছি, এই বাংলাদেশ যাতে বারবার না হারে- সেটার নিশ্চয়তা রাষ্ট্র আমাদেরকে দেবে। অসৎ-দুর্নীতিবাজকে শক্ত হাতে দমন করাই হোক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংস্কারের প্রথম ধাপ এবং প্রধান প্রায়োরিটি।
লেখক : রাজু আহমেদ; প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট