‘বিজয় বাংলাদেশ’ স্লোগানমুখর পৃথিবী চাই

মোমিন মেহেদী : | প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০৩:১৬ এএম : | আপডেট: ১৯ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৭:৩৭ পিএম
‘বিজয় বাংলাদেশ’ স্লোগানমুখর পৃথিবী চাই
মোমিন মেহেদী

বিশ্বে অর্থনৈতিক মানচিত্রে দুইটি তত্ত্ব দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতিষ্ঠিত। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র। নানা কারণে এখন আর সমাজতন্ত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নেই। পুঁজিবাদ বিরাজ করছে পৃথিবী জুড়ে। সেই পুঁজিবাদ আজ নানা সংকট ও প্রশ্নের সম্মুখীন। বিশ্বের ধনবাদী দেশগুলো এখন আর সনাতন পুঁজিবাদে সন্তুষ্ট নয়। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধানের চিন্তা আমেরিকা, রাশিয়া, চীন বা ভারতের মত পরাশক্তিগুলো লালন করবে কি না, তা এখন নিবিড়ভাবে দেখবে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের মানুষ। যাদের রাজধানী বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহরের তালিকা আছে চলতি মাসেও, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল হয়নি ৫ আগস্টের বিপ্লবের প্রায় ৪ মাসেও, দুর্নীতিও থামেনি, বরং প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে চলছে ছাত্র-যুব-জনতার ভোগান্তি বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। বিজয়ের এই মাসে সকল সংকট কাটুক বাংলাদেশের। সেই সাথে সততার পথ ধরে ৩ শূণ্যের পৃথিবীর পথ ধরে এগিয়ে চলুক সকল স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। আমার জানা মতে, ‘থ্রি-জিরো তত্ত্ব’ আর্থিক স্বাধীনতা, কর্মঠ জনশক্তি তৈরি এবং পরিবেশ উন্নয়নে বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকর একটি মডেল। এটি একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সেগুলো হলো-জিরো দারিদ্র্য, জিরো বেকারত্ব ও জিরো নেট কার্বন নিঃসরণ। আর তা অর্জনে প্রয়োজন তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসা। গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক ড. ইউনূস বিশ্বজুড়ে আলাদা সম্মান পেয়েছেন তার এই থ্রি-জিরো তত্ত্বের জন্য। এসডিজির লক্ষ্যগুলোর মূল পরিকল্পনায় রয়েছে-সবার জন্য কল্যাণকর পৃথিবী এবং টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণ। গণমাধ্যমে থ্রি-জিরো তত্ত্বের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বায়ক ও সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ বলেছেন, আমরা এসডিজির সঙ্গে থ্রি-জিরো তত্ত্ব যুক্ত করার চেষ্টা করছি। এসডিজির ওপর সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে আমাদের একটি কর্মশালা চলছে, সেখানে এই তত্ত্বের বিষয়ে আলোচনা করছি। আমরা চাই টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে সব পর্যায়ে থ্রি-জিরো তত্ত্বের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি হোক। এসডিজির লক্ষ্য পূরণের কার্যক্রমের মধ্যে থ্রি-জিরো তত্ত্ব রাখা হয়েছে, তবে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস কারোর ওপর এই তত্ত্বের প্রয়োগ চাপিয়ে দিতে চান না। আমাদের উদ্দেশ্য হলো-যার ভালো লাগবে তিনি এটি গ্রহণ করবেন এবং কাজে লাগাবেন। এ কারণে এসডিজির বাইরে সরকারের কোনো বড় পর্যায়ে থ্রি-জিরো তত্ত্ব নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। থ্রি-জিরো তত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো-দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা। এই তত্ত্বের ব্যাপারে অধ্যাপক ড. ইউনূসের ভাষ্য হলো- বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিজেই দারিদ্র্য সৃষ্টি করে এবং এই ব্যবস্থার অধীনে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব নয়। মানুষ এককভাবে দারিদ্র্য তৈরি করে না, আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতরেই তৈরি হয় দারিদ্র। তার মতে, ভালো চাকরি না খুঁজে উদ্যোক্তা তৈরিতে জোর দিতে হবে। তিনি বিভিন্ন সময় তার বক্তব্যে বলেছেন, আমরা জন্মেছি সমস্যা সমাধানের জন্য, কারও অধীনে চাকরি করার জন্য নয়। তাই তরুণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হতে হবে। কারও অধীনে নয়, বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে হবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই। সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে বাসযোগ্য নিরাপদ পৃথিবী ও নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে ‘থ্রি-জিরো’ তত্ত্বকে বৃহৎ পরিসরে তুলে ধরেছেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি সম্মেলনে নিজের ভাষণে এই তত্ত্ব উপস্থাপন করে বলেছেন, এটি এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেবে। গড়ে তুলবে এক নতুন পৃথিবী, যা সবার জন্য বাসযোগ্য হবে। এখন কথা হলো- জিরো দারিদ্র্য (তবৎড় চড়াবৎঃু), জিরো বেকারত্ব (তবৎড় টহবসঢ়ষড়ুসবহঃ) ,ও জিরো নেট কার্বন নিঃসরণ (তবৎড় ঘবঃ ঈধৎনড়হ ঊসরংংরড়হ)। আর তা অর্জনে লাগবে তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসা। টেকসই উন্নয়নের এই তত্ত্বের প্রয়োগের মাধ্যমেই তিনি অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে এগিয়ে নিতে চাইছেন বলে আমি মনে করি। গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আর এই অবদানের জন্য তিনি শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন ২০০৬ সালে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াও গোটা বিশ্বেরই চোখ টেকসই উন্নয়নে। আর এই লক্ষ্য অর্জনে সামনে থাকছে তাঁর নিজের তত্ত্ব থ্রি-জিরো। এক্ষেত্রে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ। আমনের ধানশালিক, কিষান-কিষানি, নদী-নালা ও তরুপল্লবে ঘেরা বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বিশ্বনন্দিত নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনকে ঘিরে তিন ‘শূন্য’ তত্ত্বের অবতারণা করেছেন এবং এরই হাত ধরে নব বিশ্ব গড়ার পথ সুগম হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। ড. ইউনূসের থ্রি জিরো তত্ত্বের ভিত্তিতে এমন নিরন্তর এগিয়ে চলা লোভ-মোহহীন এগিয়ে চলাকে স্বাগত জানাচ্ছি। সেই বলতে চাই- শূন্যের অনেক রকমের অর্থ আছে। সূক্ষ্মতার আড়ালে সবকিছুতেই শূন্য; আবার শূন্যেই সবকিছু (তবৎড় রহ ঊাবৎুঃযরহম ্ ঊাবৎুঃযরহম রহ তবৎড়) এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বস্তুর ভর (গধংং) কেন্দ্র করে মহাকর্ষ ও অভিকর্ষের আওতায় প্রায় বস্তুর আকৃতি গোলাকার এবং গণিতের সার্থক অঙ্ক নয় থেকে ০ মোট অঙ্ক ১০টি। এদিকে শূন্য মাধ্যমে শব্দের বেগ- ০ (শূন্য); পৃথিবীর কেন্দ্রে বস্তুর ওজন- ০ (শূন্য) নিউটন; পৃথিবীর কেন্দ্রে অভিকর্ষজ ত্বরণ (এ) এর মান-০ (শূন্য); লন্ডনের গ্রিনিচ মান মন্দির- ০ ডিগ্রি দ্রাঘিমায় অবস্থিত এবং এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর সময় হিসাব করা হয়। তাছাড়া এখান থেকে পূর্বদিকে গেলে যোগ এবং পশ্চিমে গেলে সময় বিয়োগ হবে; পৃথিবীর পরম তাপমাত্রা হচ্ছে- ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২৭৩ শ (কেলভিন); বরফের গলনাঙ্ক সেলসিয়াস স্কেলে শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড: পরম তাপমাত্রায় গ্যাসের আয়তন- ০ (শূন্য); কম্পিউটারের আই, কিউ হচ্ছে- ০ (শূন্য); মূল মধ্যরেখার মান ০ (শূন্য); আদর্শ গ্যাসের অভ্যন্তরীণ শক্তি- ০ (শূন্য); নিরক্ষরেখার অক্ষাংশ- ০ (শূন্য ডিগ্রি); দুটি সন্তান জন্মের অর্থ হলো প্রকারান্তরে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার- ০ (শূন্য); ভূ-পৃষ্ঠের বিভব শক্তি-০ (শূন্য); আদর্শ ট্রান্সফর্মারের ক্ষরণ- ০ (শূন্য) এবং সমবেগ চলমান বস্তুর ত্বরণ- ০ (শূন্য)। আসলে শূন্যের মহত্ত্ব অনেক, যা বলে শেষ করা যাবে না। ইতিহাসে স্বর্ণালি অক্ষরে লেখা আছে যে, ২০১৫ সালে ২৮ মে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সামাজিক ব্যবসা দিবস উদ্যাপনকালে প্রধান বক্তার বক্তৃতায় ড. ইউনূস শূন্য তত্ত্ব তুলে ধরেন। ২০১৭ সালে প্রকাশিত অ ডড়ৎষফ ড়ভ ঞযৎবব তবৎড়ং নামক গ্রন্থে তিনি পৃথিবীর তিনটি বড় চ্যালেঞ্জের সমাধানের ব্যাপারে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি সালে (২০২৪) ২৭’ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ভাষণে শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস থ্রি জিরোস নিয়ে কথা বলেন। তাছাড়া ১৩ নভেম্বর (২০২৪) জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে নতুন বিশ্ব গড়তে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ ২৯) ‘থ্রি জিরোস’ তত্ত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ‘থ্রি জিরো’ বা ‘তিন শূন্য’ তত্ত্ব একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আড়ালে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে নতুন বিশ্ব গড়তে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আর এই তত্ত্বের মাধ্যমে ড. মুহাম্মদ ইউনুস একটি সমতাভিত্তিক ও স্থিতিশীল অবনীর ধারণা তুলে ধরেছেন, যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশগত সুরক্ষা যুগপৎ একই ধারায় চলবে। এই তত্ত্বে যে তিনটি প্যারামিটার আদলে অগ্রগামী হবে, তা হলো (১) শূন্য দারিদ্র্য (তবৎড় চড়াবৎঃু), (২) শূন্য নিট বেকারত্ব (তবৎড় টহবসঢ়ষড়ুসবহঃ) এবং (৩) শূন্য কার্বন নির্গমন (তবৎড় ঘবঃ ঈধৎনড়হ ঊসরংংরড়হং)। একথাও সত্য যে, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বদ্ধপরিকর। আর তার থ্রি জিরো তত্ত্বের ধারণা বাংলাদেশ তরুণদের ক্ষমতায়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে কৃষি খাতে একটি বিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। সত্যি কথা বলতে কি, টেকসই উন্নয়নের সব সূচকে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে থ্রি জিরো সম্পূরক অনুঘটন হিসেবে ভূমিকা রাখবে। তিনি যেখানে যাচ্ছেন, সেখানেই এই তত্ত্বের স্লোগান মুখ্যরূপে তুলে ধরছেন। তার প্রমাণ সর্বশেষ কপ সম্মেলনে তিনি থ্রি জিরোর তত্ত্ব তুলে ধরে দিয়েছেন। আলোর কথা-ভালোর কথা হলো- বিশ্বজুড়ে অন্তত ৪ হাজার ৬০০টি থ্রি জিরো ক্লাব রয়েছে, যার সবগুলোই ড. ইউনূসের থ্রি জিরো স্বপ্নের আদলে সংগঠিত। এই তত্ত্বের জনক ড. ইউনূস উল্লেখ করেন যে, এই থ্রি জিরো বাস্তবায়নের জন্য চারটি প্রপঞ্চ বা নিয়ামক আবশ্যক; যা হলো ১. তরুণদের শক্তি এবং সৃজনশীলতাকে কাজে লাগানো, ২. প্রযুক্তির শক্তি ব্যবহার, ৩. ব্যবসাকে সামাজিক ব্যবসায় রূপান্তর, ৪. সুশাসন নিশ্চিত করা। এই চিন্তার পথ ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে চলবে ‘বিজয় বাংলাদেশ’ শ্লোগানের মধ্য দিয়ে... 

লেখক : মোমিন মেহেদী; চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি 


0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW