বাংলার মাটির গন্ধে যে খাবারের ঘ্রাণ মিশে আছে, তার নাম ‘মাছ-ভাত’। প্রাচীনকাল থেকেই এই ভূখণ্ডের মানুষ নদী থেকে মাছ ধরে, খেতের ধান থেকে ভাত রেঁধে খেয়ে বড় হয়েছে। তাই বাঙালির খাদ্য পরিচয়ে সবচেয়ে বড় জায়গা জুড়ে ‘মাছে-ভাতে’ বাঙালি শব্দবন্ধটি।
কিন্তু সেই ঐতিহ্য যখন ব্যবসায়িক মোড়কে বদলে যায়, তখনই শুরু হয় বিতর্ক। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে নববর্ষ মানেই যেন ‘পান্তা-ইলিশ’! হোটেল-রেস্তোরাঁর প্যাকেজ থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ার হ্যাশট্যাগÑসবখানে জায়গা করে নিয়েছে এই যুগল।
ইলিশের কদর, কিন্তু পান্তার সাথেই?
পান্তা ভাত বাঙালির চিরচেনা সকাল। গরমে সারা রাত পানিতে ভিজিয়ে রাখা ভাত, সঙ্গে একটু নোনা লবণ, কাঁচা মরিচ আর একটা পিঁয়াজÑযার সরলতায় ছিল প্রশান্তি। আর ইলিশ? বর্ষায় গৃহস্থের পাতের রাজা। এই দুইয়ের মিলন কখনও ঐতিহ্য হয়ে উঠেছিল কি? ইতিহাসবিদদের মতে, না। এটি মোটেই লোকজ ঐতিহ্য নয়। বরং সাম্প্রতিক সময়ের চটকদার উদ্ভাবন।
বাজারে আগুন, তবু থামেনি কেনা-বেচা
এ বছরও ইলিশের দাম আকাশছোঁয়াÑএক কেজি ইলিশ ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকার মধ্যে। তবু আগ্রহ কমেনি। ব্যবসায়ীরা এই সময়ে সবচেয়ে বেশি লাভ করে। রেস্টুরেন্টগুলো সাজিয়ে ফেলে পান্তা-ইলিশ উৎসব। কেউ কেউ বলেন, “পান্তার সঙ্গে ইলিশ নয়, ইলিশের নামে ‘পকেট কাটার’ উৎসব চলছে।”
ফিরছে মূলধারা, জায়গা নিচ্ছে সত্যিকারের উৎসব
এবার নববর্ষে একটু অন্য চিত্রও দেখা গেছে। ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহরগুলোতে অনেক আয়োজক পান্তা-ইলিশকে উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু না বানিয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন গ্রামীণ খেলাধুলা, নাচ-গান, লোকসংগীত, পালা-পার্বণ ইত্যাদিতে। সংস্কৃতিকর্মীদের অনেকেই বলছেন, “নববর্ষ মানে শুধু খাওয়াদাওয়া নয়, বরং আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরার দিন।”
পান্তা-ইলিশ: চলবে, কিন্তু আলোচনার কেন্দ্রে নয়
বলা যায়, পান্তা-ইলিশ এখন একটা সাংস্কৃতিক অভ্যাসে পরিণত হলেও সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। কেউ বলছেনÑএটা আমাদের রুচির অধঃপতন, কেউ বলছেনÑএটা সময়ের দাবি। তবে যাই হোক না কেন, ইলিশের প্রতি বাঙালির আবেগ কখনো কমবে না।
শেষকথা
নববর্ষ মানেই যেন এক নতুন সূর্য, নতুন শুরু। পান্তা থাকুক, ইলিশও থাকুকÑতবে এগুলোর বাইরে গিয়ে আমরা যেন আমাদের শিকড়, আমাদের নিজস্বতাকে চিনে নিই। কারণ বাঙালিয়ানা কেবল এক থালার খাবারে নয়Ñতা ছড়িয়ে আছে আমাদের গান, ভাষা, পোশাক, আচার আর আপন মাটির গন্ধে।