আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠ নেয়ামত গুলোর মধ্যে মধু অন্যতম। মধু পানে অনেক রোগ বালাই থেকে উপসম পাওয়া যায়। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরানেও মধুর উল্লেখ রয়েছে। মৌমাছি বিভিন্ন প্রকার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে আর মৌচাষীরা মানুষের সেবনের জন্য সেই মধু আহরণ করে থাকে। আহরণকৃত এই মৌচাষীদের মধ্যে মৌচাষ করে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছেন সোনারগাঁয়ের মোঃ শাহজাহান সরকার।
শাহজাহান সরকার ১৯৫০ সালে ১১ ফেব্রুয়ারী সোনারগাঁ পৌরসভাধীন হরিসপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম মৃত শমসের আলী এবং মাতা আয়মন নেছা। পাঁচ ভাই, দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। ইচ্ছা থাকার পরও টানাপোরনের সংসারে ৮ম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি তার। এরপর তিনি তার বৃদ্ধ বাবাকে সহযোগীতা করার জন্য জুট মিলে চাকুরী নেন।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে দেশকে শত্রু মুক্ত করতে ১৯৭১ সালে দেশ মাতৃকার টানে মহান মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহন করেন যুবক শাহজাহান সরকার।
এক পর্যায়ে শখের বসে যুবক শাহজাহান ও তার স্ত্রী বিবি হাওয়াকে নিয়ে ১৯৯৪ সালে বিসিক থেকে প্রশিক্ষন গ্রহন করে এপিস সেরেনা জাতের ২ টি মৌবাক্স নিয়ে মৌচাষের পথচলা শুরু করেন। সংসারের সব কাজকর্ম শেষে তার স্ত্রী তাকে মৌচাষের সকল কাজে সহযোগীতা করতে থাকেন। আস্তে আস্তে শাহজাহান দম্পত্তি মৌচাষকে পেশা হিসেবে গ্রহন করে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এপিস সেরেনা জাত দিয়ে মৌচাষ করেন। এরপর স্বামী স্ত্রী দু’জনই ১৯৯৮ সালে বিসিক থেকে এপিস মেলিফেরা জাতের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন এবং ৪ টি মৌকলোনী নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে মৌচাষ শুরু করেন। এক বছরের মধ্যেই শাহজাহান তার জ্ঞান, মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে ৪ টি মৌকলোনী থেকে ১৬ টিতে উন্নীত করতে সক্ষম হন। এদিকে শাহজাহান সরকারের চাষকৃত মধু চারিদিকে বেশ সুনাম অর্জন করে এবং বিক্রিও বৃদ্ধি পেতে থাকে। শাহজাহান সরকারের ২ ছেলে ২ মেয়ের মধ্যে ২০০৪ সালে তিনি তার ২ ছেলে ওমর ফারুক ও মোঃ শাহীনকে মৌচাষে সম্পৃক্ত করেন। ২০১৭ সালে ভারত থেকে গ্রাফটিং ও প্যাথলজির উপর প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। বিভিন্ন সময় মৌখামারে রোগ বালাই দেখা দিলে অনেক বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। বিশেষ করে মৌমাছির ডার্থ পিরিয়ডে বিভিন্ন রোগ বালাই এবং খাবার ঘাটতির কারনে মৌমাছি আশংকাজনক ভাবে কমে যেত।
এব্যাপারে শাহজাহান সরকার তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউ-েশন ( পিকেএসএফ ) এর অর্থায়নে বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ফর সোস্যাল এডভান্সমেন্ট ( বাসা ) সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন টেকসই মৌচাষ উন্নয়ন এবং মধু বিপণনের মাধ্যমে মৌচাষীদের আয়বৃদ্ধিকরন শীর্ষক ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। তাদের প্রশিক্ষনে উন্নত পদ্ধতিতে মৌকলোনী ম্যানেজমেন্ট, রাণী উৎপাদন, পোলেন উৎপাদন, রয়েল জেলী উৎপাদন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় শিখতে পেরেছেন। এছাড়াও অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরের মাধ্যমে ডার্থ পিরিয়ডে মৌমাছির খাদ্যের উৎস সরিজমিনে দেখে আসেন এবং বিভিন্ন কর্মশালায় অংশগ্রহন করেন। তিনি জানান, উন্নত পদ্ধতিতে রাণী উৎপাদন, ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি কার্যক্রম করে তার খামারের মধু উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ডার্থ পিরিয়ডে বাসা সংস্থা কর্তৃক দেয়া খাদ্য রেসিপি মৌমাছিকে খাওয়ানোর ফলে এবং বিভিন্ন সব্জি এলাকায় মৌখামার রেখে মৌমাছি ঘাটতির পরিমান কমেছে।
মোঃ শাহজাহান সরকার বিএসটিআই থেকে অনুমোদন নিয়ে নিজ নামে ব্র্যান্ডিং করে মধু বিক্রি করছেন। বর্তমানে তার ৪০০ টি মৌকলোনী রয়েছে। মধু বিক্রির টাকায় সারা বছর সংসারের খরচ চালিয়ে কমপক্ষে তিনি চার লাখ টাকা আয় করে থাকেন।
তিনি জানান, আমাদের দেশের চাষকৃত মধুর গুনাগুন অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ভাল, তাই সবাইকে দেশীয় মধু পান করে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার দাবী জানান।