মোর (আমার) সউক (সব) নদীত সব ভাসি নিয়া গেইছে বাহে (বাবা)। মোর ঘরের আটকাবার (বাচাতে) কিছুই পাই নাই। খালি (শুধু) ছাওয়া পোওয়া (ছেলে মেয়ে) আর জীবনটা নিয়া কোন মতে (কোন রকমে) পারত উঠছি বাহে। হামরা এ্যালা (আমরা এখন) কোনটে থাকমো বাহে। হামার থাকির (থাকার) আর কোন জায়গা নাই। এ ভাবেই কান্নাজড়িত কন্ঠে কথা গুলো বলছিলেন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার পাটিকাপাড়া ইউনিয়নের পুর্ব হলদিবাড়ি গ্রামে রহমত আলী স্ত্রী ছকিনা বেগম (৩৫)।
একই গ্রামের হাসিনা বেওয়া (৬০) তিস্তা নদীতে ঘর বাড়ি হারিয়ে পারুলিয়া তিস্তা নদীর ঘাটে ত্রানের আশায় ঘুরছিলেন, বন্যার সংবাদ সংগ্রহে ওই এলাকায় গেলে ত্রান দেয়ার নাম লেখার লোক ভেবে তিনি দৌড়ে কাছে এসে বলে উঠেন, বাবা মোর ঘরটাও নদীত ভাসি গেইছে। একন্যা দয়াকরি মোর নামটাও নেখেন। মুই একেবারে নিঃস্ব হইছোং (হইছি), মুই এ্যালা খুব অসহায় বাবা।
তিস্তা ও ধরলার নদীর পানি কমার সাথেই সাথেই দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ভাঙ্গন। গত পাঁচ দিনে তিস্তা ও ধরলার ভাঙ্গনে ৫ শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ভয়াবহ ভাঙ্গনের আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তিস্তা ও ধরলা পাড়ের হাজারও মানুষ। পরিবার গুলো গৃহহীন হয়ে বাধের রাস্তা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে আশ্রয় নিয়ে বর্তমানে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে।
এদিকে কয়েক দিনের পানি বৃদ্ধির ফলে তিস্তার ভাঙ্গনে বসতভিটা-ফসলী জমি বিলীন হয়ে নিঃস্ব ও সর্বশান্ত হয়ে পড়ছে নদী তীরবর্তী মানুষ। মাথা গোঁজার মতো এক টুকরো জমি না থাকায় ভাঙনকবলিতরা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের একমাত্র পাকাসড়কটি পানির তোড়ে ভেঙ্গে গিয়ে পাঁচ দিন ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছেন।
গত কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানিতে লালমনিরহাটের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়ে। জেলার সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি কোন ভাবেই উন্নতি হচ্ছে না। জেলার ৫টি উপজেলার ২০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়ছে মানুষ। বন্যা কবলিতদের জন্য কোথাও কোথাও সরকারি ত্রাণ সহায়তা শুরু হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অত্যান্ত অপ্রতুল। অধিকাংশ বানভাসি মানুষের ভাগ্যেই জুটছে না সেই সরকারী ত্রান সামগ্রী। তারপরেও বানভাসি মানুষ গুলো সামান্য ত্রানের জন্য রাস্তার তাকিয়ে থাকে কখন সরকারী লোকজন তাদের জন্য ত্রান নিয়ে আসবে।
বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) দুপুরে পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে তিস্তা নদীর তীরবর্তী আদিতমারী ও হাতীবান্ধা উপজেলার এক হাজার বন্যার্ত পরিবারগুলোর মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন। পানি বন্দি মানুষ গুলোর কথা চিন্তা করে জেলা পুলিশ আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের ৪০০টি পরিবার, হাতীবান্ধা উপজেলার গডিাডমারী ইউনিয়নের ৩০০টি পরিবার, শিংগীমারী ইউনিয়নের ১৫০ টি এবং সিন্ধুর্ণা ইউনিয়নের ১৫০ টি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রত্যেককে ৫ কেজি চাল, ২ কেজি বিশুদ্ধ পানি, আধা কেজি মুড়ি ও ৫ প্যাকেট বিস্কুট ত্রাণ দেন।
হাতীবান্ধা উপজেলার পাটিকাপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম হলদিবাড়ি গ্রামের নয়ারহাট নামে একটি বাজার মঙ্গলবার রাতে তিস্তা নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে।
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার জোংড়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের আঞ্চলিক সড়কে অবস্থিত সেতুরটির সংযোগ সড়ক ধসে যাওয়ায় প্রায় ২০ হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।
স্থানীয় বাসীন্দরা জানান, গত সোমবার রাতে পার্শ্ববর্তী ধরলা নদীর বন্যার পানির চাপে (তোড়ে) সেতুটির সংযোগ সড়কটি একেবারে ধসে যায়। এর ফলে সেতুটির পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকে ধবলগুড়ি, নন্দেরঘাট, ডাঙ্গাপাড়া, বড়ভিটা, মন্ডলেরটারী, মন্দিরপাড়া গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েন। ওই সব গ্রামের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতে সমস্যায় পড়েছে। কৃষক ও ব্যবসায়ীরা তাদের কৃষি পণ্য নৌকায় করে পারাপার করছে।
জোংড়া ন্যাশনাল উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী হামিদা আক্তার জুঁই ও লিপছি আক্তার বলেন, সেতুর সংযোগ সড়কটি ভেঙ্গে যাওয়ায় বিদ্যালয়ে যাতায়াতে আমাদের সমস্যা হচ্ছে। আজ বেশ কয়েকদিন আমরা বিদ্যালয়ে যেতে পারি নাই। অনেকে জীবনের ঝুকি নিয়ে নৌকায় যাতায়াত করছে।
জোংড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফ আলী বন্যা কবলিত মানুষের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘ ভেঙ্গে যাওয়া সেতুটির সংযোগ রাস্তাটি দিয়ে মানুষের চলাচলের জন্য দ্রুত বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করে দেওয়া হবে।’ যাতে করে লোকজন ওই বাঁশের সাকো দিয়ে চলাচল করতে পারে।
পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল করিম জানান, ‘বন্যায় সেতু সংযোগের রাস্তা ভেঙ্গে যাওয়া ও স্থানীয় লোকজনের সমস্যার কথা জানতে পেরে ঘটনাস্থল ঘুরে এসেছি। রাস্তাটি দ্রুত মেরামত করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং উপজেলা প্রকৌশলীর সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’