মাথার উপর উতপ্ত দুপুরের রোদ খেলা করছে। তারই মধ্য লালটুকটুকে ফতুয়া,পায়জামা, মাথায় লাল টুপি পড়ে এবং লাল রংয়ের সাইকেল সহ এক মধ্য বয়স্ক ব্যক্তিকে দেখা গেলো স্কুল পড়-য়া শিক্ষার্থীদের মাঝে টিফিনের সময় লিফলেট বিতরণ করতে। কাছে গিয়ে দেখা গেল, লোকটির পরিহিত ফতুয়ার পিছনের অংশে বড় বড় করে লেখা আছে “ হতে চাইনা বিয়ের পাত্রী, হতে চাই স্কুলের ছাত্রী”। সামনের অংশে লেখা “বাল্য বিবাহ বন্ধ করুন”। এসব দেখে আগ্রহ জন্মে এই প্রতিবেদকের। প্রশ্ন করতেই একের পর এক উত্তর আসতে থাকলো। জানা গেল, লোকটির নাম আনোয়ার হোসেন তালুকদার। সে বগুড়া জেলার সদর উপজেলার নিশিন্দারা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত বারপুর উত্তরপাড়া গ্রামের মৃত আবদুল বারী’র পুত্র।তিনি পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রী।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে তার এই জনসচেতনতা মূলক প্রচারের আগ্রহের কারণ জানতে চাইলে বাইসাইকেল নিয়ে সমগ্র বাংলাদেশ ভ্রমনকারী আনোয়ার জানান, “আমার পরিবার বাল্যবিবাহের কুফলের ভুক্তভোগী। আমার বোন এর বাল্যবিাহ দেওয়ার কারণে অকালে আমার বোনকে হারিয়েছি। এরপর থেকেই মাথায় ঘুরতো কিভাবে বাল্যবিবাহের কুফল সবার সামনে তুলে ধরবো। আমার এই যাত্রার শুরু ২০১৫ সালে। যখন সারাদেশে হরতাল আর অবরোধ চলছিলো। আমার এই প্রস্তাবনা আমার এলাকার এক স্থানীয় সাংবাদিককে জানালে তিনি আমাকে নিয়ে তৎকালীন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহানা আখতার জাহান এবং পরে জেলা প্রশাসক শফিকুর রেজা বিশ^াস এর কাছে নিয়ে যান। তারা আমার কথা শুনে আগগ্রহ প্রকাশ করেন এবং আমার এই জনসচেতনতামূলক সফর এর সফলতা কামনা করে অনুমতি প্রদান করেন।
সেই সময় সারা দেশ জুড়ে শৈতপ্রবাহ ও হরতাল অবরোধ হওয়ায় পরিস্থিতি অনুকুলে ছিলো না। অনেকে আমাকে নিরাশও করেছে। কেউবা বলেছিলো পাগল। তবুও আমি হতাশ না হয়ে আমার লক্ষ্যে ছিলাম অটল। আমি ১টি কম্বল,বাইসাইকেল, শুকনো খাবার ও কিছু টাকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। এইভাবেই ৬৭ টি দিনে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় লিফলেট বিতরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভ্রমণ সম্পন্ন করি। যা সেইসময় বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা সহ স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফায় আমি বাংলাদেশের সকল উপজেলায় গিয়ে এই প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত নেই। বর্তমানে আমি ২০৪টি উপজেলায় ইতোমধ্যে প্রচার অভিযান সম্পন্ন করেছি”।
তার সমগ্র বাংলাদেশ বাই সাইকেল নিয়ে ভ্রমনের সত্যতা জানতে চাইলে তিনি কিছু কাগজ এর পৃষ্ঠা বের করেন। তাতে বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট, উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাদের সিলমোহর যুক্ত প্রশংসাপত্র দেখা যায়। সমাজ, জাঁতি তথা দেশের এই দায়বদ্ধতা থেকে তার এই প্রচার অভিযানের সফলতা কামনা করে লিখিত মন্তব্য করেছেন অনেকেই। আহবান জানিয়েছেন আনোয়ারের মত সচেতন হয়ে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমাজের জন্য কিছু করার।
তার এই প্রচার অভিযান কতটুকু প্রশা›িত এনে দিয়েছে এমন প্রশ্নে আনোয়ার জানান,“ আমি মানুষ হিসাবে ও সমাজের দায়বদ্ধতা থেকে বিবেকের তাড়নায় যেটুকু করেছি তাতে আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই। আমার সমাজ, জাঁতি তথা দেশের জন্য আরো কিছু করা উচিত। আমার এই বাল্যবিবাহের কুফল জানিয়ে প্রচারের ফলে যদি একটি বাল্যবিবাহ বন্ধ হয় তাহলেই আমার সার্থকতা। তবে আমার মত সমাজের সকলকেই এই ব্যাপারে স্ব স্ব অবস্থান থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই একটি মেয়ের জীবন বাঁচবে, কমবে বাল্যবিবাহের প্রবণতা, বাবা মা হারাবেনা তাদের ভালবাসার কন্যাকে আর কোন ভাই হারাবেনা তার আদরের বোন কে”।