আমরা এখন আর স্বামীর কাছ থেকে কোন টাকা নিই না। প্রতিদিন বা সপ্তাহে কম্পোষ্ট সার বিক্রি করে যা আয় হয় তা সংসারের কাজে লাগাই। সংসারে কোন কিছু কিনতে গেলে আমরা নিজেরাই কিনে থাকি। ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ, জমি লিজ কিংবা বাড়ি তৈরিতে আমরা টাকা দিয়ে সহযোগিতা করছি। এমন কথা আশার কথাগুলো বলছিলেন কালীগঞ্জ উপজেলার দাপনা গ্রামের রেবেকা বেগম, সুখজান বেগম, রিজিয়া বেগম। জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ৪ নং নিয়ামতপুর ইউনিয়নের দাপনা গ্রামের রেবেকা সুখজান,সোনভান,নাজমা, শাহনাজ,শাহিদার মতো প্রায় ১০০ নারী আজ কম্পোস্ট ও কেচো উৎপাদনের সাথে জড়িত। এই গ্রামে ১০৫ পরিবারের মধ্যে ১০০ পরিবারের নারীই এই পেশায় জড়িত হয়ে পড়েছেন। বাড়ির অন্যান্য কাজের পাশাপাশি তারা এই কাজ করে আজ একেক জন এক একটি উদ্যোক্তা হয়েছেন। প্রত্যেকের বাড়িতেই রয়েছে পাকা হাউজ কিংবা মাটির চাড়ি। প্রতিদিন এই গ্রাম থেকে কয়েকশ মন উন্নত মানের কম্পোষ্ট সার চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থান। ইতোমধ্যে এই গ্রাম কে কেচো আর কম্পোষ্টের গ্রাম হিসেবেও পরিচিত লাভ করেছে।
ইতিমধ্যে খুলনা বিভাগীয় কমিশনারসহ সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তা,বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের শিক্ষার্থীরা এই গ্রাম পরিদর্শন করেছেন। অন্য আর একটি গ্রামের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার দাপনা গ্রাম।এই গ্রাম এখন কেঁচো আর কম্পোস্ট সারের গ্রামে পরিণত হয়েছে। শতভাগ বাড়িতে এখন সার উৎপাদন হচ্ছে। গ্রামের ১০৫ ঘর পরিবার এখন আর রাসায়নিক সার ব্যবহার করে না। নিজেদের উৎপাদিত পরিবেশ বান্ধন কম্পোস্ট সার দিয়েই জমিতে চাষাবাদ করছে। এই গ্রাম থেকে প্রতি মাসে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকার সার ও ৫ লাখ টাকা পরিমানের কেচো উৎপাদন করছে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে এখানকার কম্পোস্ট সার সৌদি আরব, দুবাইসহ মধ্যপ্রায্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হচ্ছে। আর এই কাজটি যারা করছে তারা সবাই গৃহিনী। বাড়ির প্রয়োজনীয় কাজের শেষে তারা বাড়তি কাজ হিসেবে এই কাজটি করছে। এই কাজে তাদের সহযোগীতা করেছেন জাপান ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড ও উপজেলা কৃষি অফিস।
ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার পূর্বের গ্রাম দাপনা। এই গ্রামের নারীরা খুবই কর্মট। প্রত্যেকের বাড়িতেই ২ থেকে ৫টি পর্যন্ত গরু আছে। তারা তাদের গরুর গোবর কাজে লাগিয়ে সার তৈরি করছে। যে সার পরিবেশ বান্ধব। এই গ্রামে শতভাগ বাড়িতে কম্পোস্ট প্লান্ট বানাতে পরামর্শ সহযোগীতা দিয়ে সহযোগীতা করেছেন রেবেকা, সুখজান,শাহনাজ ও সোনাভান নামের ৫ জন নারী। তারা প্রথম পর্যায়ে হাঙ্গার ফ্রি ওয়াল্ডের কাছ থেকে প্রশিক্ষন ও আর্থিক সহযোগীতায় এই কাজ শুরু করেন। এরপর সারা গ্রাম। রেবেকার ঘরের মধ্যে, রান্নাঘরে, বারান্দায়,গোয়ালঘরে, বাড়ির পরিত্যক্ত জায়গায় কাচা,পাকা বেশ কয়েকটি কম্পোস্ট প্লান্ট তৈরি করেছেন।একই গ্রামের আতিয়ারের স্ত্রী শাহনাজ, মশিয়ারের স্ত্রী সোনাভান,শওকতের স্ত্রী সুখজান, কুদ্দুসের স্ত্রী হাজেরা বেগম, জিল্লু রহমানের স্ত্রী আহরনসহ ১০০টি পরিবারের সকল গৃহিনীরা তাদের বাড়িতে কেউ মাটির রিং স্লাব, কেউ বা পাকা করে কম্পোস্ট প্লান্ট তৈরি করেছে। প্রতি মাসেই তাদের প্লাট থেকে সার উৎপাদন হচ্ছে। তারা উৎপাদিত কম্পোস্ট সার নিজেদের জমিতে ব্যবহার করে বাকিটুকু বিক্রি করছে। দেশের যশোর, চুয়াডাঙ্গা,মেহেরপুর, সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লার ব্যবসায়ীরা এখান থেকে ট্রাক ভরে সার ও কেচো ক্রয় করে নিয়ে গিয়ে পরে সেগুলো প্যাকেটিং করে মধ্যপ্রাচ্যোর দুবাই,সৌদিআরবসহ বিভিন্ন দেশে বিক্রি করছে। কেচো কম্পোস্ট সার বিশেষ করে ধান, পান চাষী, সবজী জাতীয় চাষাবাদে বেশি উপকার পাচ্ছে।
কৃষানী সুখজান ও তার বৌমা রিজিয়া বেগম জানান, শ্বাশুড়ি -বৌমা মিলে তারা কম্পোষ্ট প্লান্ট তৈরি করেছেন। তাদের বাড়িতে প্রায় ৩শ মাটির চাড়ি রয়েছে। এখান থেকে প্রতি মাসে ৩০-৩৫ মন সার উৎপাদন হচ্ছে। প্রতি কেজি সার ৮-১০টাকায় তারা বিক্রি করেন। এবং এক কেজি কেচো বিক্রি করেন ১ হাজার টাকায়। তারা বলেন, কেচো কম্পোস্ট সার উৎপাদন করতে বেশি টাকা খরচ হয় না। দরকার আগ্রহ। গরুর গোবর, লতাপাতা,কলাগাছ আর কেচো এই দিয়েই প্রতি তিন মাস অন্তর সার উৎপাদন করা হয়। এই সারের গুনগত মানও ভাল। যশোর মৃত্তিকা গবেষণা কেন্দ্রে তারা এ জৈব সার পরীক্ষা করে দেখেছেন বাজারের যে সব টিএসপি পাওয়া যায় তার মান ৪৫% অন্যদিকে কম্পোস্ট সার বা অর্গানিক সারের মান ৮৫%(সার্বিক)।
কৃষানী রেবেকা জানান, এই গ্রামের গৃহীনিরা সকলেই এই কাজে জড়িত। তারা পরিবারের বিভিন্ন কাজে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করছেন। অনেকে কেচো সার বিক্রি করে বাড়ি তৈরি করেছেন। কেউ বা তৈরি করেছেন পাকা ল্রাট্রিন। আবার কেউ মাঠে জমি বর্গা বা লিজ নিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার সার বিক্রি করে থাকি।গৃহিনী সোনাভান জানান, আমাদের স্বপ্ন আর যেন কেউ রাসায়নিক সার ব্যবহার করে জমি গুলো নষ্ট না করে। আমরা সারা বাংলাদেশকে দেখিয়ে দিতে চাই নিজেদের তৈরি সার জমিতে ব্যবহার করেই স্বাবলম্বী হওয়া যায়। তিনি আরো জানান, আমাদের স্বামীরা আমাদের অনেক সহযোগীতা করে। এই গ্রামের প্রত্যেক নারীর হাত খরচ, চিকিৎসার টাকা স্বামীদের কাছ থেকে নিতে হয় না। বরং আমরা আরো স্বামীদের টাকা দিই। আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা হল এই সারগুলো নিজেরাই প্যাকেট জাত করে মার্কেটে ছাড়া। এর জন্য প্যাকেটিং মেশিন দরকার এবং সরকারের সহযোগীতা প্রয়োজন।
সেন্টার ফর সাসটেনেবল লাইফলিহুড (সিএসএল)এর ইনচার্জ এস এম শাহীন হোসেন জানান,তারা ২০০৩ সাল থেকে নিয়ামতপুর ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য নারীদের প্রশিক্ষন দিয়ে আসছি। ইতোমধ্যে এই ইউনিয়নের কয়েকশ নারী জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে এবং নিজেদের বাড়িতে কম্পোস্ট সার উৎপাদন করে নিজেদের জমিতে দিচ্ছে এবং অতিরিক্ত টুকু বিক্রি করে সংসারের প্রয়োজনে কাজে লাগাচ্ছে। তিনি বলেন এই গ্রামে আনোয়ারা ও রোবেকা নামের দুই নারী জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়াও ৪ জন নারী জৈব পদ্ধিতে চাষাবাদের জন্য হাঙ্গার ফ্রি প্রাইজ পেয়েছেন।
নিয়ামতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাজু আহমেদ রনি জানান, দাপনা গ্রামের নারীরা যে উদ্যোগ গ্রহন করেছে তাতে খুব শীঘ্রই এই গ্রামে দারুন পরিবর্তন আসবে। আমি দারুন খুশি আমার ইউনিয়নের একটি গ্রামের নারীরা এতদুর এগিয়েছে। তাদের যে কোন প্রয়োজনে আমি তাদের পাশে আছি এবং থাকবো।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল করিম জানান, কম্পোস্ট সার পরিবেশ বান্ধব। এই সার জমিতে পরিমানে বেশি লাগে তবে ফসল ভাল হয়। এই গ্রামেরকৃষানীরা যে নিজেদের উৎপাদিত সার জমিতে ব্যবহার করছে এটা ভাল উদ্যোগ। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ঐ গ্রামের নারীদের সার্বিক পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে।