দিগন্ত জোড়া পাকা বোরো ফসলের মাঠ। ফলনও হয়েছে আশাতীত কিন্তু ধানের বাজার মূল্য উৎপাদন খরচের অর্ধেক হওয়ায় মহাবিপাকে পরেছেন চাষী। মাঠজুড়ে উঠতি পাকা ধান কাল বৈশাখীর সাথে বৃষ্টির আশঙ্কা আর ধানের মূল্য কম থাকায় ধান কাটতে শ্রমিকের অনীহায় শ্রমিক সংকটের কারণে দিশেহারা হয়ে পরেছে বরিশাল জেলার বোরো চাষিরা।
আগৈলঝাড়া উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ওই উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে নয় হাজার ছয়শ’ ছয় হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হলেও বিভিন্ন সড়ক উন্ন্য়ন কাজের জন্য সেচ বিঘœ হওয়ায় ১৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ কম হয়েছে। প্রতি হেক্টরে সাত দশমিক পাঁচ মেট্টিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে ক্রপ কাটিং করে দেখা গেছে। এতে প্রতি হেক্টরে পাঁচ মেট্টিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে।
প্রাকৃতিকভাবে বৃষ্টির পানিতে ইউরিয়ার আধিক্য থাকায় বাম্পার ফলন হলেও কিছু জমিতে ব্যাকটেরিয়াল লিপ ব্রাইট বা পাতা মরা রোগ (বিএলবি) দেখা দিয়েছিলো। এতে অন্তত পাঁচ হেক্টর জমি আক্রান্ত হলেও কৃষি অফিসের পরামর্শে চাষীদের গৃহীত ব্যবস্থায় তার ক্ষতি থেকে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন কৃষকরা। সব কিছুর পরেও চলতি মৌসুমে বাম্পার ফলন ফলেছে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, ফসলের বাম্পার ফলন হলেও উৎপাদিত ধানের বাজার মূল্য কম হওয়ায় ধান কাটার শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে কৃষকরা তাদের ক্ষেতের পাকা ধান ঘরে তুলতে পারছেন না। বাজার ব্যবস্থার মনিটরিং না থাকায় কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। ধানের দাম কমতে থাকায় ক্রমান্বয়ে জমির মুল মালিকরা ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। নির্ভর হয়ে পরছে বর্গা চাষির ওপর। ক্ষুদ্র ও বর্গা চাষিরা মৌসুমের শুরুতেই মহাজনদের কাছ থেকে দাদনের টাকা নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। ফসল বিক্রির পর তাদের দাদনের টাকা পরিশোধ করার কথা। বর্তমানে ফসলের বাজার মূল্য অত্যন্ত কম হওয়ায় ওই ফসল বিক্রি করে দাদনের টাকা পরিশোধে মহাচিন্তায় পরেছেন বর্গাচাষীরা। উঠতি মৌসুমে বর্তমানে ধানের বাজার মূল্য প্রতি মন পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচশ’ টাকা।
চাষীরা জানান, প্রতিবছরের ন্যায় এবারও ফসল কাটার জন্য গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, খুলনা, বাগেরহাট, শরনখোলা, মোড়লগঞ্জ জেলার ধানকাটা শ্রমিকরা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আসলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। যারা এসেছেন তারা বাজারে ধানের দাম কম ও জমিতে কাঁদা-পানির কারণে ধান কাটতে অনীহা প্রকাশ করে ইতোমধ্যে চলে গেছেন। তাই পাকা ধান ঘরে তুলতে দিশেহারা হয়ে পরেছেন অধিকাংশ উপজেলার বোরো চাষীরা।
গৌরনদীর গেরাকুল গ্রামের চাষী হেলাল মিয়া জানান, তার ২০ শতক জমির পাকা ধান কেটে পারে তুলেছে পাঁচজন শ্রমিক। যাদের প্রত্যেককে চারশ’ টাকা করে মজুরি দিতে হয়েছে। নসিমনযোগে কাঁটা ধান বাড়িতে আনতে আরও চারশ’ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে। সবমিলিয়ে তিনি যে ধান পেয়েছেন তা বর্তমান বাজারমূল্যে ধানকাটা শ্রমিক ও নসিমন ভাড়াও উঠবেনা। সেখানে ধান উৎপাদনের খরচতো বাদই।
সূত্রমতে, উফশি, হাইব্রীড জাতের ধান প্রতিমন স্থানীয় বাজারমূল্য পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচশ’ টাকা আর ব্রী-২৯ জাতের ধানের বাজার মূল্য প্রতিমন সাড়ে পাঁচশ’ থেকে ছয়শ’ টাকা। যা চাষীদের উৎপাদন খরচের অর্ধেক। ধানের বাজার মূল্য কম হওয়া, শ্রমিক সংকট ও প্রতিকূল পরিবেশের কারনসহ সবমিলিয়ে উঠতি পাকা ফসল ঘরে তুলতে না পেরে বরিশালের কৃষকরা চরম হতাশায় রয়েছেন। অন্যদিকে বর্গা ও ক্ষুদ্র চাষীরা মহাজনদের দাদনের ধান ও সুদের টাকা পরিশোধের মহাদুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
চাষীরা জানান, সরকারীভাবে বাজার ব্যবস্থা মনিটরিং করে চাষীদের কাছ থেকে সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় সরাসরি ধান ও চাল ক্রয় করলে চাষীরা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পেয়ে উপকৃত হতে পারেন। ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে চাষীদের বঞ্চিত হবার সত্যতা স্বীকার করে জেলার দশ উপজেলার নির্বাহী অফিসাররা বলেন, বিষয়টি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সরকারের কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হবে। সরকার চাষীদের স্বার্থ চিন্তা করে অবশ্যই একটা ব্যবস্থা করবেন বলেও তারা আশা প্রকাশ করেছেন।