ঝিনাইদহ মহেশপুর উপজেলার দত্তনগরে অবস্থিত ভারতীয় ঠিকাদার হেরেন্দ্র নাথ দত্তের সবজি খামার এখন এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বীজ উৎপাদনকারী খামার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এই খামারটি ঘিরে মহেশপুরসহ ঝিনাইদহবাসীর জোর দাবি উঠেছে এখানে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের। প্রায় ২ হাজার ৭শ’ ৩৭ একর জমি নিয়ে এটি ৫টি খামারে বিভক্ত। এটি এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় কৃষি ফার্ম।
এখানকার উৎপাদিত বীজ বাংলাদেশ, এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।বছরে এখানে প্রায় ৫ হাজার মোট্রক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হয়। এখানে আউশ, পাট, গম, মুগ, নেরিকা, কলাই, ভুট্টা, হাইব্রীড ধান, আলুসহ বিভিন্ন ফসলের বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। গত ২০০৮ সালের দিকে এই কৃষি ফার্মটিতে বিএডিসির নিয়ন্ত্রিত একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা নেয় সরকার। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি দিতে রাজি না হওয়ায় তা ঝুলে আছে। এখানে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দীর্ঘদিনের দাবি এলাকাবাসীর। দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার পর ঝিনাইদহ-৩ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য এ্যাড.শফিকুল আজম খান চঞ্চল আবারও জোর তৎপরতা শুরু করেছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য। ইতোমধ্যে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য চিঠি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন বলে তিনি জানান।
দত্তনগর ফার্ম ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ১৯৪০ সালের দিকে কলকাতার বিশিষ্ট ঠিকাদার হেমেন্দ্র নাথ দত্ত এ খামার প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদার ছিলেন তিনি। তিনি সেনাবাহিনীর জন্য তাজা সবজি উৎপাদনের জন্য নিজ গ্রাম দত্তনগরে খামার করেন। তিনি রেলপথে দর্শনা স্টেশনে সবজি বহন করে কলকাতায় নিতেন। তবে সেটি ছিল কষ্টের। যার কারণে সেখানে হেলিপ্যাড স্থাপন করেন। প্রতিদিন তিনি পরবর্তীতে হেলিকপ্টারে করে এই খামারে উৎপাদিত শাকসবজি কলকাতায় সরবরাহ করে খ্যাতিও লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর হেমেন্দ্রনাথ দত্ত দত্তনগর ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। সেই সময় তার কর্মচারীরা এটি দেখাশোনা করতেন। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার খামারটি অধিগ্রহন এবং কৃষি বিভাগের কাছে সব দায়িত্ব অর্পণ করে। ১৯৬২ সালে ফার্মের যাবতীয় সম্পত্তি কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেই থেকে বিএডিসি প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের বীজ উৎপাদনের কার্যক্রম করে আসছে। দত্তনগর কৃষি খামার সুত্র থেকে জানা যায়, দত্তনগর ৫টি খামারে বিভক্ত। এখানে প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার মোট্রক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হয়। এখানে ৫ জন উপ পরিচালক, স্টাফ আছেন ৬০ জন, প্রতিদিন ১ হাজার ৫শ লেবার কাজ করেন। মোট ২ হাজার ৭শ ৩৭ একর জমির মধ্যে আবাদি প্রায়২ হাজার ৫শ একর জমি। নীচু জমি ৬শ একর ও বিল আছে ১শ একর প্রায়। এখানে অফিস ভবন, স্টাফদের বাসভবন রয়েছে। সেচের জন্য রয়েছে ৩৬টি গভীর ও ১৩টি অগভীর নলকুপ এবং ১০টি পাওয়ার পাম্প। ক্ষেতে পানি সরবরাহের জন্য পাকা ড্রেন। আগে এখানে শ্রমিকরা হাতে করে শস্য কর্তন ও মাড়াই করতেন। এখন বড় বড় মেশিনের সাহায্য ফসল কাঁটা ও মাড়াই করা হয়।
সুত্র থেকে আরো জানান যায়, দত্তনগর কৃষি ফার্মের ৫টি খামারের মধ্যে গোকুলনগর খামারে ৫শ ৭০ একর, পাতিলা খামারে ৬শ ৩ একর, মথুরা খামারে ৪শ ৯০ একর, করিঞ্চা খামারে ৫শ ৭০ একর ও কুশাডাঙ্গা খামারে ৪শ ৮০ একর জমিতে আউশ ধান, পাট, গম, মুগ, নেরিকা, কলাই, ভুট্টা, হাইব্রিড ধান, আলুসহ বিভিন্ন ফসলের বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। এখানে উৎপাদিত বীজগুলো তারা বিএডিসির কাছে হস্তান্তর করেন। এটি দেশের চাহিদা মিটিয়ে এশিয়ার অন্য দেশেও রপ্তানি করা হয়।
বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল আজম খাঁন চঞ্চল দত্তনগরে সরকারি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করে। সে সময় ঝিনাইদহ জেলাবাসী এশিয়ার সবচেয়ে বড় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হবে এখানে এমনটি আশা করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জমি, যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা ও ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্তীর সম্ভাব্যতা যাচাই করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য ড. আতফুল হাই শিবলী, ইউজিসির পরিচালক (গবেষণা ও প্রকাশনা) ড. লুৎফে আলম এবং উপ সচিব (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) ফেরদৌস জামানকে যাচাই কমিটি গঠন করে প্রস্তাবিত এলাকা পরিদর্শণ শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে একটি পজেটিভ রিপোর্ট জমা দেন। কিন্তু সেই পর্যন্তই।
ঝিনাইদহ-৩ আসনের সংসদ সংসদ সদস্য শফিকুল আজম খান চঞ্চল জানান, ২০০৮ সালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে দত্তনগর ফার্মের ১শ একর জমি চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় তা দিতে রাজি হয়নি। যার কারণে বিষয়টি ঝুলে আছে। তিনি বলেন, এবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার পর আবারও তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছেন। এখানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদেও কথা হয়েছে। তিনি আশা করেন দত্তনগরে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠলে এখান থেকে নতুন নতুন কৃষিবিদ তৈরি করা সম্ভব হবে। এছাড়ার এলাকার আর্থ সামাজিক ও শিক্ষার ব্যাপক উন্নয়ন হবে।