প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘উন্নয়নে রাজশাহী কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে, কেন জানি এলাকাটার উন্নতি হয়নি। আর সেই জন্য আমরা রাজশাহীর দিকে আলাদাভাবে দৃষ্টি দিচ্ছি। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করছি। রাজশাহীর জন্য আমরা পদ্মা নদী ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। রেল, নৌ এবং আকাশপথের যোগাযোগেরও উন্নয়ন দরকার। আমরা রাজশাহী, সৈয়দপুর ও বরিশালের বন্ধ বিমানবন্দর চালু করেছি।’ শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশেও জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলা চালানোর চেষ্টা চলছে মন্তব্য করে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজশাহী-ঢাকা বিরতিহীন ‘বনলতা এক্সপ্রেস’ ট্রেনের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমেই বাঁশি বাজিয়ে এবং সবুজ পতাকা উড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ট্রেনটির উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত দশ বছরে ১২৯ টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। যাত্রী পরিবহনে আয় বেড়েছে শতকরা ১৩৩ ভাগ এবং মালামাল পরিবহনে আয় বেড়েছে শতকরা ২১৮ ভাগ। এখন রেলপথ যেন প্রতিটি বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে সেই পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তাহলে পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোতে সহজে কাঁচামাল নিয়ে যাওয়া এবং উৎপাদিত পণ্য পাঠানো যাবে। নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। সামনে ঈদ আর জ্যেষ্ঠ মাসের পাকা আম- দুটোই মাথায় রেখে বনলতা এক্সপ্রেস চালু করলাম। আশা করি, রাজশাহী থেকে আম আসবে। আর ঈদ করতে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরবে। আমরা উন্নয়ন করে যাচ্ছি। উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা প্রয়োজন।’
অনুষ্ঠানে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম আমরা রেলের মাধ্যমে গোটা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। সেই পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। ঢাকা-রাজশাহী রুটে চলাচলকারী একটি ট্রেন যেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত যায় সেই পরিকল্পনাও আমরা ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছি। বিরতিহীন ট্রেন চালুর ব্যাপারে সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা ও সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের নির্বাচনি ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি আজ পূর্ণ হলো। আশা করছি, রাস্তার ওপর নির্ভরতা, যানজট ও দুর্ঘটনায় প্রাণহানি থেকে মানুষ মুক্ত হবে।’
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদসহ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘বিরতিহীন ট্রেন চালু, এটি যে কত বড় ভাগ্য! কত বড় পাওয়া তা আমি বলে বোঝাতে পারব না।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু এমপি, রাজশাহী-৫ আসনের এমপি ডা. মনসুর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এমপি ডা. সালিম উদ্দিন আহমেদ শিমুল, সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি আদিবা আনজুম মিতা, সাবেক এমপি আখতার জাহান, বিভাগীয় কমিশনার নূর-উর-রহমান, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক খোন্দকার শহিদুল ইসলাম প্রমুখ। ভিডিও কনফারেন্স পরিচলনা করেন জেলা প্রশাসক এসএম আবদুল কাদের প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন ঘোষণার পর বেলা ১১টা ৪৪ মিনিটে ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশ্যে রাজশাহী ত্যাগ করে বনলতা এক্সপ্রেস। প্রথম দিন যাত্রীরা বিনাটিকিটেই এই ট্রেনে যাত্রা করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনের জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে অত্যাধুনিক বগি আমদানি করা হয়। এতে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। প্রতিটি বগির দাম পড়েছে সাড়ে চার কোটি টাকা। বনলতার ১২টি বগিতে প্রতিদিন ২ হাজার যাত্রী ভ্রমণ করতে পারবেন। রেলপথ বিভাগ থেকেই এই ট্রেনে ভ্রমণকারীদের জন্য নিশ্চিত করা হবে খাবার। ট্রেনটি থেকে বছরে সরকারের আয় হবে ৩৭ কোটি টাকা। বনলতায় দেশের একমাত্র ট্রেন যা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করবে না।
ট্রেনটিতে সংযুক্ত রয়েছে উড়োজাহাজের মতো বায়োটয়লেট। এ কারণে মলমূত্র রেললাইনের ওপরে পড়বে না। রয়েছে রিক্লেনার চেয়ার ও স্লাইডিং ডোর। আছে ওয়াইফাই সুবিধা। প্রতিটি বগিতে রয়েছে এলইডি ডিসপ্লে, যার মাধ্যমে স্টেশন ও ভ্রমণের তথ্য প্রদর্শন করা হবে। রয়েছে ওজুখানা ও নামাজের স্থান। এছাড়াও রয়েছে প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট আসন। কিন্তু নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোনো ধরনের শ্লিপিং বার্থ। ট্রেনটি শুধু দিনের বেলায় চলাচল করবে, তাই এর দরকার পড়ছে না আপাতত।
ট্রেনের একটি খাওয়ার বগি ও পাওয়ার কার বগি বাদেই মোট আসন সংখ্যা ৯২৭টি। বিরতিহীন চার্জ ধরে এই ট্রেনে ভ্রমণের জন্য অন্য ট্রেনের তুলনায় যাত্রীদের ১০ শতাংশ বেশি ভাড়া গুণতে হবে। সাধারণ শোভন চেয়ারের ভাড়া পড়বে ৩৭৪ টাকা। আর এসি চেয়ারের ভাড়া লাগবে ৭২২ টাকা। বনলতা ঢাকা-রাজশাহীর ৩৪৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেবে চার ঘণ্টা ৪০ মিনিটে। অন্য ট্রেনের তুলনায় সময় বাঁচবে প্রায় দুই ঘণ্টা। ঘন্টায় ট্রেনটির সর্ব্বোচ্চ গতিবেগ উঠবে ৯০ থেকে ৯৫ কিলোমিটার।
আগামী ২৭ এপ্রিল থেকে সপ্তাহের শুক্রবার বাদ দিয়ে বাকি ছয়দিন ট্রেনটি ঢাকা-রাজশাহী-ঢাকা রুটে চলাচল করবে। সকাল ৭টায় ট্রেনটি রাজশাহী থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে পৌঁছাবে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে। আর ঢাকা থেকে দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে যাত্রা শুরু করে রাজশাহী পৌঁছাবে সন্ধ্যা ৬টায়। বগিগুলো নতুন হলেও ২০১৩ সালে ভারত থেকে আমদানি করা দুটি ভালোমানের ইঞ্জিন দিয়ে চলাচল করবে ট্রেনটি। রাজশাহী-ঢাকা রুটে এতোদিন আন্তঃনগর ট্রেন পদ্মা এক্সপ্রেস, ধূমকেতু ও সিল্কসিটি এক্সপ্রেস চলাচল করত। বনলতা এক্সপ্রেস চালুর এই রুটে ট্রেনের সংখ্যা হলো চারটি।