সকাল সাড়ে ৯ টা। সমলা বেগম নামের ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধা মহিলা বাকতা ইউনিয়ন পরিষদের বারান্দায় বসে কান্না করছেন। তাঁর স্বামী সন্তান কেউ নেই। কৈয়াচালা গ্রামের আমতলি তাঁর বড়ি। ভিক্ষাবৃত্তি করে দিন চলে। বয়সের ভারে অনেকটা নুয়ে পরেছেন। ভিক্ষা করে তিন হাজার টাকা জমিয়ে ছিলেন তিনি। ভিজিডির কার্ড দেয়ার কথা বলে ভিক্ষুক সমলা বেগমের কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা নিয়েছে মহিলা মেম্বার মাজেদা খাতুন। টাকা নেয়ার এক বছর হলেও তাকে ভিজিডি কার্ড না দিয়ে তাকে ঘুরাচ্ছেন।
ফুলবাড়িয়া উপজেলার বাকতা ইউনিয়ন পরিষদের ৪, ৫ও ৬ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য মাজেদা খাতুনের বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধশতাধিক দরিদ্র-হতদরিদ্র মহিলার অভিযোগ ভিজিডি কার্ড,বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা ও নলকুপ দেয়ার কথা বলে দুই হাজর থেকে সাড়ে দশ হাজার টাকা নিয়েছেন।
সরেজমিনে বাকতা ইউপি কার্যলয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় অর্ধশতাধিক মহিলা পরিষদ হলরুমে অবস্থান করছেন। তাদের বয়স ৩৫ থেকে ৭৫ বছর পর্যন্ত হবে। বেশির ভাগই হতদরিদ্র। কেউ কেউ ভিক্ষবৃত্তি করে চলেন। সাবাই ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তাদের অভিযোগ ইউপি সদস্য মাজেদা খাতুন ভিজিডি কার্ড,বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা ও নলকুপ স্থাপন করে দেয়ার জন্য টাকা নিয়েছেন। প্রায় দুই বছর যাবৎ তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঘুরাচ্ছেন। টাকা ফেরৎ চাইলে মারতে আসেন।
ইউপি সদস্য মাজেদা খাতুন কৈয়ারচালা কুলুর চালা গ্রামের মৃত লুকমান হোসেনের স্ত্রী ফাতেমা খাতুন (৭০), মৃত ওয়াজ উদ্দিনের স্ত্রী আজীরন (৬০) বিধবা ভাতার কার্ড দেয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। একই গ্রামের মৃত কালু মিয়ার স্ত্রী খোদেজা খাতুন (৫২) ও মৃত লোকমান মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা খাতুন (৭০), মৃত রুস্ত আলীর স্ত্রী মাজেদা খাতুন (৫৫) তাদেরকে বিধবা ভাতার কার্ড দেয়ার কথা বলে ২ হাজার টাকা করে নিয়েছে। ভিজিডি কার্ড দেয়ার কথা বলে কুলুরচালা গ্রামের ফিরোজা খাতুন, সাজেদা খাতুন, আনোয়ারা খাতুন,সুফিয়া খাতুন ফেরুজা খাতুন ও কুলছুম আক্তরসহ অনেকের কাছ ভিজিডি কার্ড দেয়ার কথা বলে দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা করে নিয়েছেন।
গতকাল সোমবার ৩৪ জন ভোক্তভোগী দরিদ্র মহিলা ও পুরুষ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে সকাল থেকে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের টাকা ফেরত ও অভিযোক্ত মহিলা মেম্বারের বিচারের দাবীতে। এর আগেও ভোক্তভোগী মহিলারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল নির্দেশ প্রদান করেন। গতকাল দুপুরে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা তদন্ত করতে যান বাকতা ইউপি কার্যলয়ে। এ সময় ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও ভোক্তভোগীরা উপস্থিতে তদন্ত করে আসেন।
এলাকাবাসী ও ইউপি কার্যলয় সূত্রে জানাযায়, মহিলা মেম্বার মাজেদার বিরুদ্ধে ভিজিডি ও ভিজিএফ কার্ড বিক্রি, সরকারী প্রকল্পের কাজ না করে সিংহভাগ টাকা আত্মসাৎসহ ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ইউপি কার্যলয় থেকে সরকারী যা সুযোগ-সুবিধা পায় তা গ্রামের মানুষদের না দিয়ে আত্মীয়- স্বজনদের মাধ্যমে বিক্রি করে নিজেই খায়। কিছুটা ঊশৃংখল হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে সাহস পায়ন।
কুলুর চালা গ্রামের রৌশন আলী বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যা পায় সব নিজেই খায়, গ্রামের কাউকে কিছুই দেয়না। এক কথায় বলা যায় আমাদের খাদক মেম্বারনি। কালোবাজারির কাছে ভিজিএফের চাউলের কার্ড বিক্রি করে, পরবর্তীতে চাউল দিতে পারেনি। আমার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছিল, এখনো সেই টাকা ফেরত দেয়নি।
কুলুর চালা গ্রামের ফাতেমা খাতুন বলেন, বিধবা ভাতার কার্ড করে দিবে বলে প্রায় দেড় বছর আগে ৫ হাজার টাকা নিয়েছিল। এখনো কার্ড করে দেয়নি। টাকা ফেরত চাইলে মারতে আসে। অন্যের বাড়ি কাজ করে টাকা দিয়েছিলাম মেম্বরনিকে।
অভিযোক্ত মহিলা ইউপি সদস্য মাজেদা খাতুন বলেন, যারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন সবার কাছ থেকে টাকা নেইনি, সরকারী সুযোগ সুবিধা দেয়ার কথা বলে যাদের কাছ থেকে নিয়েছিলাম তাদের মধ্যে ৩ জনকে টাকা ফেরত দিয়েছি, অন্যান্যদেরটা ফেরত দিয়ে দিব, পত্রিকায় কিছু লিখবেন না।
মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রেহেনা পারভীন বলেন, বাকতা ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা মেম্বারের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে বাদী বিবাদীসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ এলাকাবাসীর সাথে গোপনে ও প্রকাশ্যে কথা বলেছি, দ্রুত প্রতিবেদন দাখিল করবো।
ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুল হক মাখন বলেন, মহিলা ইউপি সদস্য মাজেদা খাতুন বিভিন্ন কার্ড দেয়ার কথা বলে ২২ জন দরিদ্র মহিলাদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার বিষয় প্রায় এক বছর আগে ইউপি কার্যালয়ে শালিসে স্বীকার করেছিল। টাকা ফেরত দিবে বললেও পরবর্তীতে দেয়নি। সম্প্রতি ভোক্তভোগী মহিলারা ইউএনও স্যারের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন, যা তদন্ত হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লীরা তরফদার বলেন, বেশ কয়েকজন দরিদ্র মহিলা ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন, অভিযোগটি তদন্ত করতে দেয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন আসলেই পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তাঁর বিরুদ্ধে।