হোল্ডিং ট্যাক্স খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বেপরোয়া অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি)। হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ফ্রেব্রুয়ারী মাস থেকে শুরু হওয়া পুনঃজরিপে এখাতে দুর্নীতির ব্যাপক তথ্য উঠে এসেছে। প্রথমধাপে চারশ’ ভবনের পুনঃজরিপেই ধরা পরেছে বিশাল অংকের দুর্নীতি।
কর্পোরেশনের সচিব এবং রাজস্ব কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা ইসরাইল হোসেন বলেন, সব হোল্ডিংয়ের পুনঃজরিপ শেষ হলে এ খাতের আয় বর্তমানের তুলনায় প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে এ খাতে বছরে আয় বর্তমানের ২০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৭০ কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ হোল্ডিং ট্যাক্স খাতে বছরে ৫০ কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে বিসিসি।
সূত্রমতে, ২০১৬ সালের ২৪ জানুয়ারি জারি হওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী বরিশাল নগরীকে তিন ভাগ করা হয়। মূল শহর, মধ্যম শহর এবং বর্ধিত শহর আখ্যা দিয়ে বর্গফুট প্রতি সর্বনিন্ম এক টাকা ৫০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ টাকা পর্যন্ত কর নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এ হার অনুযায়ী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারিত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগের পর সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ নতুনভাবে সব হোল্ডিংয়ের কর নির্ধারণ জরিপের নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে নতুন জরিপেই ধরা পরেছে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়গুলো।
বিষয়টি নিয়ে সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বলেন, দুর্নীতির কারণে বরিশাল সিটি করপোরেশন শুরু থেকেই পঙ্গু হয়ে ছিলো। জ্বালানি খাতে মাসে লোপাট হতো প্রায় ১০ লাখ টাকা। ভুয়া কর্মচারীর নামে বেতন তুলে গায়েব করে ফেলা হতো মাসে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। হোল্ডিং ট্যাক্সের খাতে দুর্নীতি না হলে বছরে সিটি কর্পোরেশনের আয় বাড়ত প্রায় ৫০ কোটি টাকা। মেয়র আরও বলেন, ২০০৫ সালের পর থেকে কর্পোরেশনের যারা অবসরে গেছেন তাদের পাওনা পরিশোধ করা হয়নি। আমি একদিনে তাদের সাড়ে চার কোটি টাকা পরিশোধ করেছি। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর যাবতীয় বকেয়া পরিশোধের পরেও আমাদের রাজস্ব খাতে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা জমা আছে। আমার ঘোষণা ছিল, নগর ভবনকে দুর্নীতিমুক্ত করা। সেটা বাস্তবায়ন করেছি। নগর ভবন এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদের আয় দিয়ে ছোটখাটো উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নসহ চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।
নতুন জরিপ নিয়ে নগর ভবনের অ্যাসেসমেন্ট বিভাগের প্রধান মুশফিক আহসান আজম বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে চার হাজার হোল্ডিং চিহ্নিত করে নতুনভাবে যেসব স্থাপনার আকার পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধন করা হয়েছে তার অ্যাসেসমেন্ট চালানো হয়েছে। এরইমধ্যে প্রায় পাঁচশ’র মতো এমন স্থাপনার অ্যাসেসমেন্ট শেষ হয়েছে। আর এর সবকটিতেই ধরা পরেছে শুভংকরের ফাঁকি। বাজার রোড এলাকায় থাকা একটি ইলেকট্রিকাল কোম্পানির কারখানা আগে যেখানে ট্যাক্স দিত মাত্র তিন হাজার টাকা সেখানে নতুন অ্যাসেমেন্টে করের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ টাকা। সদর রোডের একটি অভিজাত খাবার প্রতিষ্ঠান এবং সংলগ্ন অন্য আরেকটি স্থাপনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই দুটি প্রতিষ্ঠান মিলে বছরে হোল্ডিং ট্যাক্স দিতো মাত্র ২৭ হাজার টাকা। নতুন জরিপে এর একটি প্রতিষ্ঠানেরই হোল্ডিং ট্যাক্স এসেছে এক লাখ ৮৭ হাজার টাকা।
অ্যাসেসমেন্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নতুন জরিপ হওয়া প্রায় সব ভবনেই ধরা পরেছে লাখ লাখ টাকার ট্যাক্স ফাঁকির ঘটনা। ২৩নং ওয়ার্ডে খন্দকার মোহসেনা বেগম নামে এক গ্রাহক তার দ্বিতল ভবনের জন্য বছরে ট্যাক্স দিতেন চার হাজার টাকা। সস্প্রতি ভবনটি চারতলা করা হয়েছে। নতুন জরিপে ওই ভবনের ট্যাক্স দাঁড়িয়েছে দুই লাখ টাকা। ১১নং ওয়ার্ডের মেডিকেল কলেজ লেনের আবদুর রহিম সিকদার তার একতলা ভবনের জন্য বছরে ট্যাক্স দিতেন এক হাজার ৬২০ টাকা। ভবনটি সাততলা করার পর নতুন জরিপে এর ট্যাক্স এসেছে এক লাখ ৫৪ হাজার টাকা।
নির্ধারিত হারের তুলনায় কম ট্যাক্স দেয়ার বিষয়ে উল্লিখিত ভবন মালিকদের প্রায় সবাই বলেন, নগর ভবন যেভাবে ট্যাক্স নির্ধারণ করেছে এত বছর আমরা সেভাবেই ট্যাক্স দিয়ে এসেছি। এখানে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার প্রশ্নই উঠেনা। ১১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবদুর রহিম বলেন, অতিরিক্ত ট্যাক্স নির্ধারণ বিষয়ে আপিল বোর্ডে আবেদন করেছি। শুনানিও হয়েছে। এখন দেখি কর্তৃপক্ষ কি সিদ্ধান্ত দেয়।
আপিল এবং ট্যাক্স ফাঁকির বিষয়ে নগর ভবনের সচিব ইসরাইল হোসেন বলেন, নাগরিকদের করা অভিযোগের শুনানি করেছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগগুলোর বাস্তব ভিত্তি মিলছে না। আসলে জটিলতা অন্য জায়গায়। যাদের মোটামুটি ক্ষমতা রয়েছে তারা সাবেক মেয়রদের কাছে ধর্ণা দিয়ে ট্যাক্স কমিয়েছেন। আর যাদের সেই সুযোগ ছিলোনা তারা মাঠপর্যায়ে জরিপে যাওয়া কর্মকর্তাদের নানাভাবে ম্যানেজ করে কর কমিয়েছেন। ফলে নতুন জরিপের পর অনেকের মনে হচ্ছে হঠাৎ করে কর বেড়ে গেছে।