সরকার দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থার নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নতুন আইন করছে। আর নতুন আইনে এদেশে কর্মরত এনজিওগুলোকে নতুন করে নিবন্ধন নিতে হবে। কারণ প্রস্তাবিত স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থা (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) আইনে যে কোনো এনজিওকেই প্রতি পাঁচ বছর পর পর নিবন্ধন নবায়ন করার বিধান রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে সরকার কোনো এনজিওর কার্যক্রমে সন্তুষ্ট না হলে নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে। তাছাড়া খসড়া আইন অনুযায়ী সরকারি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের শর্তের খেলাপ বা আর্থিক অনিয়ম, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ততা, সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী কাজের কারণে সরকার সংশ্লিষ্ট সংস্থার কার্যনির্বাহী কমিটি স্থগিত করে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে। খসড়া আইনের ১৪ ধারার (খ) উপধারা অনুযায়ী অনুমোদিত সব সংস্থার প্রত্যেক তিন মাসের ব্যাংক হিসাব স্থানীয় সমাজসেবা অফিসে দিতে হবে। তবে আইনের ২৩ ধারা অনুযায়ী সরকার চাইলে যেকোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এ বিষয়ে দায়মুক্তি দিতে পারবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (রেজিস্ট্রেশন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ, ১৯৬১’-এর পরিবর্তে নতুন আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে এবং তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। তবে সরকারের এ উদ্যোগে এনজিওসংশ্লিষ্ট কারো কারোর ধারণা, সরকার বিদেশি অনুদাননির্ভর সংস্থাগুলোর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ নিতেই আইনে এমন বিধান রাখছে। বর্তমানে এদেশে আড়াই হাজারের মতো বিদেশি অনুদাননির্ভর এনজিও রয়েছে। তাছাড়া সমাজসেবা অধিদপ্তর, জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধীনেও দেশি লক্ষাধিক এনজিও রয়েছে। এনজিও সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ বলছেন, নতুন করে নিবন্ধন নিতে গেলে বিদেশি সহায়তাপুষ্ট অনেক এনজিওকে ঝামেলা পোহাতে হবে।
সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন সামরিক সরকারের আমলের অধ্যাদেশগুলোকে আইনে পরিণত করছে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় সরকার সময়ের সঙ্গে সংগতি এবং ভবিষ্যতের বিষয়গুলো মাথায় রেখে নতুন আইনটি করতে যাচ্ছে। আর খসড়া আইনের ৪ ধারার ৩ উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘পূর্ব হইতে বিদ্যমান কোনো সংস্থা এই আইন কার্যকর হইবার তারিখ হইতে এক বৎসরের অধিককাল চালু রাখা যাইবে না, যদি না উক্ত তারিখ হইতে ৩০ দিবসের মধ্যে ৫(১) উপধারা অনুযায়ী উহার নামের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করা না হইয়া থাকে।’ ৫ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বা সমষ্টি কোনো সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে বা কোনো বা আগে প্রতিষ্ঠিত অনুরূপ কোনো সংস্থা চালু রাখতে ইচ্ছা করলে তাকে বা তাদেরকে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নামের ছাড়পত্র গ্রহণের জন্য নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করতে হবে।’ খসড়া আইন অনুযায়ী প্রত্যেক সংগঠনকে নিবন্ধন পাওয়ার প্রতি পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার ৩ মাস আগে নিবন্ধন নবায়নের জন্য নির্ধারিত পদ্ধতিতে সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। খসড়া আইনের ১১ ধারার (গ) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ আবেদনপত্র প্রাপ্তির পর নির্ধারিত পদ্ধতিতে যাচাই-বাছাই এবং প্রয়োজনে তদন্ত সম্পন্ন করিয়া নিবন্ধন নবায়ন করিবেন বা সংগত কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া আবেদন প্রত্যাখ্যান করিতে পারিবেন।’ তাছাড়া খসড়া আইনের ৮ ও ৯ ধারায় উল্লেখ আছে, অনুমোদিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কার্যনির্বাহী পরিষদ ও গঠনতন্ত্রের অনুমোদন না নিলে এগুলো কার্যকর হবে না। এর ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের শর্তের খেলাপ বা আর্থিক অনিয়ম, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ততা, সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী কাজের কারণে সরকার সংশ্লিষ্ট সংস্থার কার্যনির্বাহী কমিটিকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিয়ে স্থগিত করে প্রশাসক নিয়োগ করতে পারবে। কোনো সংস্থা নিজেকে বিলুপ্ত ঘোষণা করত চাইলে কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাতে হবে। সরকার সংশ্লিষ্ট সংস্থার বিলুপ্তির কারণ খতিয়ে দেখে যদি দায়দেনা থাকে তাহলে সেগুলো পরিশোধের নির্দেশ দেবে।
এদিকে নতুন আইন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ এনজিও ফোরামের সাবেক ব্যবস্থাপক (অ্যাডভোকেসি ও তত্ত্ব) সাহা দীপক কুমার জানান, এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে বিদেশি অনুদাননির্ভর সংস্থাগুলোকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে কাঠখড় পুড়িয়ে অনুমোদন নিতে হয়। নতুন নিবন্ধন নিতে হলে চিন্তার বিষয়। মূলত পরোক্ষভাবে বেসরকারি সংগঠনগুলোকে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হচ্ছে কিনা তা সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে খতিয়ে দেখা উচিত।
অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির জানান, এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। তবে যেসব বিধানের কথা শুনলাম তা সংবিধানে দেয়া সংগঠন করার অধিকারের পরিপন্থী বলে মনে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আইনে যদি সংগঠন নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো গ্রহণযোগ্য না করা হয় তাহলে আদালতে চ্যালেঞ্জে পড়বে।
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জানান, আশা করব সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলেই আইনটি চূড়ান্ত করা হবে। আর অংশীজনদের মতামত নিয়ে আইনটি করলে ভালো হবে।