প্রায় দেড় শত বছর আগে ঘুনে ধরা সমাজকে বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন জানান দিয়েছিলেন পুরুষদের মত মেয়েরাও সবকিছু করতে পারে। তারা কখনো পিছিয়ে নেই। তাই পর্দার আড়ালে থেকেও তিনি পুরুষদের পাশাপাশি নারী শিক্ষার প্রতীক হয়ে রয়েছেন যুগ যুগ ধরে। এরই ধারাবাহিকতায় বাজিতপুর উপজেলার ৫ জয়িতা নারী অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও তারা পরাজয়কে বরণ করেনি। বিজয়ী হয়ে তারা সমাজপতিদের জবাব দিচ্ছেন এবং স্বামীর সংসারে থেকেও বিজয়ীর বেশে সমাজে প্রতিষ্টিত হতে চলেছেন।
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী নাজমা বেগম ঃ- বাজিতপুর উপজেলা দিলালপুর ইউনিয়নের হলদেভিটা গ্রামের নাজমা বেগম বয়স যখন ১৪ বছর তখন তার মা-বাবা অভাবের তাড়নায় তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। ফলে তার লেখা পড়া বন্ধ হয়ে যায়। স্বামীর সংসারে দারিদ্রতার কারণে তিনি নিজেও স্বামীর পাশাপাশি কাজ করতেন। এর মধ্যে নাজমার দুই সন্তান হয় সংসার বড় হতে থাকে। এক সময স্বামী জীবিকার তাগিদে ঢাকায় এসে রিকসা চালায়। হঠাৎ খবর আসে নাজমার স্বামী একসিডেন্ট করেছে এবং এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে। স্বামীর চিকিৎসার জন্য নাজমার ভিটে বাড়ী সব বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যায়। সংসার চালানো কষ্টকর। দিশেহারা নাজমা সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করতে শুরু করে প্রথমে মেশিন ভাড়া নিয়ে কাজ করত পরে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর হতে বিনা মূল্যে সেলাই মেশিন পায়। এলাকাল মহিলাদের সেলাই প্রশিক্ষণ শিখায় পাশাপাশি কাপড় এনে বিক্রি করে। আর্থিক অবস্থা ভাল হতে শুরু করে। স্বামীর কৃত্রিম পা লাগায় এবং স্বামীকে মুদির দোকান করে দেয়। দুই মেয়ে অনার্স ১ম পর্ষে পড়ে। নাজমা সংরক্ষিত আসনে নারী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। স্বামীর ব্যবসা দৈন্যদশা থেকে মুক্তি সবই নাজমার হাত ধরে। আজ নাজমা অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী সকলের পরিচিত মুখ।
শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী আরনিকা আক্তার ঃ- দিলালপুর ইউনিয়নের বাহের নগর গ্রামের আরনিকা আক্তার যখন পড়াশুনা করার কথা ছিল তখনই পারিবারিক সিদ্ধান্তে ১২ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়। তার স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে ইচ্ছে পূরণ হলো না। সংসারের কাজ করতে না পারা এবং স্বামীর বাড়ির লোকজনের টাকার চাহিদা মিটাতে না পারায় ১০ মাস পর স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয়। আরনিকা খুব মেধাবী ছাত্রী ছিল বাবার বাড়ী এসে আবার ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। নিচের ক্লাসের ছাত্র/ছাত্রী পড়িয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচ বহন করত পাশাপাশি পরিবারেরও সহযোগীতা করত। বর্তমানে তিনি দিলালপুর ইউনিয়নের উদ্যেক্তা। শত বাধা বিপত্তিও তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। নিজের জীবন দিয়ে উপরব্ধি করেছেন একমাত্র শিক্ষাই পারে জীবনকে আলোকিত করতে। আরনিকা শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছেন।
সফল জননী মোছাঃ মর্জিনা বেগম ঃ- গাজিরচর ইউনিয়নের সাদিরচর প্রত্যন্ত গ্রামে থেকে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করিয়েছেন। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বিয়ের পর সন্তান জন্ম হওয়ায় আর পড়াশোনা হয়নি। মর্জিনা বেগম বাল্যবিয়ের কারণে মাধ্যমিকের গন্ডি পেরুতে পারেননি। তাই সন্তানদের দিয়ে সেই ইচ্ছে পূরণ করার প্রতিজ্ঞা করেন। নিজের সব ইচ্ছাকে ত্যাগ করে ছেলে মেয়েদের পড়া শোনার দিকে নজর দেন তিনি। ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে কোন তফাত করেননি। সমান গুরুত্ব দিয়ে সন্তান হিসেবে তাদের মানুষ করেন। পাঁচ সন্তানই বিসিএস ক্যাডার। ১- প্রথম মেয়ে রোকছানা পারভীন বিসিএস- স্বাস্থ্য ক্যাডার, ২- দ্বিতীয় ছেলে মিজানুর রহমান ২৮ তম বিসিএস- স্বাস্থ্য ক্যাডার, ৩- তৃতীয় মেয়ে আফসানা পারভীন ৩০ তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার, ৪- চতুর্থ মেয়ে রেজওয়ানা পারভীন ৩৩ তম বিসিএস স্বাস্থ্য কেডার, ৫- ৫ম ছেলে মফিজুর রহমান ৩৫ তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার। মর্জিনা বেগম এর ত্যাগ সার্থক হয়েছে তিনি একজন সফল জননী।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে পেলে নতুন উদ্যেমে জীবন শুরু করেছে আল্পনা আক্তার ঃ- দিলালপুর ইউনিয়নের বাহেরনগর গ্রামের। আল্পনার বয়স যখন ১০ বছর তখন তার গরিব মা-বাবা অভাবের তাড়নায় বিয়ে দেয়। স্বামী কৃষিকাজ করত পরে প্রবাসে চলে যায়। স্বামীর অনুপস্থিতে আল্পনার শ^শুর বাড়ির লোকজন তাকে শারিরীক এবং মানসিক নির্যাতন শুরু করে। সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে স্বামী ভিটে ছারেনি আল্পনা। তাদের অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলে এমন পর্যায়ে যায় যে আল্পনার স্বভাব চরিত্র নিয়ে আজেবাজে কথা বলে তার স্বামীর কাছে। আল্পনার ৩ মেয়ে ১ ছেলে। এর মধ্যে আল্পনার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রবাস থেকে দেশে চলে আসে। চিকিৎসারত অবস্থায় তার স্বামী মারা যায়। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। আল্পনার শ^শুর বর্তমান থাকা অবস্থায় স্বামী মারা যাওয়ায় আল্পনার সন্তানদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয় শুধু তা নয় বাড়ী থেকেও বের করে দেয়। তবুও থেমে থাকেনি আল্পনা বাবার বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় নেয়। বাবার বাড়িতে আল্পনা যাওয়ায় তার ভাই এবং তার স্ত্রী বাড়ি চেড়ে চলে যায়। আল্পনা অনেক কষ্টে বাড়ীতেই একটি মুদির দোকান দেয়। সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে শত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এভাবেই আল্পনা নতুন উদ্যেমে জীবন শুরু করে।
সমাজ উন্নয়নে আসামান্য অবদান রেখেছেন কল্পনা রানী বিশ^াস ঃ- দিঘিরপাড় ইউনিয়নের চেঙ্গাহাটি গামে সাধন চন্দ্র সরকারের সাথে বিয়ে হয়। স্বামী মারা যাওয়ায় দুই সন্তানকে মানুষ করার জন্য এবং জীবিকার তাগিদে অনেক কষ্ট করেছেন। সব সময় দুঃস্থ অসহায় মানুষের পাশে থেকেছেন। তিনি ইউপি সদস্য ছিলেন এলাকার জুয়া খেলার আসর ভেঙ্গে দিয়ে যুব সমাজকে রক্ষা করেছেন। টাকা দিয়া কেরাম খেলা বন্ধ করেছেন। সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির সহযোগীতায় ১ মাস ব্যাপি তিনি নিজে এবং সাথে ৩০ জন মহিলাকে ধাত্রী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। বর্তমানে ১৩ জন ধাত্রীর কাজ করছে। এলাকার যে কোন সমস্যা হলে সকলে তার কাছে পরামর্শ গ্রহণ করে। সমাজ উন্নয়নে নিরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন কল্পনা।
বাজিতপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রেহানা আক্তার বলেন, “নারীরাও শতবাধাঁ পেরিয়ে জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে পারে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে ‘জয়ীতা অন্নেষনে বাংলাদেশ’ এর নির্বাচিত এই পাঁচ নারী সংগামী সেসব নারীরই প্রতিচ্ছবি।”