দুই সপ্তাহেও পর্যাপ্ত সাহায্য পাননি ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে লক্ষ্মীপুরের রামগতির ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো। বাড়ী ঘর বিধ্বস্ত হওয়ায় খোলা আকাশের নিচে দূর্বিসহ দিন কাটছে তাদের। বিধ্বস্ত হওয়া পরিবার গুলোর মধ্যে অনেকেই শুকনা খাবার ছাড়া অন্য কোন সহায়তা পাইনি অভিযোগ রয়েছে ক্ষতিগ্রস্থদের। তবে বর্ষার আগেই ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি ঠিক হবে কিভাবে সেটা নিয়ে দুঃচিন্তায় রয়েছেন তারা। দ্রুত তালিকা তৈরি করে পূনবার্সন করার দাবী জানান ক্ষতিগ্রস্তরা। পাশাপাশি ছেলে মেয়ের পড়ালেখা নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় রয়েছে তারা।
জেলা প্রশাসন বলছেন, ইতিমধ্যে শুকনো খাবারসহ ৭০ ভান্ডেল ঢেউটিন বরাদ্ধ করে তা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করে মন্ত্রাণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রাণালয় থেকে বরাদ্ধ প্রাপ্তির পর পূর্ণবাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
জানাগেছে,৪ মে সকালে লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে বেড়াতে আসা আনোয়ারা বেগম (৭৫) নামের এক বৃদ্ধা নিহত হন। একই ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৫ জন নারী ও পুরুষ। ফণীর আঘাতে বিধ্বস্ত হয় লক্ষ্মীপুরে রামগতির চরআলগী,চরআবদুল্লাহ ও চররমিজসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে আংশিকও সম্পূর্ণ তিন শতাধিক ঘরবাড়ি। এসব মানুষগুলোর মধ্যে কয়েকজন নিজ অর্থে কিছুটা মেরামত করলেও এদের মধ্যে অনেকেই সরকারি এক ভান ঢেউটিন ও বিশ কেজি চাউলসহ নগদ তিন হাজার টাকার বিনিময়ে সংসারের আহার খরচ মিটিয়ে মেরামত করতে পারেননি বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি।
সরাকারিভাবে ঘর মেরামত ও ঘর তৈরি করে দেওয়ার সাহায্য না পেয়ে দুই সপ্তাহ ধরে পরিবার পরিজন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে ক্ষতিগ্রস্থরা। সামর্থ্যের অভাবে ঘর মেরামত করতে না পেরে বসবাস করতে হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি কবে নাগাদ মেরামত করা হবে সেটা নিয়ে দুঃচিন্তায় তারা।
কথা হয় রামগতির চরআলগী ইউনিয়নের চর নেয়ামত এলাকার আব্দুল হাকিম এর স্ত্রী আল্পনার সাথে। আল্পনা জানায়, ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে উড়ে গিয়ে ঘর-বাড়ী বিধ্বস্ত হয় দু’সপ্তাহ হয়। এ পর্যন্ত এক ভান ঢেউটিন ও নগদ তিন হাজার টাকা আর কিছু শুকনো খাবার পেয়েছেন। তবে আরো টাকার প্রয়োজন হওয়ায় ঘর-বাড়ী বিধ্বস্ত ভিটাতে নতুন করে ঘর তুলতে পারেনি। আর তিন হাজার টাকা বাজার সদাই করে শেষ। এখন হাতেও টাকা নেই,মাথার ওপরে ছানি নেই। বৃষ্টি হলেই যা রয়েছে তাও চলে যাবে বৃষ্টির পানিতে। দুই সপ্তাহ চলে গেলো এখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলেনি‘ খাবার দাবার আবার ছেলে মেয়ের পড়ালেখা নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় থাকতে হচ্ছে তাকে। ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে অর্ধশত পরিবারের এ চিত্র বিরাজ করছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ফণীর আঘাতে জেলার ১২০ ঘর সম্পূর্ণ এবং ২৮৭ টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে এমন অর্ধশত পরিবার এখনো খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। ওই এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ তছির মিয়ার স্ত্রী ছলেমা খাতুন জানান, গত বছর তিনি গবাদি পশু বিক্রি ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটি দোকানও আরো ৪ লাখ টাকায় আধাপাকা একটি ঘর তৈরি করেন। তবে ৪ মে (শনিবার) সকালে ঘূর্ণিঝড় ফণীর ছোবলে সেই ঘরটিও বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ফণীর রেহাই দেয়নি বেড়াতে আসা তার মা আনোয়ারা বেগম (৭৫) কে। আনোয়ারা বেগম (৭৫) কে জীবন দিতে হয়েছে ঘূর্ণিঝড়ের ছোবলে।
বাড়ী ঘর,গাছ পালাসহ মাকে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন অর্ধেক মাস হয়ে গেলো ছলেমা খাতুনের। নেই আয়ের একমাত্র পথ বাড়ীর পাশের্^ একটি দোকান তাও ঝড়ে ভেঙে গেছে। উড়ে গেলো দোকানের মালামাল। দোকানের বিক্রির টাকার আয় দিয়ে সংসার চলতো। এখন তাদের সংসার চালানো দায়, সেখানে ঘর মেরামত তার কাছে দিবাস্বপ্নের মতো। ছলেমা খাতুন আরো জানান,সরকারিভাবে যে সাহায্যে দেয়া হয়েছে, তা ঘর মেরামতের জন্য পর্যাপ্ত নয়। একই অবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ বাকি পরিবারগুলোর।
একইভাবে ক্ষতিগ্রস্থ সোহেল জানান,অনেকের মতো আমার ঘরটা হয়তো পুরোপুরি ভেঙে টিনের চাল একেবারেই দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। অথচ প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিনি কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি বলে অভিযোগ করেন। ১৪ দিন হয় ফণীর আঘাতে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেছে তাদের। সেই থেকে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে উল্লেখ করে চর নেয়ামত এলাকার জমির আলীর স্ত্রী রুনা আক্তার জানান, ১৪ দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতে হচ্ছে তাদের। সরকারের পক্ষ থেকে যে সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়েছে, তা লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়। ২০ কেজি চাল ও এক বান্ডিল টিন দিয়ে এক চালা একটি ঘরও দাঁড় করানো যায় না।
কথা হয় রাহেলা নামের এক নারীর সাথে, তিনি জানান,তাদের ঘরটা কোনোভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও ঘরের একটি টিনও ভালো নেই। ভালোগুলো সব বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। টাকার অভাবে ঘর মেরামত করতে পারিনি। সরকার বা কারো কাছ থেকে সহযোগিতা পেলে হয়তোবা তাদের আবার ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হতো।
স্থানীয় সোনালী মুরগী ও চিংড়ি ঘের পরিচালক মিরাজ জানান, ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে ঘেরে চিংড়ি মাছ ও খামারের মুরগি মরে ২০ লাখ টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। ভেঙ্গে গেছে মুরগী রাখার খামারও। সরকারি সাহায্য সহায়তা না পেলে তার পক্ষে পুনরায় দাঁড়নোর মতো সামর্থ্য নেই বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
রামগতি উপজেলা চেয়ারম্যান শরাফ উদ্দিন আজাদ জানান,অনেকের ঘর ভেঙে গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে সামান্য সাহায্য ছাড়া বড় ধরনের কোনো সহযোগিতা পাননি কেউ। আর্থিক সংকটের কারণে তারা ঘর সংস্কার করতে পারছেন না অনেকেই। যাদের ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে,তাদের আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে প্রয়োজন হবে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকার। ইতিমধ্যে সরকারি যে সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে তা তাদের জন্য কোনো কাজে আসছে না । তবে সরকার যদি ‘জমি আছে, ঘর নাই’ এ প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা গেলে তারা নতুন করে অনেকেই বাঁচার সুযোগ হবে।
তবে জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পাল জানান, ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের জন্য আরো সাহায্য চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে রামগতিতে ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে ঢেউটিন,শুকনো খাবার,চাউলসহ নগদ তিন হাজার টাকা করে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো যাতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে, সেজন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে জেলা প্রশাসন থেকে।