আসন্ন ঈদ-উল-ফিতরের আগে ও পরে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নদীবেষ্টিত দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ নারীর টানে বাড়িতে ফিরবেন। এরমধ্যে শুধু নৌ-পথেই অন্তত আট লাখ ও সড়ক পথে দুইলাখ এবং শৌখিন যাত্রীরা আকাশ পথে যাতায়াত করবেন বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ঈদে নিরাপদে যাত্রী পরিবহনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে নৌ, আকাশ এবং সড়ক পথ। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত কয়েক বছরের ন্যায় এবারও তিনটি পথ সচল থাকায় কোন প্রকার ঝক্কিঝামেলা ছাড়াই নিরাপদ ও আরামদায়ক অবস্থায় ঈদে নারীর টানে শেকরের কাছে যাতায়াত করতে যাচ্ছেন ঈদে ঘরমুখী দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা।
নৌ, আকাশ ও সড়ক পথে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বেসরকারী কোম্পানীগুলো ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও সরকারী সড়ক, নৌ ও আকাশ পরিবহন খাতে তেমন কোন অবদান থাকছে না। রাষ্ট্রীয় নৌ-পরিবহন সংস্থা বিআইডব্লিউটিসি এবং সড়ক পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির অবস্থা সাস্প্রতিককালের চেয়ে এবার সবচেয়ে করুণ অবস্থায় রয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় পতাকাবাহী আকাশ পরিবহন সংস্থাটি ঈদ উপলক্ষে ভাড়া প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি করলেও কোন বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করছে না। ফলে প্রতিটি পরিবহন খাতেই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ঈদ যাত্রায় রমরমা ব্যবসার সব আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছেন। রাষ্ট্রীয় সড়ক, নৌ ও আকাশ পরিবহন সংস্থার উদাসীনতা আর ব্যর্থতার সুযোগে বেসরকারী লঞ্চ, বাস ও বিমানের প্রতিটি খাতেও ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। বাড়তি ভাড়ায়ও লঞ্চ, বাস ও উড়োজাহাজের একটি টিকিটের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে ঈদে ঘরমুখী যাত্রীরা।
ঈদ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৩০টি নৌ-রুটে এবারও শতাধিক বেসরকারী নৌযান যাত্রী পরিবহন করবে। এরমধ্যে শুধু ঢাকা-বরিশাল-ঢাকা নৌপথেই দুটি ক্যাটামেরনসহ মোট ২৩টি নৌযান চলাচল করবে। আগামি ২ জুন থেকে ৫ জুন পর্যন্ত বেসরকারী নৌযানগুলো বিশেষ সার্ভিসে প্রতিদিন ডবল ট্রিপে যাত্রী বহন করবে। আবার ঈদের পর ৮ জুন থেকে কমপক্ষে এক সপ্তাহ এসব নৌযান প্রতিদিন ডাবল ট্রিপে বরিশাল বন্দর থেকে ঢাকার সদরঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রী বহন করবে।
একইভাবে ঢাকা থেকে ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ঝালকাঠীসহ জেলাগুলোর বিভিন্ন রুটেও অতিরিক্ত যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল করবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে এ অবস্থায়ও রাষ্ট্রীয় বিআইডব্লিউটিসি ঈদে ঘরমুখো দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের জন্য কিছুই করতে পারছে না। সংস্থাটির নতুন পুরনো আটটি যাত্রীবাহী নৌযানের মধ্যে ‘এমভি সোনারগাঁও ও পিএস অষ্ট্রিচ’ নৌযান দুটি বিনা দরপত্রে বেসরকারী খাতে পানশালার জন্য ইজারা দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ‘পিএস মাহসুদ’র ছাঁদ চুইয়ে পানি পড়ায় সারাবছর অপেক্ষার পরে মেরামতে পাঠানো হয়েছে রমজানের কিছুদিন আগে। ‘পিএস লেপচা ও পিএস টার্ণ’র অবকাঠামো, মূল ইঞ্জিন ও প্যাডেলের দুরবস্থা এখন সব বর্ণনার বাইরে। তবে এসব প্যাডেল জাহাজের প্রায় আড়াইগুণ অতিরিক্ত জ¦ালানি ব্যয়ের লোকসানী দুটি জাহাজ ‘এমভি মধুমতি ও এমভি বাঙালি’ থাকছে এবারের ঈদ যাত্রায়।
তবে বিআইডব্লিউটিসি’র নৌযানগুলো ঢাকা ও বরিশাল থেকে যে সময়ে গন্তব্যে যাত্রা করে, তখন কোন যাত্রী স্টেশনে পৌঁছাতে পারেনা। ফলে বেসরকারী নৌযানগুলো যেখানে ধারন ক্ষমতার তিনগুন পর্যন্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করে, সেখানে সরকারী নৌযানে ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রীও পায়না। পাশাপাশি ঈদের আগে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে সংস্থাটি কয়েকটি ‘বিশেষ সার্ভিস’ পরিচালনা করলেও ঈদ পরবর্তী কর্মস্থলমুখী যাত্রী পরিবহনে তাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।
লঞ্চের ৩০ শতাংশ কেবিন অনলাইনে বিক্রি ॥ পবিত্র ঈদ-উল ফিতর উপলক্ষে ঢাকা থেকে বরিশালসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের বাড়ি ফেরার জন্য লঞ্চ কেবিনের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে গত ২০ মে সকাল থেকে। বিআইডব্লিউটিএ-এর চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুব-উল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, লঞ্চ কেবিনের আগাম টিকিট ৩০ শতাংশ অনলাইনে এবং ৭০ শতাংশ টিকিট সংশ্লিষ্ট লঞ্চ কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত কাউন্টারে বিক্রি করছে। বিআইডব্লিউটিসি’র চেয়ারম্যান প্রণয় কান্তি বিশ্বাস জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদের সময় সদরঘাট থেকে বরিশালের উদ্দেশ্যে বিআইডব্লিউটিসি’র পাঁচটি জাহাজ চলাচল করবে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম-হাতিয়া-বরিশাল রুটে তিনটি জাহাজ চলাচল করবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের অগ্রিম টিকিট বলে সেরকম কিছু নেই। যেকোনো সময় যেকেউ আসলে জাহাজের টিকিট সংগ্রহ করতে পারবেন।
ঢাকা নদী বন্দরের (সদরঘাট) নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক আলমগীর কবির জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদের ৩/৪ দিন আগে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ লোক সদরঘাট দিয়ে নদীপথে গ্রামের বাড়িতে যাবে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বেসরকারী ২১৫টি লঞ্চ রয়েছে। সদরঘাট থেকে দেশের বিভিন্নস্থানের ৪৩টি রুটে লঞ্চ চলাচল করে। ঈদে ঘরমুখো মানুষকে স্বাচ্ছন্দে গন্তব্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে বিআইডব্লিউটিএ-এর সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আগামি ৩০ মে থেকে পুরোপুরি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, বরিশালের উদ্দেশ্যে দিনের লঞ্চগুলো সকাল আটটা, সাড়ে আটটা ও বেলা আড়াইটায় সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাবে। এ ছাড়া যাত্রী সাধারণের সুবিধার জন্য ঢাকা থেকে চাঁদপুর, শরীয়তপুর ও ডামুড্যা রুটে ঈদ উপলক্ষে মোট ২৬টি লঞ্চ দিন-রাত চলাচল করবে। বিআইডব্লিউটিসি’র দৌলতদিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সফিকুল ইসলাম বলেন, ঈদের আগে ও পরের ছয়দিন এ রুটে পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার বন্ধ থাকবে এবং যাত্রীদের যাত্রা নির্বিঘœ করতে ২০টি ফেরি চলাচল করবে।
মহাসড়কে নেই খানাখন্দ ॥ অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে নেই কোন খানাখন্দ। ফলে যাত্রীরা নিরাপদেই এবার সড়ক পথে তাদের গন্তব্যে যাতায়াত করতে পারবেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারও ঈদের আগে ও পরে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে প্রতিদিন গড়ে তিনশ’ বেসরকারী বাস রাজধানী ঢাকাসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে চলাচলের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করলেও রাষ্ট্রীয় বিআরটিসির বরিশাল বাস ডিপোতে অচল গাড়ির ভাগারে পরিনত হয়েছে। এই ডিপোটিতে সাম্প্রতিককালের প্রায় অর্ধশত বাস থাকলেও এখন সচল গাড়ির সংখ্যা ৩০টিরও নিচে। যারমধ্যে মাত্র আটটি নতুন বাস রয়েছে। ইতোপূর্বে বরিশাল থেকে মাওয়া রুটে এসি বাস চলাচল করলেও এখন তা অতীত। পাশাপাশি মাওয়া-বরিশাল রুটে শতাধিক মাইক্রোবাসে যাত্রী পরিবহনে প্রস্তুত করা হয়েছে।
আকাশ পথে তিন বিমান ॥ বরিশাল-ঢাকা আকাশ পথে জাতীয় পতাকাবাহী বিমানের উড়ান এখনো সপ্তাহে মাত্র পাঁচটি। ঈদ উপলক্ষে কোন বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করছে না রাষ্ট্রীয় এই আকাশ পরিবহন সংস্থাটি। তবে ভাড়া ২৭শ’ টাকার স্থলে তারা সাড়ে সাত হাজার টাকায় উন্নীত করেছে। অপরদিকে বেসরকারী নভোএয়ার প্রতিদিন ফ্লাইট পরিচালনার করছে। বেসরকারী ইউএস-বাংলা এয়ারওয়েজও ঈদের আগে চারটি বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করছে বরিশাল সেক্টরে। যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী বেসরকারী বিমান তাদের ফ্লাইট বাড়াবেন বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।