সহস্রাধিক জঙ্গি দেশের কারাগারগুলো থেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছে। নিরাপত্তার জন্য হুমকিপূর্ণ ওসব জঙ্গিরা গোপন এ্যাপসের মাধ্যমে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। গত ৩ বছরে সারাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত অভিযানে ২ সহস্রাধিক জঙ্গিকে গ্রেফতার হয়েছিল। তার মধ্যে নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), আনসার আল ইসলাম, হিযবুত তাহরীর ও হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি) জঙ্গিরা রয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে বিপুলসংখ্যক জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছে। তারা যে কোনো দেশে নাশকতামূলক হামলা চালানোর আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পলাতক জঙ্গিদেও বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১৬ থেকে ’১৮ সালের নবেম্বর পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ বিভিন্ন কারাগার থেকে জামিন নিয়ে সহস্রাধিক জঙ্গি বাইরে বেরিয়েছে। তারপর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বেশিরভাগের হদিস পাচ্ছে না। তবে জামিনের মাধ্যমে কারাগার থেকে বাইরে বেরিয়েই ওসব জঙ্গি সদস্য আড়ালে চলে যাওয়ার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ। জানা যায়, পলাতক জঙ্গিরা দেশের অভ্যন্তরে আত্মগোপন করে বিভিন্ন গোপন এ্যাপসের মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরেও পলাতক জঙ্গিদের অপতৎপরতার তথ্য রয়েছে। দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা কারাগারের বাইরে বেরিয়ে আসার কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নানামুখী জঙ্গি তৎপরতা শুরু হওয়ার বিষয়ে আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে হিযবুত তাহরীর থেকে আসা এবিটির বেশিরভাগ জঙ্গিই অত্যন্ত মেধাবী। ওই সংগঠনের জঙ্গিরা মাঝে মধ্যে প্রকাশ্যে মিছিল করে। দেয়ালে পোস্টারসহ নানা ধরনের তৎপরতাও চালায়।
সূত্র জানায়, পলাতক জঙ্গিদের অনেকেই পালিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গিয়ে ধরা পড়ছে। বেশিরভাগ জঙ্গি পালানোর আগে ছদ্মনামে পাসপোর্ট ও বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরি করে বিধায় তাদের দেশত্যাগের বিষয়টি মনিটরিং করা যায় না। প্রকৃত নাম-পরিচয় ও অবস্থানের নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করতে পারলে পুলিশ সদর দফতরের এনসিবির মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
সূত্র আরো জানায়, গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় দেশের বিভিন্ন জেলায় পলাতক রয়েছে এমন সংখ্যা সহস্রাধিক। তার মধ্যে সাতক্ষীরা জেলা থেকে ৭ জঙ্গি, মেহেরপুর জেলা থেকে ৩, ঝিনাইদহ থেকে ৬, মাগুরা থেকে ৭, সিলেট জেলা থেকে ২ (হুজি), মৌলভীবাজার থেকে ৩ (জেএমবি), হবিগঞ্জের ১৩, বরিশালের ১৯, বরগুনা জেলার ৩৯, ঝালকাঠির ৩, পটুয়াখালীর ২, পিরোজপুরের ৯, রংপুরে ৯, ঠাকুরগাঁওয়ে ৩০, দিনাজপুরে ১৭, নীলফামারীতে ১৬, কুড়িগ্রামে ৮, পঞ্চগড়ে ২, গাইবান্ধায় ২১ ও লালমনিরহাট জেলার সন্ত্রাসবিরোধী ও বিস্ফোরক আইনের মামলার ৭ জঙ্গি জামিন নিয়েছে। একইভাবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ২৭, ঢাকা জেলার ৩২, নারায়ণগঞ্জের ১৬, টাঙ্গাইলে ২২, গাজীপুরে ২২, ফরিদপুরে ১৪, মাদারীপুরে ১৫, রাজবাড়ীতে ৫, গোপালগঞ্জে ১০, শরীয়তপুরে ২, কিশোরগঞ্জে ১০, নরসিংদী জেলার ৭, মানিকগঞ্জের ৫, মুন্সীগঞ্জের ১২, ময়মনসিংহের ৫০, নেত্রকোনার ৬, শেরপুরে ৯, জামালপুরে ৩১, রাজশাহীতে ২০, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩০, জয়পুরহাটে ৩৬, নওগাঁর ৭, নাটোরে ৮, বগুড়ার ১৬, পাবনার ১৬, সিরাজগঞ্জে ৭, সিএমপির ১৪, চট্টগ্রামের ৩১, কক্সবাজারে ৯, কুমিল্লার ১৪, নোয়াখালীর ২৩, বি-বাড়িয়ার ২৮, চাঁদপুরের ২৭, লক্ষ্মীপুরের ১৮, ফেনী ১৫, খাগড়াছড়ির ১, রাঙ্গামাটির ১, কেএমপির ২৩, খুলনার ৩, চুয়াডাঙ্গার ৭, যশোর ৭, নড়াইলের ২, কুষ্টিয়ার ১৬, বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন থানার তালিকাভুক্ত ১৩ জঙ্গি আত্মগোপন করেছে।
এদিকে জঙ্গি তৎপরতা রোধে পুলিশ কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকার নির্দেশ জারি করেছে পুলিশ সদর দফতর। পাশাপাশি দেশে চলমান মেগা প্রকল্পে কর্মরত বিদেশীদের নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। তাদের ওপর নজর রাখার কথাও বলা হয়েছে। সম্প্রতি এক অপরাধ পর্যালোচনা সভা শেষে পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী এমন নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, দেশে জঙ্গী কর্মকা- কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে আছে। জঙ্গিদের তৎপরতা যাতে কোনভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের অত্যন্ত সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। জঙ্গি তৎপরতা রোধে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন ও ব্লক রেইড পদ্ধতিতে অভিযান চালাতে হবে। পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম জোরদার করে আগাম তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়মিত মনিটর করতে হবে। জঙ্গিদের সম্পর্কে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে। ওসব মেগা প্রকল্পে কর্মরত এবং দেশে বসবাসকারী বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ জানান, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫১২ জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তবে আদালত থেকে এখন পর্যন্ত ৩শ জঙ্গী জামিনে বের হয়েছে এবং তাদের অধিকাংশই পলাতক। আর জামিনে পলাতক থাকা জঙ্গিরা আবারও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে জঙ্গি হামলার ঝুঁকি রয়েছে। র্যাবের নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স ও অন্য ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির সঙ্গে সমন্বয় করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় র্যাব প্রস্তুত।