রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলাধীন নাগরী ইউনিয়নের বড়কাউ ও পাড়াবর্থা মৌজায় এল,এ কেস নং ০২/২০০০-২০০১, ০৭/২০০১-২০০২ ও ০৩/২০০০-২০০১ এর আওতায় অধিগ্রহণকৃত জমির মূল্যে অধিবাসীদের মধ্যে ৩ কাঠা ও ৫ কাঠা আয়তনে আবাসিক প্লট বরাদ্দের জন্য নামে-বেনামে অনেকে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে জমির মালিকানা দাবি করে আবেদন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অধিবাসী ছাড়া অন্যান্যের নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্লট হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও তার ভাগিনার বিরুদ্ধে।
উপজেলার নাগরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল কাদির মিয়া ও তার ভাগিনা অলিউল ইসলাম অলি স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে সেবা প্রত্যাশী সংস্থার কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে শ্যালক, ভায়রার ছেলে-মেয়ে, শ্বশুর, জেঠাস, কাজের মেয়ে, গাড়ি চালকের নামে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কিন্তু যাদের নামে প্লটের আবেদন করেছেন তারা কেহই দুই মৌজার স্থানীয় বাসিন্ধা বা জমির বৈধ মালিক নয়। স্থানীয় চক্র তাদের পরিচয় গোপন করে তাদের নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরীর মাধ্যমে তা প্রকল্পে জমা দিয়ে প্লটের জন্য আবেদন করেছে। বর্তমানে এ নিয়ে এলাকায় আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে। জমির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি সাথে না দিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দপ্তর থেকে বড়কাউ গ্রামের ঠিকানায় জন্ম নিবন্ধন তৈরী করে সাথে অন্যান্য ভুয়া কাগজপত্র সংযুক্ত করে প্লটের জালিয়াতির পাঁয়তারা করার অভিযোগ উঠেছে ওই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে।
জানা যায়, ওই দুই মৌজায় যাদের পৈত্রিক বা বৈধ ক্রয়কৃত সম্পত্তি ও বাড়িঘর রয়েছে, যাদের জমি ছিল কিন্তু ঘরবাড়ি ছিলনা সেই সব অধিবাসী, ক্ষতিগ্রস্ত ও সরকারিভাবে এলডি লটারির মাধ্যমে পূর্বাচলে প্লট পাওয়ার বিধান থাকলেও পূর্বাচলের প্লট নীতিমালা উপেক্ষা করে জালিয়াতি চক্রটি এলএ অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব অনিয়ম করেছেন।
ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরবর্তী নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলাধীন নাগরী ইউনিয়নের বড়কাউ ও পাড়াবর্থা মৌজার বালু নদী ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে প্রস্তাবিত পূর্বাচল নতুন প্রকল্প। প্রকল্পটি ১৯৯৫ সালের জুলাই থেকে ২০১০ সালের জুন নাগাদ বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদন হয় ২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। শুরুতেই ১০ বছর দেরিতে প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়ায় তার ব্যয় ধরা হয়েছিল তিন হাজার ৩১২ কোটি টাকা। পরে চার বার ওই প্রকল্প সংশোধন শেষে সংশোধনী ব্যয় ধরা হয় সাত হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। আরো জানা যায়, গত ২০১৮ সানের ৩০ মে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের বড়কাউ ও পাড়াবর্থা মৌজায় অধিগ্রহণকৃত জমির মূল্যে অধিবাসীদের মধ্যে ৩ কাঠা ও ৫ কাঠা আয়তনে আবাসিক প্লট বরাদ্দের জন্য রাজউক ভবনস্থ সোনালী/জনতা/অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের শাখা সমূহে অফেরতযোগ্য নগদ ১ হাজার টাকা জমা প্রদান করে আবেদন পত্রের ফরম ও প্রসপেক্টাস সংগ্রহের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়। সেই আলোকে স্থানীয় নাগরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল কাদির মিয়া ও তার ভাগিনা মো. অলিউল প্রভাব খাটিয়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এল,এ শাখার কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ঐ চক্রটি তাদের কাজের মেয়ে, গাড়ির চালক, ভায়রার ছেলে-মেয়ে, জামাতার নামসহ প্রায় দেড় শতাধিক লোকের নামে বেআইনিভাবে প্লটের জন্য আবেদন করেন। যাদের নামে ওই দুই মৌজায় কোনো জমিজমা, ঘরবাড়ি নেই। কিন্তু চক্রটি আইনকে বৃদ্ধাগুলি প্রদর্শন করে তাদের নামে জমি ও ঘরবাড়ির ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলন করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায, নাগরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল কাদির মিয়ার তার বাসার সাবেক কাজের মেয়ে হাসি আক্তারের নামে তিন কাঠা প্লটের জন্য আবেদন করেন। যার সিরিয়াল নং ১১৮০। এমআর নং ৩৬২৭৩। ওই হাসি আক্তারের নামে বড়কাউ মৌজার কোন খতিয়ানে তার নাম নেই। এবং তার কোনো ঘরবাড়ী ও জমিজমা নেই। চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার ইউনিয়নের টাহুরদিয়া গ্রামের মৃত অকিল উদ্দিন ও বানেছা আক্তারের ছেলে মো. স্বপন মিয়ার নামে বড়কাউ মৌজায় প্লটের জন্য আবেদন করেন। যার কোনো জমিজমা ও ঘরবাড়ী নেই। কিন্তু চক্রটি মো. স্বপন মিয়ার নামে বড়কাউ মৌজার ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে ৫ কাঠা প্লটের জন্য আবেদন করেন। যার সিরিয়ালল নম্বর ১০৬৯, এমআর নম্বর ৩৫৬৮৬।
চেয়ারম্যানের তিন শালক মো. নাজিমউদ্দিন সরকার, নাজির সরকার ও জামান সরকার পিতা মৃত লেহাজউদ্দিন এর নামে ৩ কাঠা করে পৃথক ৩টি প্লটের জন্য আবেদন করেন। যারা প্রকৃত পক্ষে বড়কাউ মৌজার অধিবাসী নয়। তারা গাজীপুর সদরের পুবাইল থানাধীন বাড়ৈবাড়ী গ্রামের স্থায়ী বাসিন্ধা। নাজিমউদ্দিনের নামে আবেদনের সিরিয়াল নম্বর ১১৮৪, এমআর নম্বর ৩৬২৭৮। নাজির সরকারের নামে আবেদনের সিরিয়াল নম্বর ১০৫০, এমআর নম্বর ৩৫৬৪২। জামান সরকারের নামে আবেদনের সিরিয়াল নম্বর ১১৮৩, এমআর নম¦র ৩৬২৭৬। এ ছাড়া চেয়ারম্যানের ভায়রা মৃত ওসমান সরকারের ছেলে নাসির সরকারের নামে আবেদন করেন। যার সিরিয়াল নম্বর ১০৬৩, এম আর নম্বর ৩৫৬৭৭। চেয়ারম্যানের ভায়রার মেয়ে লুৎফা বেগমের নামে আবেদন করেন। যার সিরিয়াল নম্বর ১০৬৪, এম আর নম্বর ৩৫৬৭৯। তারা প্রকৃত পক্ষে পূবাইল থানার খিলগাঁও এলাকার স্থায়ী বাসিন্ধা। বড়কাউ মৌজায় তাদের নামে কোনো জমিজমা বা ঘরবাড়ী নেই। উল্লিখিত ব্যক্তিদের নামে বড়কাউ মৌজার আরএস ৫৯১ ও ১২০৭ দাগে জমি থাকার আবেদন করলেও প্রকৃত পক্ষে তাদের নামে ওই দাগে কোনো জমিজমা নেই। পাড়াবর্তা মৌজায় আরএস ৩১৭ দাগে জমি থাকার আবেদন করলেও প্রকৃত পক্ষে অনুসন্ধানে জানা যায় ওই দাগের মালিক আর্চ বিশপ গং। এ ছাড়া বড়কাউ মৌজায় ১৩২৯ আরএস দাগ উল্লেখ করে মৃত শাহাজউদ্দিনের দুই ছেলে জিল্লুর রহমান ও মতিউর রহমান প্লটের জন্য আবেদন করেন। যার প্রকৃত মালিক বড়কাউ গ্রামের মৃত শাহাজদ্দিনের ছেলে মজিবুর রহমান।
অলির মামাতো বোন খাদিজা আক্তার তিশার নামে বড়কাউ মৌজার ৩৩৩ আরএস নম্বর দাগের মালিক হিসাবে প্লটের জন্য আবেদন করেন। যার মালিক করম আলীর ছেলে কফিল, সেরাজউদ্দিন সাহাজউদ্দিন ও মোন্তাজউদ্দিন গং। কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের বড়কাউ ও পাড়াবর্থা মৌজায় এল,এ কেস নং ০২/২০০০-২০০১,০৭/২০০১-২০০২ ও ০৩/২০০০-২০০১ এর আওতায় প্রকল্পের অধিগ্রহণ শুরু হয়। প্লটের জন্য আবেদনকারী খাদিজা আক্তার তিশার আবেদন পত্রের সাথে প্রদানকৃত কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় তার জন্ম তারিখ ২ জুন ২০০৫ ইং। যার সিরিয়াল নম্বর ১১৮৫, এম আর নম্বর ৩৬২৭৯। জনমনে প্রশ্ন ২০০৫ সনে জন্ম হয়েও কিভাবে অধিবাসী হিসেবে তার নামে ঘর সার্ভেয়ার হয়েছে এবং তার নামেও প্লট বরাদ্দের আবেদন করা হয়েছে।
রুপগঞ্জ থানার শিমুলিয়া গ্রামের আনোয়ার হোসেনের কন্যা আজাহার হোসেন এর স্ত্রী অলির জেঠাস রুনা আক্তার ও রুনিয়া আক্তার এবং শ্বশুর আনোয়ার হোসেন বড়কাউ মৌজায় প্লটের জন্য আবেদন করেন। যার সিরিয়াল নং রুনা ১০৮১, এমআর নং ৩৫৭০১, রুনিয়া সিরিয়াল নং ১০৮০, এম আর নং ৩৫৬৯৯ এবং আনোয়ার সিরিয়াল নং ১০৯২, এম আর নং ৩৫৭১৩।
কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান বলেন, বড়কাউ মৌজায় ১৩২৯ আরএস দাগের জমির মালিক আমরা হলেও এলএ অফিস থেকে ক্ষতিপূরণের কোন টাকা পাইনি। টাকার বিষয়ে অফিসে যোগাযোগ করে জানতে পারি পাশ্ববর্তী তালিয়া গ্রামের বিল্লাল হোসেনের দুই ছেলে জিল্লুর রহমান ও মতিউর রহমান তাদের নামে ওই জমির কাগজপত্র দেখিয়ে বিল উত্তোলন করেছেন। এবং প্লটের জন্য আবেদন করেছেন। যাদের আবেদনের সিরিয়াল নং ১২৪৯, এমআর নং ৩৬৩৫৩ এবং সিরিয়াল নং ১২৪৭, এমআর নম্বর ৩৬৩৫১।
এ বিষয়ে নাগরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল কাদির মিয়া জানান, প্লটের জন্য আবেদনকারীদের বাড়ি নাগরী ইউনিয়নের নগরভেলা গ্রামে। কিন্তু প্লটের জন্য আবেদন পত্রে দাখিলকৃত কাগজে তাদের বাড়ী বড়কাউ উল্লেখ থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তাৎক্ষনিক কথা ঘুড়িয়ে বলেন তাদের বাড়ি আগে বড়কাউ গ্রামের বাসিন্ধা ছিল। তবে স্থানীয়রা জানান, যাদের নামে চেয়ারম্যান প্লটের জন্য আবেদন করেছেন তারা কেউই বড়কাউ মৌজার বাসিন্দা ছিল না।
এ ব্যাপারে রাজউক চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহম্মেদ এর সাথে মোবাইল ফোনে বিস্তারিত আলোচনা করলে তিনি এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। এ ব্যাপারে রাজউক এর এস্টেট পরিচালক শেখ শাহিনুল ইসলাম ও প্রকল্প পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক এর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করে ও ফোনে ও খুদে বার্তা পাঠিয়ে তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। পরে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবু সাইদ খন্দকারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি এ ব্যাপারে বক্তব্য দিতে অনীহা প্রকাশ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলার জন্য অনুরোধ করেন।
গাজীপুর জেলার এলএ অফিসের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা রবিউল আলম এর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ঢাকার হাইকোর্টে বিশেষ কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। কথা বলা সম্ভব নয় বলে ফোন রেখে দেন। গাজীপুর জেলার এলএ অফিসের সার্ভেয়ার মো. ফারুক মিয়ার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমি আগে এ অফিসে ছিলাম, এখন এই শাখার দায়িত্বে নেই। এ ব্যাপারে সার্ভেয়ার মো. বেলালুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, দুই বছর যাবত আমি এ শাখায় নেই। তবে নাগরী ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল কাদির নিজে অফিসে এসে ওইসব লোকদের নাগরিকত্ব সনদপত্রসহ কাগজপত্র জমা দিয়ে ছিলেন। গাজীপুর জেলার এলএ অফিসের কানুনগো আজাহার কাজীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমি অন্যত্র বদলি হয়ে চলে গেছি। বর্তমান কানুনগো এর সাথে কথা বলেন। পরে গাজীপুর এলএ অফিসের বর্তমান কানুনগো আবুল বাশার এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, কাদির চেয়ারম্যান ও তার ভাগিনা অলি এবং তার পরিবারের লোকজন বিগত বিএনপির আমলে এলাকায় থাকতে পারেনি। পরে মিস কেসের মাধ্যমে সময় বাড়ীয়ে প্রায় দেড়শ শতাধিক ব্যক্তির নামে প্লটের জন্য আবেদন করেন।