মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের নির্দেশনায়, রায়গঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আয়োজনে ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলায় ২০১৮ সালে চুড়ান্ত পর্যায়ে নির্বাচিত হয়েছেন ৪জন সংগ্রামী সফল নারী। জীবন যুদ্ধে নানান চড়াই উৎরাই ও প্রতিকুলতা পার করে জয়ি হয়েছেন নিজেরা যার যার কর্মস্থলে। এখন তাঁরা সমাজের নির্যাতিত নিপীড়িত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য সংগ্রাম করছে এবং নিরলসভাবে কাজ করছে। প্রাপ্ত আবেদন পত্র সমূহের তথ্যাবলি যাচাই বাছাই ও নম্বরের ভিত্তিতে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী, সফল জননী নারী, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী ও সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী এই ৪ ক্যাটাগরিতে ২০১৯ সালে ৪জন জয়িতাকে অত্র উপজেলায় শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসাবে নির্বাচন করা হয়।
এমনি অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী এক নারী- উপজেলার চান্দাইকোনা গ্রামের চান্দাইকোনা ইউনিয়নের দয়া রানী সরকার, স্বামী পলান চন্দ্র।
বিয়ে হয় দরিদ্র হালদার পরিবারে। সংসার চলত অতি কষ্টে। স্বামীর সংসারে সময় পার হত খেয়ে না খেয়ে। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে সন্তান নিয়ে সংসারে অভাব থাকলেও সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁকে সংসার চালাতে হতো। টিনের ঘরে বর্ষার সময় বৃষ্টির পানিতে বিছানা ভিজে যেত। স্বামীর উপার্জনের টাকায় সংসার খুবই কষ্টে চলত। বাড়িতে দিনে একবার রান্না হতো। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কষ্ট সইতে না পেরে প্রথমে কুরুজ কাঁটা দিয়ে টুপি তৈরি করে বিক্রয় করতেন। সুতা তোলার কাজ, মানুষের বাড়ীতে দিন মজুরের কাজ, পাপড় তৈরি করে গ্রামের আশপাশে বিক্রি করতেন। পরে দর্জির কাজ শিখে একটি সেলাই মেশিন কিনেন। বাড়ীতে বসে এলাকার মেয়েদের জামা তৈরি কাজ করে উপার্জন শুরু করেন। তার আর্থিক অবস্থা এখন অনেক ভাল। মেয়েকে একটি ভালো পরিবারের সাথে বিয়ে দিয়ে তার সংসার ভালো এবং সুখে বসবাস করছে। নিয়মিত দর্জির কাজ করছেন এবং বাড়িতে একটি মুদি দোকান দিয়েছেন। বাড়িতে আর টিনের বেড়া নাই বিল্ডিং বাড়ি হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হয়ে এলাকায় জাগরণ সৃষ্টি করেছেন এবং সামাজিকভাবে মান মর্যাদা বৃদ্ধি হয়েছে।
সফল জননী নারীঃ-
স্বপ্না রানী সরকার, স্বামী- অন্তিম কুমার সরকার, গ্রাম- ধলজান, ডাকঘর- দেওভোগ, উপজেলা-রায়গঞ্জ, জেলা-সিরাজগঞ্জ। ছোট বেলা থেকে বাবার পরিবার ছিল অতি দরিদ্র তাই লেখাপড়ার খরচ চালাতে না পারায় ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর অন্তিম কুমার সরকারের সাথে বিয়ে হয়। গরীব কৃষক স্বামীর সংসার স্বচ্ছল ছিল না। ছেলে গ্রামের উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৫.০০ পেয়ে এস. এস. সি পাশ করে। এরপর উল্লাপাড়া আকবর আলী কলেজ থেকে জিপিএ ৪.৫০ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিকপাশ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা নর্থ সাউথ ইষ্ট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। সেখান থেকে প্রথম শ্রেণিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে স্কলারশীপে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পায়। বিদেশে পড়ালেখা করার খরচ যোগাতে না পারলেও তিনি দমে যান নি। যে টুকু জমি ছিল তা বিক্রি করে স্বামীর সাথে মাঠে কাজ করে এবং অন্যের বাড়িতে কাজ করে ছেলের পড়াশোনার টাকা জোগাড় করেন। ছেলে আমেরিকার কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আমেরিকার একটি ভাল কোম্পানীতে কাজ করছে। আজ তিনি সফল মা হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করেন।
নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছে যে নারী ঃ
মোছাঃ রাশিদা খাতুন, স্বামী- মহসিন, মাতার নাম- আকলিমা বেগম, গ্রাম- কাঁঠাল বাড়িয়া, ডাকঘর- গোয়ালিয়ার চর, উপজেলা- রায়গঞ্জ, জেলা- সিরাজগঞ্জ। ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া করে মানুষের মত মানুষ হবে। কিন্তু বাবা মায়ের অভাবের সংসারের কারণে লেখাপড়া না করিয়ে বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু যৌতুকলোভী স্বামী ও তার পরিবারের নির্যাতনের শিকার হয়ে তালাক প্রাপ্ত হন। বাবা ও ভাই ভরণপোষ করতে না পেরে দ্বিতীয় বিবাহ দেয়। দ্বিতীয় স্বামী মহসিন মাতাল হওয়ায় দুঃখ-দূর্দশা আরও বেয়ে যায় এবং স্বামী মাঝে মধ্যে মারধরও করতে থাকে। এরই এক পর্যায় মেয়ে সন্তান জন্ম নিলে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। পরে সেলাই মেশিনের কাজ শিখে এলাকার মেয়েদের দর্জি কাজ করে, গরু পালন ও হাঁস এর ফার্ম করে আস্তে আস্তে আয় বাড়তে থাকে। এখন তাঁর ফার্মে ৩৫০টি হাঁস রয়েছে এবং ফার্মে ৩জন কাজ করে তারাও আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা অর্জন করেছে। গ্রামে অনেকেই আমার দেখাদেখি এই কাজগুলো করছে।
সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখেছেন যে নারী ঃ
মোছাঃ খোদেজা বেগম, স্বামী- মোঃ আঃ ছাত্তার, গ্রাম-ভুইয়াগাঁতী, ইউনিয়ন-ঘুড়কা, উপজেলা- রায়গঞ্জ, জেলা- সিরাজগঞ্জ। নীভৃত পল্লীর নদীর চর বেষ্টিত জায়গাতে বসবাস করেও তিনি স্বীয় প্রচেষ্টা ও নিজেরা করি এনজিও এর সহযোগিতায় সমাজ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। চরাঞ্চলের অনগ্রসর শিক্ষা বঞ্চিতদের বাবা-মাকে বুঝিয়ে তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে ভর্তি হতে উৎসাহ প্রদান ও সহযোগিতা করা, বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে ভুমিহীন সমিতির উঠান বৈঠকে আলোচনা করে ধারণা প্রদান করে চলতি বছরে ৬টি বাল্য বিয়ে ও ৩টি যৌতুক দিয়ে বিয়ে বন্ধ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এছাড়াও মাদককে না বলার উদ্যোগ হিসেবে নিজ বাড়ী ও পার্শ্ববর্তী বাড়ীগুলোতে যুবক-যুবতীদের নিয়ে মাদকের খারাপ দিকগুলি নিয়ে আলোচনা করে ধারণা প্রদান করে আসছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী তাই সমাজের নারী-পুরুষের সমতা আনার লক্ষ্যে সকল অসঙ্গতি দূর করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।