আজ ৬ জুলাই, ১৯৭১ সালের এই দিনে শেরপুরের রাঙামাটিয়া খাটুয়াপাড়া গ্রামে ঘটেছিল বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। এই যুদ্ধে শহীদ হন কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসান, আলী হোসেন ও মোফাজ্জল হোসেনসহ নাম না জানা আরো অনেক মুক্তিকামী জনতা। স্বাধীনতার ৪ যুগ পেরিয়ে গেলেও তালিকায় নাম নেই খাটুয়াপাড়া গ্রামের শহীদদের, নেই কোন স্মৃতিস্তম্ভ, কালের স্বাক্ষী হয়ে পড়ে আছে ঐতিহাসিক কাঁটাখালী ব্রীজটি।
১৯৭১ সালের ৪ জুলাই ভোরে কোম্পানি কমান্ডার এন এম নাজমুল আহসানের নেতৃত্বে ৫৩ জনের মুক্তিযোদ্ধার দল অবস্থান নেন রাঙামাটিয়া গ্রামে আতর আলীর বাড়ীতে। পরিকল্পনা মতে ৫ জুলাই রাতে সফলতার সঙ্গে অপারেশন শেষ করে মুক্তিযোদ্ধারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে আশ্রয় নেয় খাটুয়াপাড়ার হাজী নঈমদ্দিন ও হাজী শুকুর মামুদের বাড়িতে। বাড়ির চারপাশে ছিল প্রশস্ত বিল। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে এলাকার রাজাকাররা ঝিনাইগাতী আহম্মদ নগর পাকিস্তানী ক্যম্পে খবর দেন।
৬ জুলাই সোমবার সকালে কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই গ্রামে প্রবেশের একটি মাত্র কাঁচা সড়কের দু’দিক থেকে ব্যারিকেড দেয় পাকসেনা ও রাজাকার-আলবদররা। গ্রামবাসীদের অনুরোধে মুক্তিযোদ্ধারা বিলের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মরক্ষার্থে গুলি করতে করতে পিছু হটে। এ সময় পাকহানাদারদের বেপরোয়া গোলা বর্ষণে কোম্পানি কমান্ডার ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র এন এম নাজমুল আহসান, তার চাচাত ভাই মোফাজ্জল হোসেন ও ভাতিজা আলী হোসেন শহীদ হন। বাকি মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান পেলেও, বর্বরোচিত হামলার শিকার হন খাটুয়াপাড়া রাঙামাটিয়া গ্রামের বাসিন্দারা। তাদের ৬০/৭০ জনকে কোমরে দড়ি বেঁধে লাঠিপেটা করতে করতে নিয়ে যাওয়া হয় খাটুয়াপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। আগুন লাগিয়ে দেয় বাড়িঘরে। অমানবিক নির্যাতন করে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে ৬ জন গ্রামবাসীকে। এরা হলেন, আয়াতুল¬্যা, সামেছ মিস্ত্রি, মহেন্দ্র অধিকারী, আব্বাছ আলী, আমেজ উদ্দিন ও বাদশা আলী। আহত হন অনেকে। দালালদের বাঁধার মুখে সেদিন লাশও দাফন করতে পারেননি শহীদদের স্বজনরা। কলার ভেলায় তারা লাশ ভাসিয়ে দিয়েছিলেন নদীতে। আরো ২৮ জন গ্রামবাসীকে বেঁধে রাঙামাটিয়ার কালীস্থানের বটগাছের নিচে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হানাদার বাহিনী। সকলের মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে পাকহানাদাররা চলে যায়। সেই ঘটনায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় ২৫ জন গ্রামবাসী। আহতরা এখনো শরীরে গুলি আর বেয়োনেটের ক্ষত চিহ্ন নিয়ে ধুকে ধুকে জীবন তরী পার করছে।
এলাকাবাসীর দাবী মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ তিন বীর মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি নিরীহ ৬ গ্রামবাসীকেও শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার। এদিকে শেরপুরের সচেতন মহলের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক কাঁটাখালী ব্রীজটি ভেঙ্গে ফেলার পরিবর্তে ওইখানে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ব্রীজটি সংরক্ষণ করা হয়েছে।
শেরপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার নূরুল ইসলাম হিরো বলেন, ইতোমধ্যে সরকার রাঙামাটিয়া খাটুয়াপাড়া গ্রামের একাত্তরে নির্যাতনের শিকার ৪ নারীকে বীরঙ্গণা খেতাবে ভূষিত করেছেন। নালিতাবাড়ির কৃতী সন্তান ও বর্তমান নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের সচিব আব্দস সামাদ সম্প্রতি ডিও লেটার দিয়েছেন ওই গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ফলক নির্মাণের জন্য। এ ছাড়া এলজিইডির মাধ্যমে রাঙামটিয়াসহ জেলার সকল মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি বিজরিত স্থান সমূহে ফলক নির্মাণের জরিপ করা হলেও আজো তা বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি এসব কাজ দ্রুত সম্পাদনের জন্য সরকারের প্রতি জোড় দাবী জানান।