বর্ষায় অথৈ পানিতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। শুস্ক মৌসুমে মাঠের পর মাঠ বালু চরে চলাচল করেন লালমনিরহাটের তিস্তা চরাঞ্চলের মানুষ। যোগাযোগ সমস্যার কারণে তারা বিভিন্ন নাগরিক অধিকার ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।
অপর দিকে জনগনের দোড়গোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌছে দিতে সরকারী ভাবে কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়। সেখানেও দেয়া হচ্ছে বিনামুল্যে ওষুধ ও পরামর্শ। আর এইসব কমিউনিটি ক্লিনিকই এখন চরাঞ্চলের বঞ্চিত মানুষদের স্বাস্থ্যসেবার বড় হাসপাতাল নামেই পরিচিত।
রোববার (০৮ জুলাই) দুপুরে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের তিস্তার চরের চন্ডিমারী কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রসব বেদনা নিয়ে ছুটে আসেন তিস্তা দ্বীপ চরের গ্রহবধু দিনমজুর ওবায়দুলের স্ত্রী মরিয়ম বেগম (২০)।
স্থানীয়রা জানান, স্ত্রীর প্রসব বেদনা দেখে দিশেহারা স্বামী ওবায়দুল ইসলাম স্থানীয়দের সহায়তায় স্ত্রীকে পৌছান চন্ডিমারী কমিউনিটি ক্লিনিকে। যদিও সেখানে নিরাপদ মাতৃত্বসেবা প্রদানের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। এমন রোগী পেয়ে হতভম্ব ক্লিনিকের সিএসসিপি মাইদুল ইসলাম। পুরুষ হয়ে তো এ সেবা প্রদান করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
এরই মধ্যে ক্লিনিকটি পরিদর্শনে যান উপজেলা সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি রোগী দেখে স্বাস্থ্য সহকারীর রুমে প্রসবের জন্য ব্যবস্থা করেন। কিন্তু নেই নারী সিএসসিপি। তাৎক্ষনিক ভাবে ডেকে নিয়ে আসেন পাশ্ববর্তি দক্ষিন বালাপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএসএসিপি লায়লা বেগমকে।
স্বাস্থ্য বিভাগের প্রশিক্ষন প্রাপ্ত গ্রাম্য দাইমাকেও ডাকা হয় সেখানে। চলে প্রথম বারের মত তিস্তার চরের নিরাপদ মাতৃত্ব সেবা প্রদানের সংগ্রাম। সকলে শ্বাসরুদ্ধর প্রচেষ্টা শেষে ওই দিন বিকেলে মরিয়ম বেগম একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। খবর পেয়ে সবাই স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেন।
চরাঞ্চলের কমিউনিটি ক্লিনিকে নিরাপদ মাতৃত্ব সেবা প্রদানের খবর মুহুর্তে চলে যায় স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্দ্ধতন কর্তাদের কাছে। এমন খবর শুনে খোদ জেলা সিভিল সার্জন ডা. কাশেম আলী নবজাতক ও তার মায়ের জন্য উপহার পাঠান। উপরহার থেকে বাদ পড়েননি প্রসব সেবাদানকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরাও। চরাঞ্চলের কমিউনিটি ক্লিনিকে এমন সেবা পেয়ে আনন্দিত চন্ডিমারীসহ তিস্তার দ্বীপচরের মানুষ। স্বাস্থ্যসেবা নাগরিক অধিকার হলেও তাদের জন্য এ সেবা যেন সোনার হরিণ পাওয়ার আনন্দ।
চন্ডিমারী এলাকার জোবেদা বেগম বলেন, হামরা চরের গরিব মানুষ। হামার টাকাও নাই, হাসপাতাল যাওয়ার রাস্তাও নেই। বড় সমস্যা হলে এটাই (কমিউনিটি ক্লিনিক) হামার বড় হাসপাতাল বাহে। এটা না থাকলে হামার কপালে ওষুধ জোটে না। পোয়াতি বেটিছাওয়া গুলাক (প্রসূতি মায়েদের) তো মরা লাগে। এলা আর কষ্ট হবার নায়। এটেই এলা পোয়াতিরও ছাওয়া খালাস (সন্তান প্রসব) হয়। শেকের বেটি হাসিনাক আল্লাহয় ভাল করবে বাহে।
সদ্য সন্তান প্রসব করা মরিয়ম বেগম বলেন, গরিব হওয়ার পরেও যারা আমাকে সেবা দিয়ে সুস্থ্য করেছেন। আল্লাহ তাদের মঙ্গল করবেন। এই ক্লিনিকগুলো গরিবের বড় হাসপাতাল। নিজেও আশা করিনি বেঁচে থাকার। সকল ক্লিনিকে এ সেবা চালু করার জোর দাবিও জানান তিনি।
আদিতমারী উপজেলা সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নিয়মিত পরিদর্শনের অংশ হিসেবে ক্লিনিকে গিয়ে দেখি প্রসূতি মা মরিয়মকে নিয়ে কান্না করছিল সবাই। বাহিক্য নিরীক্ষন করে স্বাভাবিক মনে হওয়ায় ক্লিনিকের একটি রুমে প্রসবের ব্যবস্থা করা হয়। পাশ্ববর্তি ক্লিনিকের নারী সিএসসিপি সহকর্মীকে নিয়ে এসে প্রসব করানো হয়। নবজাতক ও মা দু’জনেই সুস্থ্য রয়েছেন। এটিই এ ক্লিনিকের প্রথম নিরাপদ মাতৃত্বসেবা।