বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর লাইসেন্স দেওয়ার পদ্ধতিতেই গলদ রয়েছে। একজন চালককে লাইসেন্স দেওয়া হয় রাস্তায় চালানোর জন্য। আর বিআরটিএ তাদের কার্যালয়ে সামান্য একটু চালিয়ে পরীক্ষা নেয়। বিশ্বব্যাপী নিয়ম হচ্ছে শিক্ষানবিশ চালক অবশ্যই অনুমোদিত কোনো ড্রাইভিং স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেবেন। পরীক্ষার সময় ইনস্ট্রাক্টর পরীক্ষার্থীর সঙ্গে থাকবেন। গাড়ি সরবরাহ করবে ড্রাইভিং স্কুল।
বাংলাদেশের সড়ক চূড়ান্ত পর্যায়ে অনিরাপদ। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ক্ষতি প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। বহু কারিগরি কারণ ও রাজনৈতিক, প্রশাসনিক দুর্বৃত্তপনা এর জন্য দায়ী। আমাদের রাস্তাগুলো কেন মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে, তার জন্য বিবেচনায় নিতে হবে অন্তরালের কারণগুলোকে।
সম্প্রতি দেশে চালকের পরীক্ষা নিতে বিভিন্ন ধরনের ৭০০ যানবাহন কেনার প্রকল্প হাতে নিয়েছে বিআরটিএ। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানবাহন কিনে চালকের পরীক্ষা নেওয়ার এই প্রকল্প ফলপ্রসূ হবে না, বরং এসব যানবাহন প্রতিষ্ঠানের বোঝা হয়ে উঠবে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অল্পদিনের মধ্যেই যানবাহনগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যেমন আছে, তেমনি এসব গাড়ি কর্মকর্তারা নিজেদের মতো ব্যবহারের জন্য নিয়ে যেতে পারেন বলেও মনে করা হচ্ছে। সর্বশেষে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও সার্ভিসের নামে বিপুল খরচের বোঝা পড়বে প্রতিষ্ঠানের ওপর। চালকদের পরীক্ষার বাহানা ও অজুহাতে কতিপয় ঠুনকো যুক্তি ও মতামতে ৭০০ গাড়ির যথাযথ পার্কিং ও রক্ষণাবেক্ষণ নিরাপদ হবে কী? কাজের কাজ কতটুকু হবে বলা যায় না; তবে বাণিজ্য যে হবে, তাতে তো সন্দেহ নেই!
বরাবরই সরকারি দপ্তরগুলোয় যুক্তিযুক্তি কারণ ছাড়া কেনায় আগ্রহী কেন? প্রথমত এই ৭০০ গাড়ি দেখভাল করতে আর একটা প্রশাসন দরকার হবে; পরবর্তীতে বিআরটিসির গাড়িগুলো যেমন বছর ঘুরলেই অকেজো হয়ে যায়, এখানেও তার ব্যতিক্রম হবে কী?
বাংলাদেশের মোটরযান আইন অনুসারে, লাইসেন্স পেতে হলে প্রথমে চালককে লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়। এরপর ফিল্ড টেস্ট (চালিয়ে দেখানো) দিতে হয়। আইনে বলা আছে, নিজস্ব যানবাহন সঙ্গে নিয়ে এসে পরীক্ষার্থীকে চালিয়ে দেখাতে হবে। আইনের এই বাধ্যবাধকতাকে অবাস্তব বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, সব চালকের নিজস্ব গাড়ি থাকার সুযোগ নেই। আইন ও বাস্তবতার এই মারপ্যাঁচের কারণেই যানবাহন ভাড়ার ব্যবসায় সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পায় মধ্যস্বত্বভোগীরা।
এ বিষয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘লাইসেন্স পরীক্ষা দিতে আসা মানুষদের গাড়ি সরবরাহ করে মধ্যস্বত্বভোগীরা। এতে বিআরটিএর বদনাম হচ্ছে। তাই নিজেরা গাড়ি কিনতে বিআরটিএর কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। গাড়ি কেনার ব্যয় এবং কীভাবে তা পরিচালনা করা হবে, তা ঠিক করতে কাজ করছে কমিটি’
লাইসেন্স আবেদনকারী যদি গাড়ী ভাড়া নিয়ে পরীক্ষা দিতে পারে অসুবিধাটা কোথায়? বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘লাইসেন্স পরীক্ষা দিতে আসা মানুষদের গাড়ি সরবরাহ করে মধ্যস্বত্বভোগীরা।’ এই ‘মধ্যস্বত্বভোগী’ কারা? চেয়ারম্যানের কি ক্ষমতা নেই মধ্যস্বত্বভোগীদের অন্যায় বাণিজ্যকে প্রতিহত করা? এছাড়া ভাড়া প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে বেশী ভাড়া আদায়ের যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা রোধ করার জন্য বিআরটিএ যুক্তিসংগত একটা রেট ঠিক করে দিলেইতো হয়। নতুবা দিনভিত্তিক চুক্তিতে সরবরাহকারীদের নিকট থেকে গাড়ি ভাড়া নেওয়া খুবই সহজ কাজ। চালকের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য গাড়ি এতো জরুরি কেন? যে স্কুলে, যে গাড়ি দিয়ে শিখেছে সেই গাড়ি দিয়েই পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব।
জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ পেয়ে বিআরটিএ একটি ডিপিপি তৈরির কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে ৭০৪টি বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহন কেনার প্রস্তাব করেছে তারা। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বিআরটিএ পরীক্ষার ফির সঙ্গে গাড়ি ব্যবহারের ফি যুক্ত করে তা পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে আদায় করবে। তাহলে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে গড়ি বাবদ যে ফি নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে, সেই ফি আগেই নিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈধভাবে গাড়ি ভাড়া করলেইতো কথিত মধ্যস্বত্বভোগীরা দুর্নীতি করার সুযোগ পাবে না।
ইতোমধ্যে দুদক কয়েকবার অভিযান চালানোর পর বিআরটিএর কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। দেশে যোগাযোগের বেলায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে আছে, পরিবহন খাতে মাফিয়াতন্ত্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হওয়া। ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে বিআরটিএতে পরীক্ষায় পাশ করার জন্য মাথাপিছু কত টাকা নেয়া হয়? চলমান এ অভিযোগ অস্বীকার করার কোন সুযোগ আছে কী? যোগ্যতাসম্পন্নও কেউ ঘুষ ছাড়া নিজের দক্ষতায় বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স পেয়েছে কী?
অজ্ঞরজ্ঞান ও শিক্ষাহীন, কর্মহীন, নীতি-নৈতিকতাহীন, কিশোর, যুবক হেলপারি করে পেটেভাতে ঠেলা-গুঁতো খেয়ে কোনো রকম ড্রাইভিং শিখে থাকে। ট্রাফিক বিধি-বিধান বা রাস্তার সংকেত বোঝার জ্ঞান ও বাধ্যবাধকতা তার থাকে না। এভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা নেওয়া চালক যাত্রীসহ নিজেও বড্ড নিরাপত্তা ঝুঁকিতে গাড়ি চালিয়ে থাকে।
রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা থাকলে দুর্নীতি কমানো এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যারা সেবা দিচ্ছেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এখন যে আর্থসামাজিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে দুর্নীতিমুক্ত থাকা কঠিন হয়ে গেছে। ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া যায় কোথাও? গাড়ি কেনার নামে লুটপাটের নতুন রাস্তা আবিষ্কার যেন না হয়! জাতিকে যেন আরেকটি ‘পারমাণবিক বালিশ উত্তোলন’ কাহিনীর স্বাক্ষী হতে না হয়!
আজকের অনিরাপদ সড়ক ও মৃত্যুর মিছিল বিচ্ছিন্ন নয় বরং বহু নৈরাজ্যের ফসল। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নৈরাজ্যতন্ত্র ও বেশুমার দুর্বৃত্তপনার কাছে সড়ক পরিবহন খাতের সব ব্যবস্থাপনা হেরে গেছে, তারই প্রতিচিত্র আমাদের রাস্তার মৃত্যুর মিছিলগুলো।