দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলায় দেশের প্রথম লোহার খনির সন্ধান মিলেছে। উপজেলার ইসবপুর গ্রামে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) এ খনির সন্ধান পেয়েছে। জিএসবি জানিয়েছে, খনিটিতে উন্নত মানের লোহার আকরিক (ম্যাগনেটাইট) রয়েছে।
ইতোপূর্বে মহাকাশে নতুন ঠিকানা স্থাপনসহ নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশ হিসেবে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনায় সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। যা ছিলো দেশ ও জাতির জন্য এক অসামান্য সাফল্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্যাটেলাটের সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে আমরা পৌঁছে গেছি গৌরবের অক অনন্য উচ্চতায়। বিশ্বাঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বলতর হয়েছে সফল মহাকাশ জয়ের ওই মিশনের মাধ্যমে।
এ আনন্দের খবরে লোহার খনির সন্ধানে নিয়োজিত বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি দেশেবাসীর পক্ষ থেকে অভিনন্দন! লোহার খনি উত্তোলনে আমরা সফল হলে আরেকটি ইতিহাস ও স্বপ্ন সত্যি হবে! মহাকাশের পর এবার ভূ-গর্ভের সহস্র ফুট গভীরের ‘মহাকাব্য’ লেখার পালা শুরু হবে। প্রথম লোহার খনি উত্তোলন, অবলোকনও হবে গোটা জাতির জীবনে এক অনন্য উচ্চতা ও বহুল প্রতীক্ষিত গৌরবের অনুভূতি।
দীর্ঘ দুই মাস ধরে কূপ খনন করে অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর গত ১৮ জুন এ তথ্য জানান জিএসবির সংশ্লিষ্টরা। লোহার পাশাপাশি খনিটিতে মূল্যবান কপার, নিকেল ও ক্রোমিয়ামেরও উপস্থিতি রয়েছে বলেও জানা যায়। গত ২৬ মে জিএসবির মহাপরিচালক জিল্লুর রহমান চৌধুরীসহ ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা ইসবপুর পরিদর্শন করেন। লোহার খনি আবিষ্কার হতে চলেছে, এমন ইঙ্গিত ওই সময়ই মিলেছিল। জিএসবির কর্মকর্তারা জানান, ভূগর্ভের ১ হাজার ৩০০ ফুট থেকে ১ হাজার ৬৫০ ফুটের মধ্যে লোহার একটি স্তর পাওয়া গেছে। খনিটির আয়তন প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার। খনিতে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন টন লোহাসহ অন্যান্য মূল্যবান পদার্থ রয়েছে। হাকিমপুর উপজেলা সদর থেকে ১১ কিলোমিটার পূর্বে ইসবপুর গ্রাম। এই গ্রামের ৫০ শতক জমিতে খনিজ পদার্থের সন্ধানে কূপ খনন করেছে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর।
খননকাজে নিয়োজিত জিএসবির সংশ্লিষ্টরা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে লোহার খনির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলোর অধিকাংশে লোহার গুণগত মান ৫০ শতাংশের নিচে। তবে এ খনিতে লোহার মান ৬০ শতাংশের ওপরে। জয়পুরহাট ও ঢাকায় জিএসবির পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর ২০১৩ সালে একই এলাকার মুশিদপুরে কূপ খনন করে খনিজ পদার্থের সন্ধান পেয়েছিল। সেই গবেষণার সূত্রধরে ৬ বছর পর চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল থেকে ইসবপুরে কূপ খনন শুরু হয়। দিনাজপুরে লোহার খনির পাশে নতুন করে দীঘিপাড়া কয়লাখনির কাজও চলছে। এসব খনি থেকে পুরোদমে উত্তোলন শুরু হলে উত্তরাঞ্চলসহ সারা দেশের মানুষদের জীবনমান পাল্টে যাবে। কর্মসংস্থান হবে এখানকার মানুষদের।
আকরিক লোহা বা আয়রন ওর সাধারণত ওপেনকাস্ট মাইন (যে মাইন উপরের মাটি সরিয়ে গঠিত) থেকে আহরিত হয়। আন্ডার গ্রাউন্ড মাইন, যা ১৬০০ ফিট গভীর হবে, তেমন মাইন থেকে আকরিক লোহা উত্তোলন অর্থনৈতিকভাবে ‘ভাইয়্যাবল’ হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিশ্ববাজারে লোহা ও স্টিল ইন্ডাস্ট্রির কঠিন সময় যাচ্ছে। দুনিয়াজুড়ে ওভার প্রোডাকশনে কতিপয় সমস্যারও বিষয় রয়েছে। কাজেই পূর্ণ সতর্কতার সাথে এগোতে হবে। যাই হোক আমরা আশাবাদী হতে চাই। একথা ঠিক যে, কাজটি ফেলে রাখা যাবে না। জিএসবি সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে হবে গভীরতার লোহার খনি লাভজনক হবে কিনা? আর যে পদ্ধতিতে ১৩০০ থেকে ১৬৫০ ফিটে অবস্থিত স্তর থেকে ‘আয়রন ওর’ তোলা সঠিক ও নিরাপদ হবে সেটিই করতে হবে। এর থেকে অধিক ভূ-গভীর থেকেও লৌহ খনিজ তোলার দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন, বর্তমানে সুইডেনে কিরুনা আন্ডারগ্রাউন্ড আয়রন ওর মাইনে ২০০০ মিটার নীচ থেকেও সর্বাত্যাধুনিক উপায়ে লৌহ খনিজ তোলা হচ্ছে।
বর্তমানে এমনিতেই বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে চলেছে। নতুন খনি আবিষ্কারকে বড় চ্যালেঞ্জের সাথে সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি অবলম্বন করতে হবে। অতীতে ফুলবাড়ি কয়লাখনি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে চালু করার আয়োজনের পরে আন্দলনে তা বাতিল হয়েছিল। বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য ওপেনকাস্ট মাইন বা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি খনন দেশের জন্য পরিবেশ বিপর্যয় কারণ হবে কিনা ভাবতে হবে।
গতানুগতিকভাবে নতুন সব খনিকেই খুব উন্নত, খুব ভালো বলা হয়! পরবর্তীতে জটিল ও দুর্বোদ্ধ কোন চুক্তিতে বিদেশী কোম্পানি কাজ পায়। আর বিদেশী কোম্পানি তখন খনিজ সম্পদের মান ও লাভ-লছ নিয়ে নানা তালবাহানা করে থাকে। এসব দিকগুলোর বিশেষ প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।
দেশের প্রথম লোহার খনির আবিস্কার বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়। কিন্তু যদি এর যথাযথ উৎঘাটন না করা যায়, তা হলে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। লোহার খনি আবিস্কার প্রকল্প বাস্তবায়নের বিশাল কর্মযজ্ঞে মেধা, নিরলস পরিশ্রম ও কারিগরি সহায়তাসহ যাদের বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ নির্দেশনায় সফল একটা পর্যায় আসা সম্ভব হয়েছে; সেসব কর্মকর্তা, কর্মচারী, পরামর্শক ও সংশ্লিষ্টজনরা ইতিহাসের গর্বিত সাক্ষী হয়ে থাকবেন।