‘স্বাস্থ্যসেবা’ কথাটির বাস্তবতার চিত্র বদলে গেছে। চিকিৎকরা রোগীদের অহেতুক টেস্ট দেন, যার মধ্যে অনেক টেস্ট মোটেও প্রয়োজন নেই। আবার টেস্ট রিপোর্ট একেক জায়গায় একেক রকম। তেলেসমাতি ব্যাপার! অভিযোগ রয়েছে, অপ্রয়োজনে রোগীকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। স্বাস্থ্য খাতে এত বেশি অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, যা কল্পনাতীত! এ জন্য দরকার শক্ত সাঁড়াশি অভিযান। চিকিৎসাসেবায় আস্থা ফেরানো ও স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষায় সরকারকে উদ্যোগী হয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এর অন্যতম লক্ষ্য ‘সবার জন্য সুস্বাস্থ্য’ নিশ্চিত করা। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকার স্বাস্থ্যবীমা চালুর পরিকল্পনা করছে।’ জাতিসংঘ ঘোষিত আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। এ লক্ষ্যে সংস্থাটি বলেছে, প্রত্যেক মানুষ সে যে-ই হোক, যেখানেই বাস করুক অথবা তার যতটুকুই অর্থ থাকুক না কেন, কোনো রকম আর্থিক ভোগান্তি ছাড়াই প্রয়োজন অনুযায়ী সে গুণগত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার রাখে। ইতোমধ্যে সরকার যদিও সীমিত আকারে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যা দ্রুত সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ব্যবসায়ীসহ সর্বসাধারণের অতি লোভের মানসিকতা ত্যাগ করে মানবিক হতে হবে। অনিরাপদ ও ভেজাল খাদ্য গোটা জনস্বাস্থ্যব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। ভেজাল ওষুধ ও খাবার খেয়ে দিন দিন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি খাদ্যে ভেজাল। খাদ্যে ভেজাল থাকায় শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা তৈরি হয়, যা জাতি গঠনে সর্বোচ্চ ক্ষতিসাধন করে। জঙ্গির চেয়েও খাদ্যে ভেজালের বিষয়টি ভয়ঙ্কর। কারণ, জঙ্গি কিছু মানুষের ক্ষতি করে, কিন্তু খাদ্যে ভেজালকারীরা সমগ্র জাতির ক্ষতি করে।
সামান্য কিছু লাভ ও সুবিধা পেয়ে অনেক ডাক্তার মানহীন ও বেশি দামের ওষুধ দিয়ে থাকেন। ডাক্তাররা উৎকাচ ও সুবিধা নিয়ে আজেবাজে ওষুধ লেখেন। দেশের কিছু কিছু চিকিৎসাকেন্দ্র তো কসাইখানা। বেশির ভাগ চিকিৎসকের কাছেই নীতি-নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ বা দায়িত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায় না। মানহীন অসংখ্য ওষুধ কোম্পানি দেশে গড়ে উঠেছে। এসব কোম্পানির ওষুধ রোগ সারানোর পরিবর্তে মানবদেহে নানা রকম সমস্যা সৃষ্টি করছে।
জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি সামাজিক উদ্যোগ দরকার। জরুরি হচ্ছে সর্বসাধারণের মধ্যে নৈতিকতার জাগরণ। তা না হলে ভালো কিছুর আশা করা যায় না। সারা দেশে ওষুধের দোকানে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। ধরাও পড়ছে, জরিমানা দিচ্ছে, আবার বিক্রিও করছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও যখন ভেজাল, তখন মানুষ বাঁচবে কী করে? চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে দালালি ও কমিশন বাণিজ্যে ভরপুর। সরকারি হাসপাতালগুলোতে দালাল ও অনিয়ম দুর করা কোন সরকারের জন্য কী অসাধ্য?
ভেজাল দিতে আমরা এতটাই অভ্যস্ত যে, ভেজাল না দেওয়া পর্যন্ত ভেজালকারীদের যেনো শান্তি নেই। প্রশাসনের ঢিলেঢালা ভাব, দায়সারা দায়িত্ব, লোক সংকটসহ নান অজুহাতের ফুলঝুড়ি! ভেজালকারীরাও জানে, কালেভদ্রে সারা বছর দুই-চার দিন অভিযান চালিয়ে প্রশাসন তাদের কিছুই করতে পারবে না।
দেশে প্রতিটি পরিবারের আয়ের ৮.৮ ভাগ ব্যয় হচ্ছে চিকিৎসা খাতে। ৬৭ ভাগ লোক অসংক্রামক রোগে মারা যায়। পাশাপাশি ১২ ভাগ ক্যান্সার, ৩০ ভাগ হৃদরোগ, ৩ ভাগ ডায়াবেটিস ও ১২ ভাগ লোক অন্যান্য রোগে মারা যায়; যাদের বেশির ভাগই চিকিৎসার খরচ জোগাতে অক্ষম। ফলে এই পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশের বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। হাসপাতালে যারা ভর্তি হয়, তাদের এক-তৃতীয়াংশকে খরচ মেটাতে ধার করতে হয়, ভিক্ষা করতে হয়, নয়তো ভিটে-মাটি বিক্রি করতে হয়। সরকারি চিকিৎসা পরিষেবার পরিমাণ ও গুণমান, দুই-ই অপর্যাপ্ত। বিভাগীয় শহর ছাড়া অন্য কোথাও শিশু হাসপাতাল নেই। প্রতিটি জেলা শহরে একটি করে শিশু হাসপাতাল রাখা জরুরি। মানুষের স্বাস্থ্যসুরক্ষাই শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, পশু-পাখিদের স্বাস্থ্যের প্রতিও মনোযোগী হওয়া সরকারের দায়িত্ব।
স্বাস্থ্য খাতে তদারকি ও পরিপূর্ণ জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল উপরোক্ত অব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সম্ভব। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সরকার এরই মধ্যে ‘হেলথ কেয়ার ফাইন্যান্সিং স্ট্র্যাটেজি ২০১২-২০৩২’ প্রণয়ন করেছে। পাইলট প্রকল্পের এ কৌশলে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেবে। সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাতেই হয়। পৃথিবীর উন্নত ও কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোতে ‘স্বাস্থ্যবীমা’ চালু আছে। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তটি ঐতিহাসিক, মানবিক, সময়োপযোগী। সেবামূলক সিদ্ধান্তরূপে এটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।