সন্তানের মমতায় লালন করা ফসল এখন কৃষকের গলার কাঁটা। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে, মাথার ঘাম ঝরিয়ে যে সোনালি ফসল কৃষকরা ফলায়, তার ন্যায্য মূল্য নেই। ফসল ফলিয়ে যথার্থ মূল্য না পেয়ে তারা দিশাহারা। এ অবস্থা প্রলম্বিত হলে কৃষকসমাজ ফসল উৎপাদন ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। গত কয়েকদিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি দেখা যাচ্ছেÑ‘আর করব না ধান চাষ, দেখব তোরা কী খাস!’ ছবির বিষয়টি খুব অর্থবহ এবং ভাবনারও।
কৃষক ধান চাষ করেই জীবন চালায়। কৃষকের ধানে ‘আগুন’ লাগলে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা যাবে না। সাধারণ কৃষকদের ধান ওঠার পর তাৎক্ষণিকভাবে বিক্রি করতে হয়। কারণ তারা ধারকর্জ করে, অনেকেই উচ্চ সুদের উপর টাকা নিয়ে ধান চাষ করেছেন। কিন্তু প্রতিবারই বিক্রয় করতে যেয়ে কৃষকের মাথায় হাত পরে। কারণ ন্যায্য মূল্য পায় না তারা। এর কারণ, সরকারি ধান সংগ্রহে অব্যবস্থাপনা ও অবহেলা এবং ধান ক্রয় প্রক্রিয়ায় ফড়িয়া-মজুদদারদের নিয়ন্ত্রণ। অনাদিকাল ধরে চলে আসছে বাংলার কৃষকের দুর্দিন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পোকা-মাকড়ের উৎপাত মোকাবেলা করে ধান উৎপাদন করে কৃষক ন্যায্য মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারবে না, এটা হতে পারে না। যে ধানের দাম মণপ্রতি এগারো শ, বারো শ টাকা হওয়ার কথা, সেই ধান মৌসুমের শুরুর দিকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয় কৃষক। এখানে কৃষক বড় অসহায়। প্রতিবছরই ধানের মৌসুমে এমন পরিস্থিতি হয়। এ পরিস্থিতি সুশাসনেরও অন্তরায়। কৃষকের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে, ন্যায্য মূল্য না পেলে আমাদের বীর কৃষকরা ধান চাষ কেন করবে? এখন তো কৃষকের দৈন্যদশা থাকার কথা নয়। সরকার উদাসীন থাকতে পারে না। সোনার ধান গোলায় থাকবে, কেন আজ আগুনে পুড়বে, রক্তঝরা কষ্ট করে সেই ধান কেন আজ রাজপথে ছড়াবে?
বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্য, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীতে সরকার ভর্তুকি দিয়ে জনগণের পাশাপাশি উৎপাদকদের স্বার্থও রক্ষা করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে ফড়িয়া, মজুদদার ও কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছলচাতুরীতে বাজার, ভোক্তা, এমনকি সরকারও বেকায়দায় পড়ে। ধানের ন্যায্য মূল্য থেকে কৃষককুলের বঞ্চিত হওয়ার কারণও তাই। সরকার অনেক কিছুতে ভর্তুকি দেয়। ধান বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ দরকার। এখন ন্যুনতম মণ এক হাজার টাকার উপরে হওয়া উচিত। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ থাকা জরুরি। প্রশাসনের নজরদারিও প্রয়োজন।
কৃষককে ধানের ন্যায্য মূল্য দিতে সরকারকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান না কিনে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিনতে হবে। সিন্ডিকেটবাজি বন্ধ করতে হবে। মাঠে ধান থাকার সময়ই সরকারি লোকদের মনিটরিং করতে যেতে হবে। কৃষককে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সুষ্ঠু নীতিমালা করা হোক ন্যায্য মূল্যে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার জন্য।
আসন্ন বাজেটে কৃষি উপকরণ যেমন সার, কীটনাশক ও সেচের খরচের ওপর ভর্তুকি বাড়াতে হবে। ব্যাপারী ও দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অতি জরুরি। চালকল মালিকদেরও জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। দরকার হলে ইলিশ ধরা বা আম সংগ্রহের মতো ধান সংগ্রহের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে।
কৃষকের দুঃখ-কষ্ট সরকারকে অনুধাবন করতে হবে। ধান কেনাবেচায় কোনো দালালি যেন না থাকে। সহজ-সরল কৃষক যেন স্থানীয় টাউট-বাটপাড়ের হাতে না পড়ে। বিক্রি করা ফসলের অর্থ যেন কৃষক নির্বিবাদে ভোগ করতে পারে। স্থানীয় চাঁদাবাজ কর্তৃক যেন কষ্টার্জিত অর্থের ভাগীদার না হয়, এ জন্য কৃষককে অভয় দান করতে হবে, ভবিষ্যতে যেন কৃষক বোরো ফসল উৎপাদনে নিরুৎসাহ না হয় সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতে হবে। সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে কৃষক বাঁচাতে হবে। কৃষক কাঁদছে, পুড়ছে ধান। কৃষকের এই কান্না বন্ধ করতে হবে। ধানের দর নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলবে না। সরকারের তরফ থেকে ধান-চাল সংগ্রহের নিয়ম বদলাতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের বাদ দিয়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে হবে। উৎপাদনের চেয়ে বিক্রি কম হলে তো চলবে না।
যে দেশের ধানের বাম্পার ফলনও কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে পারে না, সেই দেশের কৃষক ভালো থাকবে কী করে? এটা দুঃখজনক। ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছে। ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে তারা। সারা দেশের ধান-চালের বাজারে ফড়িয়ারা গুজব ছড়াচ্ছে, সরকার বিদেশ থেকে বেশি চাল আমদানি করায় গুদামে জায়গা নেই। তাই এবার বেশি ধান-চাল কিনতে পারবে না। এসব গুজবের ব্যাপারে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
= = =
দেশে চাহিদার তুলনায় বেশি ধান-চাল আছে। তার পরও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে সরকারি-বেসরকারিভাবে গত ১০ মাসে দুই লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে এবং আরো তিন লাখ ৮০ হাজার টন চাল আমদানির অপেক্ষায় আছে। বাড়তি উৎপাদন ও আমদানীকৃত চাল বাজারে প্রচ- চাপ সৃষ্টি করায় কৃষকের মাথায় হাত। অন্যদিকে সরকার মে মাস থেকে তিন মাসের মধ্যে ১৩ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে এখন পর্যন্ত এক হাজার ২৬৯ টন চাল সংগ্রহ করেছে। ফলে কৃষক তার বিবিধ ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পেতে স্বল্পমূল্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে তার ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। অভিযোগ আছে, সরকার বেশির ভাগ চাল সংগ্রহ করে চালকল মালিকদের কাছ থেকে। চালকল মালিকরা সংগ্রহ করে ফড়িয়াদের কাছ থেকে। ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ থেকে কম দামে ফসল বিক্রি করা ছাড়া উপায় থাকে না।
এ সমস্যার সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সরকারের উচিত স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে ধান-চাল সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে দ্রুত সংগ্রহ করা। দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপও নিতে হবে। সরকারের প্রভাবশালী নেতারা এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতিও বলেছেন, প্রয়োজনে ভর্তুকি হিসেবে বেশি দাম দিয়ে চাল কিনে কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় মিলে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক ডেকে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ধান-চাল আমদানির পরিমাণ কমাতে হবে।
৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মণ ধান কিভাবে মেনে নেওয়া যায়? সরকার একদিকে বলছে, মণপ্রতি এক হাজার ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে; অন্যদিকে বলছে, সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা যাচ্ছে না। সরকারের উচিত সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা।
মন্ত্রী বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। তাঁর এ কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছায় কৃষকের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। কৃষককে বাঁচাতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশে কী না হয়? ধান থেকে শুরু করে ফলমূল, শাকসবজি সবই উৎপাদিত হয়। ১২ মাসই ফসল ফলানো যায়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, কৃষক ন্যায্য মূল্য পায় না। এক শ্রেণির দালাল-ফড়িয়ার কারণে তারা কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। হাজার হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে তাদের। কৃষি প্রক্রিয়ায় ফড়িয়াদের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে। ন্যায্য মূল্যে ধান কেনার ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে।
দুটি ব্যবস্থা নিতে হবে। এক. ক্ষুদ্র চাষি যার ১০ টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে তাকে সর্বোচ্চ ১০ মণ ধানের দাম ব্যক্তিগত অঙ্গীকারনামার ভিত্তিতে দেওয়া। দুই. দ্রুত উপজেলা কেন্দ্রে উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার নেতৃত্বে কমিটি করে সরাসরি ধান কেনা ও সংরক্ষণ শুরু করতে হবে। ক্ষুদ্র কৃষককে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য এ মুহূর্তে একজন কৃষকের কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ মণের বেশি ধান কেনা যাবে না। ধানের মূল্য ১০ মণ পর্যন্ত নগদে ও বেশি হলে চেকে দিতে হবে। ঋণখেলাপিরা যে পরিমাণ রেয়াত পায় অন্তত তার অর্ধেক পরিমাণ সুবিধা ক্ষুদ্র চাষিদের দেওয়া হোক।
কৃষক ধানের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। সরকারি ধান সংগ্রহ সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে হচ্ছে না, এ কথা খাদ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, কিন্তু রাজনৈতিক নেতাবেশী দালালদের কী হবে, সেটা তিনি বললেন না। তিনি বলছেন, ধান সংগ্রহ করে রাখার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। কাজের কাজ না করে এসব মন্তব্য করার ফলে কৃষকদের কষ্টটাই বাড়াচ্ছেন। কৃষকদের বাঁচাতে অবিলম্বে চাল আমদানি বন্ধ করে ধানের দাম বাড়ান। সরকার উদ্যোগ নিক, যত দিন পর্যন্ত কৃষক ন্যায্য দাম না পায় তত দিন পর্যন্ত আমদানি বন্ধ থাকবে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সময় থাকতে যদি ধান সংগ্রহের উদ্যোগ নিত তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে কৃষক পড়ত না। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মধ্যস্বত্বভোগী ধান ব্যবসায়ীদের গ্যাড়াকলে পড়ে ৪০০-৫০০ টাকা মণে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কৃষক। বাজারে ৬০ টাকা চালের কেজি, ধানের কেজি কেন ১০ টাকা হবে? যাদের দেখার কথা তারা চোখ বুজে থাকে। সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে যুক্তিসংগত মূল্যে ধান সংগ্রহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে সমস্যার সমাধান হতে পারে।
এর বাস্তব চিত্র অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘গফুর’ গল্পটি। অস্থিচর্মসার কৃষক, ঘরে নেই ছাউনি, নিজের পেটে জোটে না আহার, যে বলদ গরু দিয়ে জমি চাষ করবে সেই বলদ গরুর খাদ্য জোগাড় করতে হিমশিম খায়। গ্রীষ্মের খরতাপে ধু-ধু মাঠ, সেই মাঠের শেষে গফুরের ভাঙা ঘরখানি। সেই অতীত দিন অতিক্রম করে বাংলার কৃষক এখন আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছে। সহযোগিতা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অফিস। সরকারিভাবে খাদ্য সংগ্রহ করা কি শুরু হয়েছে? সরকারের একটা নির্ধারিত মূল্য আছে, কৃষক যে তার উৎপাদিত ধানের মূল্য পাচ্ছে না, এই মূল্য না পাওয়ার পেছনে কে দায়ী? সরকারের উচিত সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা, মিল মালিকদের কাছ থেকে নয়। কারণ কৃষক তার ধানের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। সরকার তো কৃষকের প্রতি, কৃষির প্রতি নিবেদিত। দালাল-ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে কবে? অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো দলের আন্দোলন উসকে দেওয়া উচিত হবে না।
গত বছরের তুলনায় এবার বাংলাদেশে ফলন ভালো হয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় দাম কম পেয়ে হতাশ কৃষকরা। গত বছর মৌসুমের শুরুতে ধান বিক্রি হয়েছে ৭৪০ টাকা মণ দরে, সেই ধান এবার বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়।
যেকোনো মূল্যে কৃষি ও কৃষককে বাঁচাতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি দিতে হবে। কৃষককে বিনা মূল্যে বীজ ও সার দিতে হবে। ফড়িয়ার উপদ্রব বন্ধ করতে হবে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হাটে হাটে ধানের ক্রয়কেন্দ্র খুলতে হবে।
কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ। অথচ আজ সেই কৃষকের পেটে ভাত নেই। তাদের আজ ধানের ন্যায্য মূল্যের জন্য রাজপথে নামতে হচ্ছে, এটা খুব লজ্জাজনক ঘটনা। তারা শরীরের রক্ত পানি করে ফসল ফলায়; কিন্তু দালাল সিন্ডিকেটের কারণে তাদের চোখের পানি ঝরাতে হচ্ছে।
কৃষকের আড়তের বাইরে গিয়ে ধান বিক্রির সুযোগ নেই। আড়তদাররা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। জানা গেছে, এবার সরকার প্রতি মণ ধানের দাম এক হাজার ৪০ টাকা বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু আড়তদাররা এ দামে কিনছে না। সরকারের কথা অমান্য করে সিন্ডিকেটবাজি করছে। সরকারকেই এর সমাধান দিতে হবে। কৃষক যাতে ন্যায্য মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারে তার ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে।
কৃষকদের সুবিধার জন্য সরকারিভাবে ধান ক্রয়কেন্দ্র বাড়াতে হবে। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে—এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে।
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষক ফসল ঘরে তুলে নিয়ে এলেও দুঃখজনকভাবে বিভিন্ন কারণে তার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। এর হেতু হিসেবে বলতে পারি, সাংগঠনিকভাবে সরকারি সেবা সহযোগিতা ও দায়-দায়িত্বের যথেষ্ট অভাব, কখনো পরামর্শকদের ভুল সিদ্ধান্ত, কখনো বা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ন্যায্য মূল্যে ক্রয় করতে না পারার কারণে, কখনো আবার ব্যবসায়ীদের গুদামজাত ও দালালদের কারচুপিতে চড়া মূল্য পায় না দিনমজুর কৃষক। তাই এসব ক্ষেত্রে সরকারিভাবে যথাযথ হস্তক্ষেপ ও পদক্ষেপ নেওয়া একান্তই প্রয়োজন।
জমিজমা তো এখন কিছু লোকের হাতে, তাদের জমিতে শ্রম দিয়ে যারা দৈনিক পারিশ্রমিক নিয়ে থাকে সেই কৃষকই হয়ে গেছে আজ শ্রমিক। মাঠে শ্রম দেওয়া সেই শ্রমিক নামের কৃষক তো আগেই পারিশ্রমিক নিয়ে গেছে মহাজনের কাছ থেকে। আজ যারা ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না, তারা কারা? সত্যিকার অর্থে এরা তো জমিতে নেমে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধানের উৎপাদন করেনি। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধান উৎপাদন করে দিয়েছে, তারা এর বিনিময়ে পেয়েছে যৎসামান্য মজুরি ও অল্প কিছু ধান। সেই ধান থেকে চাল করে নিলে প্রকৃত কৃষকদের কয়েক মাস যাবে মাত্র। আগে ধান উৎপাদন করে মহাজনরা গোলায় ধান রাখতেন। ধানের দাম বাড়লে তখন তাঁরা ধান বিক্রি করতেন। সেই মহাজনদের মধ্যে এখন হয়ে গেছে বড়, মেজো, সেজো, নওয়া, ছোট আরো কত কী। লাঙল যার জমি তার—এর বাস্তবায়ন যেদিন দেখতে পাব সেদিন থেকেই ধানের ন্যায্য মূল্য নিয়ে হাহাকারের অবসান ঘটবে। এখন যারা চেঁচামেচি করছে, তাদের বেশির ভাগই কখনো জমিতে যায় কি না সন্দেহ আছে।
কৃষকের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। সার ও কীটনাশকের মূল্য কমাতে হবে। কৃষককে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪৫০-৫০০ টাকায় এক মণ ধান বিক্রি করে একজন শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ধানের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি আরো বাড়াতে হবে। ধান চাষের সময় কৃষককে বিনা সুদে ঋণ দিতে হবে। মিল মালিকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় বন্ধ করতে হবে। কৃষি উপকরণের দাম কমাতে হবে। ধানের সরকারি মূল্য বাড়াতে হবে।
কৃষককে বাঁচাতে এবং ফসল উৎপাদনে তারা যেন উদ্যোগী হয়, সে জন্য সরকারকে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছাও জরুরি।
ধান সরকারিভাবে কেনা যায় কি না, তা জরুরিভাবে ভাবতে হবে এবং পদক্ষেপ নিতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীর হাত থেকে কৃষককে বাঁচাতে হবে।
ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিন
কৃষি ও কৃষক অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করে কৃষক ফসল ফলায়, কিন্তু তারা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পায় না। ধান, পাট, গম, শাকসবজিসহ প্রতিটি ফসলেরই ন্যায্য দাম থেকে কৃষক বঞ্চিত হয়। কৃষক যাতে তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পায় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। আর এর জন্য কৃষিজাত পণ্য বাজারজাতকরণের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা ও কার্যক্রম চালু করা উচিত। বর্তমানে দেশে দুই কোটি ৬০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে আউশ, আমন ও বোরো ধান মিলিয়ে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন কোটি ৫০ লাখ টন। কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম আর অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এবার দেশে আউশ, আমন ও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এই বাম্পার ফলনই যেন কৃষকের জন্য কাল হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা হলেও বর্তমানে তা বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। সরকারের পক্ষ থেকে সংগ্রহ মূল্য এক হাজার ৪০ টাকা ধার্য করা হলেও কৃষক এই মূল্য পাচ্ছে না। গত ২৫ এপ্রিল থেকে সরকারিভাবে সংগ্রহ অভিযান শুরু করার কথা থাকলেও দেশের বেশির ভাগ এলাকায় এই কার্যক্রম শুরুই হয়নি। মেহনতের ফসল বিক্রি করতে গিয়ে কৃষক নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। অনেক কৃষক ধার পরিশোধ করতে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। এক শ্রেণির অসাধু, অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও দালালচক্র কৃষকের এই অসহায় অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে। ধান বিক্রি করতে না পেরে কৃষক নিজের পাকা ধানক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কৃষি ও কৃষকের এই দুরবস্থা দেশ ও জাতির জন্য এক অশুভ লক্ষণ। ধান উৎপাদনে কৃষক উৎসাহ হারিয়ে ফেললে শুধু দেশের অর্থনীতিই দুর্বল হয়ে পড়বে না, দেশ এক চরম খাদ্যসংকটে পড়তে পারে। আউশ ও আমনের ভালো ফলন হওয়ায় মিল মালিকদের কাছে পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলেই তারা বোরো ধান কিনতে আগ্রহী নয়। মিল মালিকরা কৃষকের স্বার্থ দেখতে চাইবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। সরকার নির্ধারিত মূল্যে যাতে কৃষক ধান, চাল বিক্রি করতে পারে, সে ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। অগ্রাধিকার দিয়ে খুব দ্রুত সারা দেশে ধান সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। দালাল ও ফড়িয়াদের হাত থেকে কৃষি ও কৃষককে বাঁচাতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি। দেশের ৪০ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থানের খাত কৃষি। কিন্তু তাতে সরকারের হয়তো তেমন মনোযোগ নেই। রেমিট্যান্স ও গার্মেন্ট আয়ের দিকেই বেশি মনোযোগ সরকারের। দেশের ১৭ কোটি মানুষের মুখে অন্ন জুগিয়েও অবহেলিত রয়ে যাচ্ছে কৃষকরা। ফলে দেশে খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে। শুধু ধান কেন, সব ফসলের ন্যায্য মূল্য কৃষিজীবীরা যাতে সঠিক সময়ে পায় সে নিশ্চয়তা সরকারকে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে যে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে—সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করতে হবে। ফসলের সঠিক দাম নির্ধারণ করতে হবে। ন্যায্য মূল্যে ধান ক্রয় করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য নির্মূল করতে হবে। প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারি ক্রয় কেন্দ্র চালু করতে হবে। কৃষি খাতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দিতে হবে। শুধু ধান চাষ না করে বিকল্প ফসল চাষ করতে হবে। কৃষি যান্ত্রিককীরণ করে ফসল কর্তন ও মাড়াই করতে হবে। রপ্তানি বৃদ্ধি ও আমদানি হ্রাস করতে হবে। কৃষি উপকরণ যেমন সার, কীটনাশক, বীজ, সেচ পাম্প, ট্রাক্টর, মাড়াই যন্ত্রের মূল্য হ্রাস করতে হবে। কৃষকদের ধান কর্তনের পর কমপক্ষে দুই মাস বিলম্বে বাজারজাতে উদ্বুুদ্ধ করতে হবে। উৎপাদন থেকে বাজার পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রভাবশালী মিলার ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
কৃষককে বাঁচাতে ও কৃষিকে টেকাতে হলে নিষ্প্রাণ তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, এখনই কিছু করা দরকার। কৃষিমন্ত্রী রপ্তানির কথা বলেছেন। সরকার দ্রুত ধান-চাল কেনার ব্যবস্থা করলেই ধানের বাজার আবার চাঙ্গা হবে। মূলত ধান কেনে ফড়িয়ার মাধ্যমে চালকল মালিক আর বড় বড় চাতাল মালিক। চাল কেনার টাকা আসে গৌরীসেন তথা সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে। যে উদারতায় আমরা ঋণখেলাপিদের ক্ষমা করে দিচ্ছি, তার এক আনারও কম উদারতায় বর্তমান সংকট উত্তরণের একটা ন্যায্য পথ বের করা সম্ভব। সরকার এখনই ব্যাংকগুলোকে তাদের খাতক চাতাল আর চালকল মালিকদের এই মাসের মধ্যে ধান কেনার শর্তে ৫ থেকে ৬ শতাংশ হারে সুদে বিশেষ ঋণ দিতে পারে। এই ঋণ শুধু ধান কেনার জন্য। শর্ত থাকবে, আমন ধান লাগানোর আগেই ঋণগ্রহীতাদের এই ঋণ শোধ করতে হবে। কৃষক পিতাদের পাশে তাঁদের সন্তানদের দাঁড়াতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এরই মধ্যে এ বিষয়ে আন্দোলনে নেমেছে। তারা সংখ্যায় কম, কিন্তু বিষয়টি আশাজাগানিয়া।
কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। ধানের বিনিময় হিসেবে কৃষক যা পাচ্ছে সেটা কোনোভাবেই ধানের বিনিময় মূল্য হতে পারে না। এক মণ ধান কৃষক বিক্রি করছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। আবার এই এক মণ ধানের চাল যখন আমরা কিনতে যাচ্ছি সেটা হয়ে যাচ্ছে ন্যূনতম দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা। তাহলে মাঝখানের এই দুই হাজার ৫০০ টাকা কে নিচ্ছে? যে ব্যবসায়ী এই টাকা ভোগ করছে তার কি কোনো দায় নেই দরিদ্র কৃষকের ব্যাপারে? গ্রাহকের থেকে উচ্চমূল্য নেওয়ার ব্যাপারেও তার কি দায় নেই? সমস্যা সমাধানে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ আর ব্যবসায়ীদের নৈতিক বিবেচনাই সমাধান হতে পারে। এই দেশের বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর নৈতিকতা বলে কিছু নেই, তাই প্রশাসনের হস্তক্ষেপই হতে পারে একমাত্র সমাধান। আর দোষীদের আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমেই একটি সুন্দর সমাধান হতে পারে। ন্যায্য দাম না পেয়ে কৃষক যদি ধান উৎপাদন বন্ধ করে, তবে ভাতের উৎস কী হবে কেউ ভেবে দেখেছেন? তখন এসব ব্যবসায়ী নিশ্চয়ই বলবে, ভাতের বদলে আলু খান। আর সেই আলুর চাষিকে আবার ঠকানোর কোনো পথ খুঁজবে। এর চেয়ে ব্যবসায়ীরা নিজেরা মানুষ হয়ে গেলেই তো সহজে সমাধান হয়।
ধানের বাজার এখন ফড়িয়া আর চালকল মালিকদের হাতের মুঠোয় চলে গেছে। চালকলের মালিকরা ধান ওঠার সময় ধান না কেনার ভান করে দামটা কমিয়ে রেখে সস্তা দরে ধান কেনার কৌশল গ্রহণ করে। এবার তারা একজোট হয়ে একেবারেই ধান কিনছে না বলা চলে। অজুহাত গুদামে জায়গা নেই, আগের মৌসুমের ধানই বিক্রি হয়নি, নতুন ধান দিয়ে করব কী? সরকারিভাবে চাল কেনার ঘোষণা থাকলেও এখনো কেনার তোড়জোড় কোথাও শুরু হয়নি। সংবাদমাধ্যমকে কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, ‘ফলন ভালো হলে দাম পড়ে যায়। এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা আমরা জানি। চাল রপ্তানি করে দাম বাড়ানো যায়। তবে এ নিয়ে মতবিরোধ আছে। হঠাৎ সংকট দেখা দিলে ভয়ংকর বিপদ হবে। আমরা চিন্তা করছি, কৃষকের জন্য কিছু একটা করার। সারা দেশে বোরো ধান কাটা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি কৃষককে ন্যায্য মূল্য দিতে। ধানের দাম নিয়ে সরকারের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।’ আমার প্রশ্ন, এই আলোচনা করতে করতেই কৃষকের ১২টা বাজিয়ে ফেলবেন না তো? এখনই জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।