আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদীরা যে কত চাতুর্যের সঙ্গে এবং বিপজ্জনকভাবে কাজ করে, তার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্তের অভাব নেই। সম্প্রতি গালফ অব ওমানে কারা তেলের জাহাজে আক্রমণ করছে এ নিয়ে সারা বিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে কোনো সঠিক নেই। তবে মাধ্যপ্রাচ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারনা, এটি ইসরাইলি গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ ও তাদের সামরিক বাহিনীর কাজ হতে পারে। হরমুজ প্রণালিতে ইরানের আকাশসীমায় ইরান কর্তৃক মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার পর সেখানে এখন ফের এক যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য, এই মুহূর্তে, আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সম্পর্কের তিক্ততার ইতিহাস অনেক বড়। ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে ইসলাসি বিপ্লবের পর থেকে এ বৈরিতার শুরু। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইসরাইলের প্রধান প্রতিপক্ষ ইরান। এছাড়া রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত অনেক দেশও ইরানকে নিজের জন্য বৈরী শক্তি মনে করে।
খোদ মার্কিন প্রভাবশালী সাময়িকী ‘ফরেন পলিসি’ এক নিবন্ধে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে চলমান সংকটের জন্য ট্রাম্পের একরোখা নীতিকে দায়ী করে বলা হয়েছে, ‘ট্রাম্প এতদিনে হয়তো একথা উপলব্ধি করেছেন যে, ইরান মার্কিন চাপের কাছে আত্মমর্পন করবে না। নিবন্ধে আরো বলা হয়েছে, ট্রাম্প ভেবেছিলেন তিনি ইরানের পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে গেলে তেহরান তার পায়ে পড়ে কাকুতি-মিনতি করবে। কিন্তু ইরান যখন উল্টো আরচণ করে তখন ট্রাম্পের মাথা নষ্ট হয়ে যায়।’
আমেরিকা ২০০০ সালের দিকে অভিযোগ তোলে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ২০০২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জজ ডাব্লিউ বুশ ইরান, ইরাক ও উত্তর কোরিয়াকে ‘শয়তানের অক্ষ’ বলে আখ্যা দেন। অথচ পরবর্তীকে প্রমাণও হয়েছে ইরাকের কাছে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ছিলো না।
২০১৩ সালের ২৩ নভেম্বর বারাক ওবামার নেতৃত্বে ইরানের সঙ্গে অন্তবর্তীকালীন চুক্তিতে পৌঁছায় ছয় বিশ্বশক্তি (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাতিসংঘ)। চুক্তি অনুযায়ী ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে সরে আসবে। বিনিময়ে ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৬ সালে তেহরানের ওপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিলও করে ওয়াশিংটন।
কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় এসে সব ওলট-পালট করে দেন ভারসাম্যহীন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি নির্বাচনী প্রচারণাতেও বলেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে ইরানের সঙ্গে করা চুক্তি থেকে সরে আসবেন। তাই করলেন। গত বছরের মে মাসে ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানি করা দেশগুলোর ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এদিকে এর প্রতিক্রিয়া ইরানও নতুন করে নিজেদের পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করার ঘোষণা দেয়। ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে। দুপক্ষই পাল্টাপাল্টি হুমকি দিয়ে চলেছে। আশঙ্কা, বড় ধরণের যুদ্ধ লেগে যেতে পারে যেকোনো সময়।
ট্রাম্প ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর উপসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। রণতরি পাঠানোর পাশাপাশি যুদ্ধবিমানও মোতায়েন করে ওয়াশিংটন। এমন পরিস্থিতিতে ২০ জুন ইরান জানায়, আকাশসীমা লঙ্ঘন করায় তারা গুলি করে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করেছে। মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার পর ক্ষুব্ধ ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে পাল্টা সামরিক হামলার অনুমোদন দিয়েছিলেন। হামলার যখন সব প্রস্তুতি সম্পন্ন, ১০ মিনিট পরেই হামলা চালানো হবে, এমন সময় সেই হামলা থামানোর নির্দেশ দেন ট্রাম্প। ওই খবর প্রকাশের পর ধুরন্দার ট্রাম্প নিজেই টুইট করে বলেন, ‘প্রতিশোধ নেওয়ার দিকেই আমরা ঝুঁকেছিলাম। হামলার ১০ মিনিট আগে আমি তা থামাই। ড্রোন ভূপাতিত করার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। হামলার জন্য আমার তাড়া নেই।’
বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধের জুয়াড়ি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও রাশিয়া। তারা এমন এক জুয়াড়ি, বাজির শেষ তলা না দেখা পর্যন্তÍ জুয়ার কোর্ট ছেড়ে উঠে না। ঝগড়া করে আমেরিকা-রাশিয়া, আর লাশ পড়ছে সিরিয়া, মিশর, ইরাক, ইরান, ফিলিস্তিন, কাশ্মিরে। এভাবেই ধ্বংস হচ্ছে মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য। ইরাক শেষ, আফগান, ফিলিস্তিন, আরাকান, লিবিয়ার পর সিরিয়া, বর্তমানে টার্গেট, মিশর, ইরান! পরবর্তী টার্গেট কোন দেশ, এটা মুসলিম ক্ষমতাসীনদের ভাবতে হবে।
সাদ্দামের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকুক বা না থাকুক, টুইন টাওয়ার ধ্বংসের অকাট্য প্রমাণ না থাকলেও ধ্বংস হলো আফগান-ইরাকের লাখো শিশুর জীবন ও ভবিষ্যৎ। আসাদ, গাদ্দাফি, সাদ্দাম, ড. মুরসি যদি স্বৈরাচারী হয়ে থাকেন এর বিচার তার দেশের জনগণ করবে, কিন্তু সেই সুযোগ তাদের দেয়া হয়েছে কি?