দেশের রাজনীতির মাঠ পেরিয়ে মহান জাতীয় সংসদেও কথায় রুচি, শালীনতা ও সহিষ্ণুতার যে মহাদুর্ভিক্ষ চলছে, তা স্পষ্ট। জনগণের অর্থে পরিচালিত পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে নোংরা কথাবার্তা বলার ধৃষ্টতা কারো থাকতে পারে না। বেশি কথা হলে যে বাজে কথা হয়, তা কারো অজানা নয়। আমাদের দেশে রাজনীতিকদের সভা-সমাবেশে একে-অন্যের বিরুদ্ধে (সত্য-মিথ্যা) বিষোদগার, গাল-মন্দ, কুৎসা রটনা খুবই স্বাভাবিক। এ কাজটি তারা করছেন জাতীয় সংসদেও। বর্তমানে সংসদে বাজেট অধিবেশন চলছে। বাজেট নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ জরুরি। বিজ্ঞ সাংসদদের আলোচনার মধ্য দিয়ে বাজেটের ভালো-মন্দ, ত্র“টি-বিচ্যুতিগুলো বের হয়ে আসছে। জনগণও দেশের প্রকৃত অবস্থা জানতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যা চায়, নেতা-নেত্রীরা ঠিক তার বিপরীতটাই আমাদের উপহার দেন।
বর্তমান সংসদে বিরোধীদলের সংখ্যা কম। অতীতে যে সংসদগুলোয় পর্যাপ্ত বিরোধী দল ছিল, তখনও কতদিন তারা সংসদে যেয়ে গণমানুষের কথা বলেছে? সদস্যপদ বাঁচানো ও রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি ভোগ করতে, মাঝে মাঝে হাজিরা বইয়ে সহি করে আসাই যদি গণতন্ত্র হয়, তাহল বুঝতে হবে আমাদের মধ্যে বড় সমস্যা রয়েছে!
নিজেরা শান্তিনে থাকা ও দেশকে শান্তিতে রাখার দায়িত্ব জনগণ যাদের হাতে অর্পণ করেছে, সেই মাননীয় সাংসদেরা নিজেরাই প্রতিনিয়ত অশান্তির মহড়া দিয়ে থাকেন সংসদের ভেতরে। সেখানে তারা এমন সব শব্দ ও বাক্য উচ্চারণ করেছেন, যা কেবল অরুচিকর নয়, অশালীন ও নোংরা। কে কার বিরুদ্ধে কত বেশি আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করতে পারেন, সংসদ যেন তার প্রতিযোগিতার স্থান। জাতীয় নেতা-নেত্রীদের চরিত্র হরণসহ টিপ্পনি ও খোঁচা দিয়ে পরস্পরকে ঘায়েল করার চেষ্টার সাথে মা-বাপ তুলে গালি দেয়ারও নজির রয়েছে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, এসব গালাগালিতে এগিয়ে আছেন দুই দলের সংরক্ষিত নারী আসন থেকে নির্বাচিত কয়েকজন নারী সাংসদ। তারা দলের ও নেত্রীর প্রতি অতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে এমন সব আচরণ ও কথাবার্তা বলছেন, যা আপত্তিকর ও শিষ্টাচারবহির্ভূত। ইতোপূর্বে বর্তমান সংসদ নির্বাচিত নয় বলে দাবি করেছেন সংরক্ষিত নারী আসনের বিএনপিদলীয় সাংসদ রুমিন ফারহানা। তিনি সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনারা কেউ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হননি।’ রুমিন ফারহানাকেও মনে রাখতে ইতোপূর্বে বিএনপি তাদের দ্বিতীয় শাসনকাল অবসানের শেষ দিনগুলোতে আবারও ক্ষমতায় আসার মানসে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও কারসাজির পরিকল্পনা করছিল। ফলে ব্যাপক গণরোষের কারণে সেনাবাহিনীর সমর্থনে দু’বছরের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ পরিচালনা করে। সর্বসাধারণের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু, স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য ‘শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন’ ও সাংবিধানিক কাঠামো অতীতে বিএনপিসহ কোন সরকারই করেনি। বর্তমান ক্ষমতাসীনরাও বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে তাদের নির্বাচনী কূটকৌশল, টালবাহানার বিরুদ্ধে ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়ার আশায় আওয়ামী লীগের শত অনুনয়-বিনয়ে কাজ না হলে- হরতাল, আন্দোলন, জ্বালাও পোড়াওয়ে বাধ্য হয়েছিলেন। নিয়তির কি নির্মম ও নিষ্ঠুর পরিহাস! আজ বিএনপি তাদের অতীতের পাতানো সেই গ্যারাকলের ফাঁদেই আটকে গেছে।
সাংসদ রুমিন ফারহানা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করে বক্তব্য শুরু করেছেন। রুমিনের এ বক্তব্যের সময় সরকারদলীয় সাংসদ ও জাতীয় পার্টির সাংসদেরা হইচই করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানকে ছোট করা ও অকারণে বিতর্কে টেনে আনা কি খুবই জরুরি। জাতীয় নেতাদের নিয়ে কটুক্তি কারো জন্যই ঠিক নয়। যারা কবরে শুয়ে আছেন, তাদের নিয়ে কটুক্তিমূলত বাজে কথা বলা কি দরকার? এক্সপাঞ্জ করা কথাগুলোও কিন্তু বলা হয়ে যায়। হয় প্রচারিতও। এ কদর্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে সব দলকেই। তবে বেদনাদায়কভাবে দেখা যায়, এসব ভাষা ব্যবহারকারীদের তার দলের সাংসদেরা টেবিল চাপড়ে উৎসাহ জোগান। এমনটা কিন্তু কম-বেশি আগের সংসদগুলোতেও ঘটেছে।
কথায় আছে যেমন চাল, তার তেমন ভাত...! মুখের ভাষাই নাকি মানুষের রুচি ও মনের পরিচয়। যে সাংসদেরা সংসদে অবলীলায় অশালীন ও অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করছেন, তারা কি ঘরে মা-বাবা, সন্তান-স্বামী কিংবা নিকটাত্মীয়দের সঙ্গেও একই ভাষায় কথা বলেন? হতাশা ও ক্ষোভ থেকে প্রশ্ন জাগে, কীভাবে আমরা এরূপ একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করলাম?
আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে রাজনীতিকদের আচরণ ও কার্যকলাপ সুস্পষ্ট বিপরীতমুখী। আমরা যখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে একটি মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হতে সক্রিয়, তখন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দৈন্যের দ্বারপ্রান্তে। এর পরিণতি কী হতে পারে ভেবে দেশর শান্তিপ্রিয় মানুষ পীড়িত হন। একটি বিষয়ে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদ্যমান ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠান এবং রাজনীতিবিদদের ওপর মানুষের আস্থা টলে যাচ্ছে। দেশের ভবিষ্যতের জন্য যা শুভ নয়!