জগত জুড়ে শুধু স্বার্থের লড়াই। এ লড়াইয়ে পিষ্ট হয়ে কত প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে; কত হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে; তার ইয়ত্তা নেই। স্বার্থের সাথে মর্যাদার লড়াই যুক্ত হয়ে জগতে নেমে আসে অশান্তির ভয়াল থাবা। এত যে লড়াই চলছে। তথাপিও আমাদের সত্যিকার স্বার্থটা কী? কিসে আমাদের মর্যাদা? আমরা কি আদৌ তা বুঝতে পেরেছি? জীবনের অন্তিম মুহূর্তে এসে অনেকেই এই সত্যিটা উপলব্ধি করতে পেরে শুধু একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কিন্তু ততদিনে কতজন যে এই স্বার্থের বলি হয়ে গেছেন, তার হিসাব আর জানা যায় না।
সমাজে স্বার্থপর মানুষের যেমন অভাব নেই; তেমনি নিঃস্বার্থ আলোকিত মানুষও আছেন। আবার নিঃস্বার্থ নির্লোভ হিসেবে পরিচিত মানুষের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যায় চরম স্বার্থপরতার ঘটনা। স্বার্থ ও মর্যাদা ভাবনাটি সকলের ক্ষেত্রে এক রকম হয় না। কারও ভাবনা জগতকে আলোকিত করে, কারও অন্ধ ভাবনা আবার সমাজকে নিয়ে যায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। একই সমাজে পাশাপাশি বসবাস করে কেউ তাঁর সর্বস্ব বিলিয়ে দেয় জগতের কল্যাণে। কেউ আবার সমাজে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে গড়ে তোলে আপন সুখের প্রাসাদ। এই পার্থক্য শুধু জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি আর উপলব্ধিতে। কারও উপলব্ধিতে জগতের সকল মানুষ সমান। আর এ সমানাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে তিনি এগিয়ে যান দৃঢ় প্রত্যয়ে। একজন মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কখনও কখনও পুরোপুরি পরিবর্তন এনে দেয় একটি সভ্যতার। মানুষ অন্ধকার হতে আলোর দিকে ধাবিত হয়। বিপরীতে একজন মানুষের আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থবাদিতার কারণে বহু সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। স্বার্থের এ মারাত্মক নেশা হেরোইনের নেশার চেয়েও ভয়ঙ্কর।
ভালো বা মন্দ সব ধরনের কাজের পিছনে যে জিনিসটি লুকায়িত থাকে তা হলো- মনের সন্তুষ্টি ও আনন্দ। মানুষের প্রতিটি কাজের পেছনে কিছু না কিছু আনন্দ নিহিত থাকে, থাকে সন্তুষ্টি। আনন্দ না থাকলে মানুষ কোন কাজই করতে পারতো না। যে লোকটি সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে শরীরের ঘাম ঝরিয়ে দিনশেষে কিছু চাল, তরিতরকারি, মাছ আর সন্তানের জন্য এক প্যাকেট বিস্কিট হাতে বাড়ি পৌঁছে, তখন তাঁর এ পবিত্র আনন্দ উপলব্ধি করার মতো মন সকলের থাকে না। একজন ছাত্র যে প্রচুর পড়াশুনা করে ভালো ফলাফল করে, তখন সেও এরমধ্যে প্রচুর আনন্দ খুঁজে পায়। যা তাকে পরবর্তী বছরে আরও ভালো ফলাফল করার জন্য উৎসাহ যোগায়। আবার একজন বখাটে যে লেখাপড়া বাদ দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকে, সেও এর মধ্যে কোন না কোন অনৈতিক আনন্দ খুঁজে পায়। কেউ বা পরের পকেটের টাকা চুরি করে বাজে নেশা করেও আনন্দ পায়। পরের অধিকার হরণ করে বিলাসবহুল প্রাসাদে শুয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেও কেউ আনন্দ পায়।
নিজের সম্পদ ভোগের অধিকারকে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে যারা অন্যের মুখে হাসি ফুটান, তাঁরাও কিন্তু পরমানন্দ অনুভব করেন এবং সেখানেই খুঁজে পান জীবনের চরম সার্থকতা। তাঁরা মরণশীল হয়েও যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকেন মানুষের অন্তরে।
তাই নৈতিক ও ভালো কাজে যেমন আনন্দ আছে, তেমনি অনৈতিক এবং মন্দ কাজেও আনন্দ আছে। তবে এ দুই আনন্দের পরমানন্দ কিন্তু এক নয়। ভালো কাজের আনন্দ স্থায়ী, আর মন্দ কাজের আনন্দ অস্থায়ী। নৈতিক যে আনন্দ তা মানুষকে তার সঠিক কর্মপথ দেখায়, লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। নৈতিকতার মধ্য দিয়ে যে আনন্দ উপলব্ধি করা যায়; তার সুফল কেবল একজন ব্যক্তি নিজেই ভোগ করেন না; তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সকলেই ভোগ করে। কাজেই কে কোন আনন্দটিকে গ্রহণ করবে; তা নির্ভর করে তার নিজের জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর।
বঞ্চনার মধ্য দিয়ে সুখ ও সম্পদের পাহাড় গড়ে যারা সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে; তারা কিন্তু অহর্নিশ সমাজের মানুষের অদৃশ্য লাথিগুতাও খেয়ে চলে। কিন্তু তারা তা অনুভব করতে পারে না। কখনও কখনও তাদেরকে সমাজে চরম ভর্ৎসনার শিকারও হতে হয়। অনেক সময় উপলব্ধির পরিবর্তন হলে শুধু চোখের জল বিসর্জন দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
প্রিয় যে সন্তানের হাসিমুখ দেখার জন্য মানুষ অন্যের সন্তানের কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়ায়; কখনও কখনও সেই পরম ¯েœহের সন্তানও একদিন চোখের সামনে অধঃপাতে চলে যায়। তার আপন পাপের কর্মফল হিসেবে। উত্তরসূরীর দেওয়া মনোযন্ত্রণা নিয়ে অনেককেই ভবলীলা সাঙ্গ করতে হয়। কেউ আর তাদেরকে মনে রাখে না। তাই উচিৎ সত্যিকারের স্বার্থটাকে আগে জানা। আর এর প্রথম লাভটাও নিজের। এ জন্য প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা।
শুধু সার্টিফিকেট নামের কিছু বোঝা অর্জন করার নাম শিক্ষা নয়। প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ তার জীবনের সঠিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী- তা বুঝতে পারে। শিক্ষা যদি ব্যক্তিকে ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায়, অনিয়ম ও অশান্তি সৃষ্টি থেকে মুক্ত রাখতে না পারে; সততার সহিত কর্তব্য পালনে আগ্রহ সৃষ্টি না করে; তবে বুঝতে হবে সে শিক্ষা অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ। এ শিক্ষা শুধু জগত থেকে কেড়ে নেওয়ার শিক্ষা। জগতকে কিছু দেওয়ার শিক্ষা তা হয়ে উঠতে পারেনি। সত্যিকারের শিক্ষা মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম, উদারতা, ভালোবাসা, ন্যায় ও নৈতিকতাবোধের জন্ম দেয়। এমন শিক্ষাই পারে মানুষকে তার সঠিক স্বার্র্থ ও সম্মানকে পরিচয় করিয়ে দিতে।
মানুষের প্রকৃত স্বার্থ ও সম্মান রক্ষা হয় পরোপকার ও সুসন্তানের মধ্য দিয়ে। কথায় আছে, ‘বৃক্ষের পরিচয় তার ফলে’। মানুষের ফল তার নিজের সন্তান। মানুষ শুধু নিজে নয়, মানুষ বেঁচে থাকে তার সন্তানের মধ্যেও। সন্তান যদি সুসন্তান না হয়, সে ব্যর্থতার দায়ও তার। ভালো জাতের পুষ্ট ও দানাদার বীজ উপযুক্ত বীজতলায় নিয়ম মোতাবেক বপন ও পরিচর্যার মাধ্যমেই কেবল ভালো ফসল আশা করা যায়। মানব জীবনও এ নিয়মের বাহিরে নয়। আমরা নিজেরা যেভাবে জীবন যাপন করি, যে রকম চিন্তা চেতনা পোষণ করি, তা পরবর্তীতে আমাদের ভবিষ্যত উত্তরাধিকারীদের মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়। আর এ কারণেই পিতা-মাতার সাথে সন্তানের চেহারা, কথাবার্তা ও আচার-আচরণে এতো মিল থাকে। এটা বিজ্ঞানভিত্তিক এবং জেনেটিক বিষয়। কাজেই নিজের জীবন যাপন, চিন্তা চেতনা এক রকম, আর ভবিষ্যত প্রজন্ম নিয়ে স্বপ্ন ভিন্ন রকম। এটা ভুল ছাড়া আর কিছুই নয়।
গরীব, ধনী, আমির, ফকির সবারই জৈবিক এবং সামাজিক চাহিদা সমান। প্রকৃতির নিয়মের বাইরে বেশি ভোগের ক্ষমতা কারও নেই। সবাই তা মিটিয়েও থাকে যার যার সামর্থ অনুযায়ী। বিজ্ঞান, বিবেক কিংবা ধর্ম কোনটাই অতি ভোগকে সমর্থন করে না। অতি ভোগে শরীরের যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি ক্ষতি হয় মনুষত্ববোধ ও নৈতিকতার। পণ্য বা দ্রব্য দামী অথবা সস্তা যাই হোক, ঠিকমতো প্রয়োজন মেটানোই শর্ত। অপ্রয়োজনীয়ভাবে বেশি দাম ও চাকচিক্যের মাধ্যমে শুধু অহঙ্কারের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মাত্র। এটা আত্মার রোগ। ধনী বলে কারও শরীর অতি উত্তম এবং রোগমুক্ত আবার গরীব বলে কারও শরীর রোগাক্রান্ত ও দুর্গন্ধময় এমনটা কোথাও দেখা যায় না। এসবই অদৃষ্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
মানুষ চারপেয়ে পশুর মতো নয়। জগতের ধারাবাহিকতায় শুধু জন্ম, বেড়ে উঠা আর মৃত্যুর নামও মানব জীবন নয়। আসুন, একটু ভাবি, খামখেয়ালিপূর্ণ স্বার্থের সার্থকতা আসলে কতটুকু?
লেখক : প্রভাষক ও কলাম লেখক।