অসম প্রতিযোগিতার মধ্যেও দেশের বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো টিকে থাকার লড়াই চালাচ্ছে। তবে ইতিমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানই ওই লড়াই থেকে ছিটকে পড়েছে। মূলত উচ্চ পরিচালন ব্যয় ও তীব্র প্রতিযোগিতার কারণেইড হিমশিম খাচ্ছে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো। গত ২০ বছরে ১২টি এয়ারলাইনস অনুমতি পেলেও পরিচালনা করার পর সাতটি বন্ধ হয়ে গেছে। আর দুটি প্রতিষ্ঠান অনুমতি নিলেও কখনোই পরিচালনায় আসেনি। বন্ধ হয়ে গেছে অ্যারো বেঙ্গল, এয়ার পারাবাত, এয়ার বাংলাদেশ, রয়েল বেঙ্গল এয়ার, বেস্ট এয়ার, জিএমজি এয়ারলাইনস এবং ইউনাইটেড এয়ার। বর্তমানে টিকে রয়েছে মাত্র তিনটি বেসরকারি এয়ারলাইনস। মূলত ভুল পরিকল্পনা, উচ্চ হারের অ্যারোনটিক্যাল চার্জ, জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বিপুল অর্থের জোগান না দিতে পেরেই অধিকাংশ বেসরকারি এয়ারলাইন্স কোম্পানি বিদায় নিয়েছে। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এবং বেসরকারি এয়ারলাইনস কোম্পানি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশে বিমান চলাচল খাতের অনেক সম্ভাবনা থাকলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো টিকে থাকতে পারছে না। বরং বিমান বাংলাদেশ ও বিদেশি এয়ারলাইনসের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো হিমশিম খাচ্ছে। মূলত এয়ারক্রাফট ক্রয়ে উচ্চ সুদের অর্থায়ন, বেশি দামের জেট ফুয়েল, এয়ারপোর্ট চার্জ, ভাড়ার প্রতিযোগিতা, যন্ত্রাংশ আমদানি, ব্যয়বহুল রক্ষণাবেক্ষণ, হ্যাঙ্গার, বন্ডেড ওয়্যারহাউসসহ বিভিন্ন বৈষম্যে এ খাতে নানা সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া পর্যাপ্ত নীতি সহায়তা, আর্থিক সক্ষমতার অভাব, ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, যুগোপযোগী ব্যবসায়িক কৌশলের অভাবসহ আরো নানা কারণে বিদেশি এয়ারলাইনসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে গত ২২ বছরে লাইসেন্স পাওয়া অনেক এয়ারলাইনসকে কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে হয়েছে। আর বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর সক্ষমতার ঘাটতি কাজে লাগিয়ে দেশের এভিয়েশন শিল্পের বেশির ভাগই দখল করে আছে বিদেশি এয়ারলাইনস।
সূত্র জানায়, বিগত ১৯৯৫ সালে দেশে প্রথম বেসরকারি এয়ারলাইনস অ্যারো বেঙ্গলকে আকাশপথে চলাচলের জন্য অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু অনুমতি পাওয়ার পর যাত্রা শুরু করতে অ্যারো বেঙ্গলের আরো দুই বছর সময় লাগে। তাছাড়া অ্যারো বেঙ্গল ১৯৯৭ সালে প্রথম যাত্রী পরিবহন শুরু করলেও কর্তৃপক্ষ ১৯৯৮ সালে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। অ্যারো বেঙ্গলের পর পরই চালু হয়েছিল এয়ার বাংলাদেশ, জিএমজি, এয়ার পারাবত, রয়েল বেঙ্গল এয়ার, বেস্ট এয়ার ও ইউনাইটেড এয়ার। কিন্তু ওই সাতটি এয়ারলাইনসও অর্থসঙ্কট দেখিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। আর ২০১০ সাল থেকে রিজেন্ট এয়ার, ২০১৫ সাল থেকে নভো এবং ইউএস-বাংলা এয়ার ফ্লাইট অপারেশন করে এখনো টিকে আছে। বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৩১টি বিদেশি এয়ারলাইনস ৩৭টি গন্তব্যে ফ্লাইট ও কার্গো সেবা পরিচালনা করছে। আর প্রতিবছর ৬০ লাখের বেশি যাত্রী বিমান পরিবহন সেবা নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রী বৃদ্ধির হার ২২.১০ শতাংশ। তবে বহির্গামী যাত্রীদের ৭০ শতাংশই বহন করছে বিদেশি এয়ারলাইনস। ফলে বিকাশমান এ বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার বিশাল অংশ বিদেশে চলে যাচ্ছে। আর অভ্যন্তরীণ রুটে বিগত পাঁচ বছরে যাত্রী বেড়েছে চার লাখ ১৯ হাজার ৫১৮ জন। এই বৃদ্ধির হার ৬৪.৭৩ শতাংশ। বছরে প্রায় ১২ লাখের মতো যাত্রী পরিবহন করছে চারটি এয়ারলাইনস।
সূত্র আরো জানায়, উড়োজাহাজের তেলের মূল্য, পার্কিং চার্জ, অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ অনেক বেশি। বিদেশি এয়ারলাইনসকে সেসব দেশের সরকার প্রদত্ত সুবিধা দেশীয় এয়ারলাইনসগুলোকে দিতে সরকারের কিছু সহায়তা প্রয়োজন। তাছাড়া উদ্যোক্তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়াও এ সেবার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। তাছাড়া বাংলাদেশে উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ আমদানি প্রক্রিয়াও জটিল ও সময়সাপেক্ষ। পাশাপাশি বেসরকারি বিমান কম্পানিগুলোর জন্য বিমানবন্দরে কোনো হ্যাঙ্গার নেই। বরং বিভিন্ন হেলিকপ্টার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের হ্যাঙ্গারেই তাদেও কোনো মতে মেরামতের কাজ করতে হয়।
এদিকে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোকে বিদ্যমান কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় এভিয়েশন বিষেশজ্ঞদের মতে, দেশের বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোকে এগিয়ে নিতেসময়োপযোগী নীতিমালা জরুরি। যেখানে এভিয়েশন খাতের বিকাশে সরকারের পর্যাপ্ত নীতি সহায়তা থাকবে। একই সঙ্গে দেশীয় এয়ারলাইনসগুলোর বিকাশে সরকার সুনির্দিষ্ট কিছু কর্মসূচি নিতে পারে। পাশাপাশি বেসরকারি এয়ারলাইনসের অনুকূলে হ্যাঙ্গারের স্থান এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান, ঢাকা কাস্টমস হাউসে ভোগান্তিবিহীন যন্ত্রাংশ ছাড় করানো এবং অযৌক্তিক শুল্ক আরোপ না করা, যন্ত্রাংশ আমদানির মূল্য ইলেকট্রনিক ট্রান্সফারের মাধ্যমে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা, জ্বালানি তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করা এবং অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ কমিয়ে আনা প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান জানান, এদেশে এয়ারলাইনসের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদহার বেশি। উড়োজাহাজের জ্বালানি তেলের দামও অতিরিক্ত। আন্তর্জাতিক পথে যে দামে জেট ফুয়েল কেনা যায়, অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটে একই তেল কিনতে বেশি টাকা দিতে হয়। সারচার্জ ও তেলের দামের এ বৈষম্যের জন্য ব্যবসা করা কঠিন। তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমে গেছে অথচ বাংলাদেশে কমেনি। এতো খরচ দিয়ে দেশি এয়ারলাইনসগুলোর ব্যবসা করে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
একই প্রসঙ্গে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা দরকার। তাছাড়া সারচার্জ তেলের দামের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা আনা প্রয়োজন। ভারতের এয়ারলাইনসগুলোর জন্য মোদি সরকার উড়াল নামে একটি স্কিম চালু করেছে, যেখানে দেশীয় এয়ারলাইনসের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। অথচ আমাদের দেশের এয়ারপোর্টেও আমাদের বিদেশি এয়ারলাইনসের সমান হারে ল্যান্ডিংসহ অন্যান্য চার্জ দিতে হচ্ছে।