গ্রামের স্কুলগুলোতে ভবন ভালো না হলেও মাঠ থাকে। কিন্তু রাজধানীতে স্কুলগুলোর চিত্রটি তার বিপরীত। ভবন আছে, মাঠ নেই। স্কুলের এক চিলতে বারান্দা, ব্যালকনি বা ছোট্ট গ্যারেজের চৌহদ্দিতে বন্দী থাকে বলতে গেলে তাদের গোটা শৈশব। পাড়া বা মহল্লাতেও তাদের দুরন্তপনায় মেতে ওঠার মত কোন ঠাঁই নেই। ঢাকার অনেক মাঠই এখন রূপে টিকে আছে শুধু ‘মাঠ’ নাম ধারণ করে। আবার অনেক মাঠ রীতিমতো বিলীন হয়ে গেছে বিভিন্ন অজুহাতে, নানা স্থাপনায় কিংবা অবৈধ দখলদারদের কবলে। ফলে মাঠ যেন খেলার জন্য সোনার হরিণ হয়ে উঠছে দেশজুড়ে। ইট-পাথরের নগরায়ণের জাঁতাকলে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক খোলা মাঠের প্রাণ; খেলার মাঠের উন্মুক্ত জায়গা কিংবা বেশির ভাগ পার্ক। যতটুকু আছে তা-ও যেন যায় যায়। প্রাণজাগানিয়া মাঠের দৃশ্য যেমন চেনে না নতুন প্রজন্ম, তেমনি মাঠের খেলার স্বাদবঞ্চিত হয়ে শিশুরা বেড়ে উঠছে চার দেয়ালের ঘরবন্দি মানুষের মতো; দুরন্ত শৈশবের বদলে জড়তার অন্ধকারে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ। সেই সঙ্গে বড়রাও হারিয়ে ফেলছেন তাঁদের শৈশবের দেখা প্রাণবন্ত মাঠের চাঞ্চল্য; শরীরচর্চা-হাঁটাচলার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁরা। যার প্রভাবে শিশু থেকে বড় সবারই দেখা দিচ্ছে নানা রোগব্যাধি। বিশেষ করে শিশুদের মনোশারীরিক বিকাশ না ঘটার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থূলতা ও ডায়াবেটিকের ঝুঁকি। বড়দেরও ডায়াবেটিকসহ আরো অনেক অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধির পেছনে নিয়মিত হাঁটাচলা কিংবা খেলাধুলা না করাকে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আর জনস্বাস্থ্যের জন্য মাঠের এমন গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়েই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনপ্রতি বিভিন্ন হারে খোলা মাঠের আয়াতন নির্ধারণ করেছে। যে হিসাবে বাংলাদেশে জনপ্রতি ৯ বর্গমিটার খোলা মাঠের প্রয়োজন বলে ধরা হয়। সর্বশেষ এক হিসাবে ঢাকায় জনপ্রতি দশমিক এক বর্গমিটারেরও কম মাঠ রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে এক প্রতিবেদনে। এদিকে, রাজধানী ঢাকায় প্রায় প্রতিটি অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে স্কুল। এসব স্কুলে মাঠ তো দূরের কথা, ক্লাস রুমই নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক। পরীক্ষায় ভালো ফল করা বেশিরভাগ বড় বড় স্কুলে পর্যাপ্ত ক্লাসরুম থাকলেও শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য নেই এক ইঞ্চি জায়গাও। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের মতে, রাজধানীর ৯৫ ভাগ স্কুলে মাঠ নেই। শুধু মাঠ নয়, অনেক স্কুলে ঠিক মতো আলো-বাতাস প্রবেশেরও সুযোগ নেই। ভোরে অভিভাবকরা তার সন্তানকে রিকশা বা গাড়িতে করে সরাসরি স্কুলে দিয়ে আসেন। স্কুল শেষে তারা তাদের সন্তানদের বাসার নিয়ে যান। খোলা আলো-বাতাসে শিশুদের খেলাধুলা বা কৈশোরের স্বাভাবিক উচ্ছ্বলতায় মেতে ওঠার সুযোগ দেয়ার বিষয়টি মাথায় নেই কারো। না অভিভাবকের, না স্কুল কর্তৃপক্ষের, না শিক্ষা দপ্তরের। শিক্ষাকে পুরোপুরি ব্যবসা হিসাবে নিয়ে খোলা হয় স্কুল। স্কুল কর্তৃপক্ষের আয়-রোজগার ভালো হলে আরো জমি কিনে সেখানে আরো ভবন তৈরি করা হয়, যাতে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা যায়। খেলার মাঠ তৈরির কথা মনেও আসে না তাদের। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মহানগরীর ৩৩৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া ১৪টি কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। উচ্চবিদ্যালয় সংযুক্ত বিদ্যালয় ৫৭৬টি, এনজিও পরিচালিত প্রায় ৪শ বিদ্যালয় রয়েছে। কিন্ডারগার্টেন সমিতির তথ্য অনুসারে, এর বাইরে রাজধানীতে ১০ হাজারের বেশি কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। যেখানে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী পড়ছে। সরকারি স্কুলের ছোট বড় মাঠ থাকলেও কিন্ডারগার্টেনসহ অন্যান্য স্কুলে কোন মাঠ নেই। আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর অবস্থাও একই। রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে কোন মাঠ নেই। বছরে একদিন খেলাধুলার আয়োজন করা হয় অন্য কোন মাঠে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিবছর ভর্তি ফি, মোটা অংকের টিউশন ফি ছাড়াও লিখিত, অলিখিতভাবে বিভিন্ন ফি আদায় করলেও স্কুলগুলোর খেলাধুলার মাঠের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। নেই শিক্ষার কোন পরিবেশও। নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি কিন্ডারগার্টেন, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিজস্ব মালিকানায় অথবা ভাড়ায় মহানগর এলাকা কমপক্ষে আট শতাংশ ভূমির উপর অন্তত ৩ হাজার বর্গফুটের কমপক্ষে ছয় কক্ষবিশিষ্ট ভবন থাকার কথা। সরকারের এ নির্দেশনা মানছে না কেউ। আবার এ নির্দেশনা মানলেও এই জমিতে কোন মাঠ করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, মাঠের কথা সরকার ভাবছেই না। ভাবলে নীতিমালায় মাঠ বা খেলাধুলার সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি নীতিমালায় উল্লেখ থাকত। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাঠ শুধু খেলাধুলাই নয়Ñএর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের শরীর আর প্রাণের এক অপার বন্ধন। খোলা মাঠ মানুষের মনের প্রান্তরকেও উন্মুক্ত করার প্রেরণা জোগায়। অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রহরীর মতো কাজ করে। জনস্বাস্থ্যবিদরা জানান, খেলাধুলা ও শরীরচর্চা মানুষের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়, অসংক্রামিত রোগ দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুসারে বিশ্বে বছরে ৩০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে উপযুক্ত শারীরিক তৎপরতা না থাকার প্রভাবকে দায়ী করা হয়েছে। খেলার মাঠ বিষয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশের এক গবেষণা সূত্র অনুযায়ী, ঢাকার বেশির ভাগ মাঠই এখন আর মাঠের চেহারায় নেই। অনেক ক্ষেত্রেই মাঠ আর পার্ক একাকার হয়ে গেছে। এ ছাড়া অনেক মাঠ খেলার অনুপযোগী করে ফেলা হয়েছে। কোনো কোনো মাঠের ভেতরে ওয়াকওয়ের নামে আকার ছোট করা হয়েছে। কোথাও কোথাও মাঠের ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছে ক্লাব বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ভবন। আবার কিছুকিছু মাঠকে ব্যবহার করা হয় নানা সাপ্তাহিক মেলা বা গাড়ির হাটের মতো বাণিজ্যিক কাজে। ফলে এসব মাঠের প্রতি শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বড়রাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এ ছাড়া আগে মাঠগুলোতে ছেলে-মেয়ে-নির্বিশেষে খেলাধুলা করলেও এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেই তেমন পরিবেশ। আবার বড় বড় পার্কের ভেতরে বা উদ্যানে যে মাঠ রয়েছে, সেগুলোতেও পরিকল্পিতভাবে খেলাধুলার মতো তেমন পরিবেশ নেই। সেই সঙ্গে প্রতিবন্ধীদের জন্য এসব মাঠে কোনো খেলাধুলার সুযোগ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুর মধ্যেই সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ খুঁজতে হলে শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক বিকাশের সুযোগ তৈরি করতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনই।