বাংলাদেশে ভূমিদস্যুতা অপরিচিত কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু বাংলাদেশে ভূমিদস্যুতা যেভাবে ও যে আকারে হচ্ছে, এর কোনো তুলনা এ দেশে পূর্বে কোনোদিন ছিল না এবং বিশ্বের অন্য কোনো দেশেও নেই। এখানে এই দস্যুরা শুধু দুর্বল ও গরিবদের জমিই যে বেআইনি ও জবরদস্তিমূলকভাবে দখল করছে তাই নয়, এরা সরকারি জমি ও সে সঙ্গে লেক-খাল-নদীসহ সকল প্রকার জলাশয় পর্যন্ত দখল করছে। এ ধরনের জমি ও নদী দখলের ওপর রিপোর্ট বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রায়ই প্রকাশিত হয়।
আগের দিনে রাজায় রাজায় লড়াই হতো। যুদ্ধ করে দখল করে নেয়া হতো অন্যের রাজত্ব। বর্তমান সময়ে সেটি হয়ত আর সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে ভূমি দখল থেমে নেই। বসে নেই ভূমিদস্যুরাও। ক্রমেই জায়গা-জমির দাম বৃদ্ধি তাদেরকে যেন আরও উৎসাহিত করছে। সহজে কোটিপতি হবার একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে ভূমিদস্যুতা। দেশে হয়ত নানা আইনকানুন আছে, কিন্তু টাকা থাকলে, ক্ষমতা থাকলে তা যেন কিছুই না। আমাদের দেশে তা সম্পন্ন হচ্ছে প্রশাসনের ছত্রছায়ায়। প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়ে দখল করে নেয়া হচ্ছে নিরীহ জনগণের বৈধ বসতভিটা ও ফসলি জমি। তাদের ভূমি ফিরে পাবার আশায় তারা সরকারের যথাযথ মহলের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, মামলা করেছেন। কিন্তু সে পর্যন্তই। অনর্থক ব্যয় হচ্ছে তাদের অর্থ এবং সময়। কাজের কাজ হয়না কিছুই। উপরন্তু পেয়েছেন হত্যার হুমকি। নিজের জীবন নিয়েই টানাটানি। রক্তপাতও হচ্ছে অনেক।
তথ্য মতে, ভূমিদস্যুদের মধ্যে আছেন সরকারি আমলা, রাজনৈতিক নেতা, ইউপি চেয়ারম্যান, স্থানীয় সন্ত্রাসীসহ অনেকে। সরকার দলীয় ছত্রছায়ায় থেকে অনেক উঠতি ক্যাডার কিংবা নেতাদের সঙ্গে থাকা সাগরেদরাও করছে ভূমিদস্যুতা। অনাকাঙ্খিত হলেও তাদেরকে যেন সহযোগিতাই করেছেন প্রশাসনিক মহল। কিন্তু কেন? তার জবাব খুঁজতে গিয়ে বরাবরের মতোই যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা হলো অর্থ। ক্ষমতার দাপটে, টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করা হয়েছে সবকিছু।
ভূমিদস্যুতা নিয়ে বিশ্বখ্যাত লেখক তলস্তয়ের সারা জাগানো একটি গল্প আছে। ‘সাড়ে তিন হাত জমি’ নামে এই গল্পটি এখনও ভূমিখেকোদের পরিণতির এক জ্বলন্ত উদাহরণ। গল্পের নায়ক ফাহাম ছিলো নিতান্ত গরিব। তার এক প্রতিবেশি মহিলার বিপুল পরিমাণ জমির প্রতি তার লোভ জাগে। এক সময় নানা কূট-কৌশলে এই জমিটুকু তার আয়ত্বে নিয়ে আসে ফাহাম। মহিলার ওই জমি হজম করে বেপরোয়া হয়ে ওঠে সে। দেদারছে মানুষের জমি আত্মসাৎ করতে থাকে। ফাহামের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন প্রতিবেশীরা। কিভাবে দমানো যায় এই চিন্তায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ওঠেন অনেকে। এক সময় এক পন্ডিত বের করেন সমাধান। ফাহামকে প্রস্তাব দেয়া হয় পাশেই একটি দেশ আছে। যেখানে বিনে পয়সায় অনেক জমির মালিক হওয়া যায়। শুধু শর্ত একটাই, যতটুকু জমি চাই দেয়া হবে, তবে তা নিতে হবে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দৌড়ে। এই সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যতদূর আগানো যাবে ততটুকু জমি নিজের করে নেয়া যাবে। লোভী ফাহাম সহজেই টোপটি গিলে নেয়। সে জমি নিতে পাড়ি দেয় ওই দেশে। রাজার সামনে উপস্থিত হয়ে জমি নেয়ার আবেদন জানায়। রাজা বললেন, ঠিক আছে। কাল সূর্যোদয় থেকে দৌড়ানো শুরু করো। লোভী ফাহাম রাজার প্রস্তাবে সারারাত আর ঘুমায়নি। এই তো সুযোগ। অতঃপর সূর্যোদয়ের মুহূর্ত থেকে দৌড়াতে শুরু করে সে। ফাহাম দৌড়াচ্ছে। এদিকে সূর্যও তার তীক্ষè রস্মি ছড়াচ্ছে সময়ে সময়ে। একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে ফাহাম। পানির জন্য হৃদয়ে তৃষ্ণা জাগে তার। কিন্তু হৃদয়ের লোভ তাকে থামতে দেয় না। থামলেই তো জমির পরিমাণ একটু কমে যাবে! ক্লান্ত অবস্থায়ও ফের দৌড় শুরু করে সে। এক সময় সমস্ত শরীরে ক্লান্তির ছাপ তাকে আর এগুতে দেয় না। পিছন ফিরে তাকায় সে। ইতোমধ্যে অনেক জমির মালিক হয়ে গেছে। আবার সামনের দিকে তাকায়। দৃষ্টিসীমানা জুড়ে শুধু জমি আর জমি। অতি লোভের কাছে হার মানায় ক্লান্তি। মধ্যপথে সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর দাঁড়িয়ে তখনও দমে না সে। সূর্যাস্ত পর্যন্ত দৌড়াতে হবে। তাহলেই তো দৃষ্টিসীমানা জুড়ে সবটুকু জমির মালিক হয়ে যাবে সে। ফাহাম দৌড়ায়। এক সময় ক্লান্ত অবসাদ শরীর আর চালাতে পারে না। পুরো পৃথিবীই যেনো সংকীর্ণ হয়ে আসে তার সামনে। মাটিতে লুটে পড়ে কাতরাতে থাকে লোভী ফাহাম। তৃষ্ণায় দমফাটা কান্না আসে তার। কিন্তু তখন আর আশেপাশে কেউ নেই। লোকালয় থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে সে। এখন তার চারপাশ ঘিরে শুধু জমি আর জমি। এক ফোটা পানি দেয়ারও কেউ নেই তার সীমানা জুড়ে। এক সময় তৃষ্ণার্ত ফাহাম মরে যায় সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই। খবরটি যখন ছড়িয়ে পড়ে সবাই আসে রাজার কাছে। রাজা তখন বলে উঠেন, ‘এই জমিটুকুই প্রাপ্য ছিল তার। ফাহামের জন্য তার প্রাপ্য সাড়ে তিন হাত কবরের জমি দিয়ে দাও।’
দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিদস্যুরা নিরীহদের বসতবাড়ি, ফসলি জমি ও সরকারী জমি জবরদখলের জন্য দৌড়াচ্ছেন।
নানা কূট-কৌশলে নিরীহদের জিম্মি করে জবরদখল করা হচ্ছে নিরীহদের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। এমনকি তাদের দখলবাজি থেকে রেহাই পাচ্ছে না সরকারী জমিও। ভূমিদস্যুদের কবলে পড়ে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি হারিয়ে অনেকেই হয়েছেন নিঃস্ব। মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন অনেকে। আবার জীবনও দিতে হয়েছে অনেকের। এসব ভূমিদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ ও সড়ক অবরোধ করা হয় ।
ভুমিদস্যুরা নিরীহ মানুষের ফসলি জমি জোরপূর্বক বালু দিয়ে ভরাট করে দখল করে নিচ্ছে। ভুমিদস্যুদের কবল থেকে বসতবাড়ি ও সরকারী রাস্তাও রেহাই পাচ্ছে না। বসতবাড়ি ও সরকারী রাস্তাও জোরপূর্বক দখল করে নেয় ভুমিদস্যু বাহিনী। এতে বাঁধা দিলেই হামলা-মামলার শিকার হতে হচ্ছে তাদের। এ অবস্থায় ভুক্তভোগী এলাকাবাসী তাদের ফসলি জমি, বসতবাড়ি ও সরকারী রাস্তা ভুমিদস্যুদের কবল থেকে রক্ষা ও ভুমিদস্যু এবং সন্ত্রাসীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। আমি মনে করি, বসতবাড়ি ও ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া এসব নিরীহ মানুষের অভিশাপে চিহ্নিত এই ভূমিদস্যুরাও প্রান হারিয়ে বিশ্বখ্যাত লেখক তলস্তয়ের সারা জাগানো ‘সাড়ে তিন হাত জমি’ নামে গল্পের সেই ফাহামের মতোই অবস্থা হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই যে শ্রেণীটি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে তারা হলো প্রধানত লুণ্ঠনজীবী। নিজেরা উৎপাদন না করে বিদ্যমান ধনসম্পদ লুণ্ঠনের মাধ্যমে এরা যেভাবে নিজেদের সম্পদ গড়ে তুলেছে, সেই প্রক্রিয়া এ দেশে এখনও শক্তিশালীভাবে জারি আছে। এ লুণ্ঠনের অনেক রূপের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো ভূমিদস্যুতা। ১৯৭১-এর ঠিক পরবর্তী সময়ের সঙ্গে এ দস্যুতার পার্থক্য এই যে, আগেকার মতো হিন্দু সম্পত্তি এর লক্ষ্যবস্তু নয়। হিন্দু এবং উর্দুভাষী অবাঙালিদের যাবতীয় লুণ্ঠনযোগ্য ভূমি দখল করার পর তাদের এমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমি আর নেই, যা ব্যাপকভাবে দখল করা যায়। কাজেই এখন ভূমিদস্যুদের দৃষ্টি অন্যদিকে। এখন তাদের লুণ্ঠন ও দস্যুতার মূল লক্ষ্যবস্তু হলো সরকারি জমি, নদী, লেক, খালসহ সব ধরনের জলাশয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভূসম্পত্তি অথবা গরীব নীরিহ মানুষের সম্পত্তি। ভূমিদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত ও দখল হচ্ছে সাধারন নীরিহ মানুষের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। এর জন্য খুন-খারাবি-হামলা-মামলাসহ সকল প্রকার নির্যাতনই তাদের ওপর চলছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে ভূমিদস্যুতা শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং শাসক শ্রেণীর প্রভাবশালী লোকরাই করছে তা-ই নয়, জনপ্রতিনিধিরাও নিজেই নিজের বাহিনীর মাধ্যমে ভূমিদস্যুতা করছে। এই ভূমিদস্যুতার বিরুদ্ধেই রূপগঞ্জের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিরোধ সংগঠিত করেন। এসব থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে ভূমিদস্যুতা এখন যেভাবে ও যে পর্যায়ে হচ্ছে, তাতে ক্ষমতাশালী লোকেরা যেমন গরিবদের জমি দখল করছে, তেমনি তারা দখল করছে বিভিন্ন ধরনের সরকারি মালিকানাধীন জমি, নদী-খাল-বিল-লেক ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। অন্যদিকে, কোথাও কোথাও প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি ও পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম ভাঙ্গিয়ে অনেক এলাকায় ভূমি দখলের জন্য জনগণের ওপর নির্যাতন চলছে। এ পরিস্থিতিতে ভূমিদস্যুতা সরকারি প্রচেষ্টার মাধ্যমে যে বন্ধ হবে, এমন ভাবনার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এ দস্যুতা বন্ধের জন্য জনগণের সুসংগঠিত আন্দোলনই হলো একমাত্র পথ। তবে সাধারন মানুষের প্রত্যাশা- রাজধানীর সব এলাকা থেকে ভুমিদস্যুতার অবসান হোক। নিপাত যাক ভুমিদস্যুরা।