শুধু সম্ভবের শিল্প হিসেবে রাজনীতির পরিচয় হতে পারেনা। মহাজোট গঠিত চটকধারী মন্ত্রীপ্রাসাদ ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বিশেষ দূতের দল জাতীয় পার্টির নির্বাচনী আঁতাঁত ‘পাকাপোক্ত’ এবং ‘ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী’ করবার ঘটনা দু’টো কী তা প্রমাণ করে দিলো না? বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আসন ভাগাভগির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালি মাঠে গোল দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন মহাজোটবাদীরা ‘ঘোমোট রাজনীতি’ সৃষ্টি করায় ‘রাজনীতি’ যে শুধু ‘সম্ভবের শিল্প’ এমনটা ভাবা আজকাল অকল্পনীয়ই বটে।
রাজনীতি যে শুধু ‘সম্ভবের শিল্প’, আপাতদৃষ্টিতে তা মনে করা অস্বাভাবিক। কিন্তু প্রকৃত জবাব ঈষৎ জটিলতর। রাজনীতিকে যখন ‘সম্ভবের শিল্প’ বলা হয়, তখন সাধারণত ‘সম্ভব’ বা ‘সম্ভাব্যতার’ ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু ‘শিল্প’-এর তাৎপর্য ব্যাপক। শিল্পের ধর্ম হচ্ছে সৃষ্টিশীলতা। সম্ভাব্যতা সৃষ্টি করে নেওয়ার মধ্যেই শিল্প হিসেবে রাজনীতির যর্থাথ সার্থকতা। অ-সম্ভবকে ‘সম্ভব’ করে তুলার সাধনাই রাজনীতির প্রকৃত সাধনা। যেখানে আপাতবিচারে কোনো সম্ভাবনা নেই বস্তুত সেখানেই সৃষ্টিশীলতার প্রকৃত পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় প্রথমবারের মতো নজির বিহীন ফাঁকা মাঠে দশম সংসদ নির্বাচনের লীগবাদীদেও তথাকতিথ বিজয়ের ‘জয়জয়কার নাটক’ দেখার অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ববাসীর।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের নৌকা এবং জাতীয় পার্টির লাঙ্গল দীর্ঘকাল ঘোরপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীতার পাশাপাশি ছিল ক্ষমতার দখলের লক্ষ্যে রাজনীতি দলের দুই প্রধানের মধ্যে অর্থাৎ নৌকার মাঝি আর লাঙ্গলের চাষীর মধ্যকার প্রবল ব্যক্তিগত লড়াইও। প্রতিদ্বন্দ্বীতা আর লড়াইয়ের মাঝেও তাঁরা উভয় ক্ষমতান্ধে একঘাঁটে ঘোলাজল পান করে ক্ষতার চাষী লাঙ্গলের মালিক না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। একজোটে আবদ্ধ হয়ে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ীর লক্ষ্যে বেসামালে দিশাহারাও বটে। যার জলজ্যন্ত উদাহরণ, নৌকার মাঝি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং তাঁর ‘বিশেষ দূত’ পদ নয়া সৃষ্টি করে ওই পদে গৃহপালিত তথাকথিত বিরোধী দলের প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম প্রস্তাব এনে তা বাস্তবায়নও করে ‘কলঙ্কিত ইতিহাস রচনার জনক’ হতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, সাবেক একজন রাষ্ট্রের প্রধানকর্তা অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি হয়ে প্রধানমন্ত্রীর আজ্ঞাবহ ‘বিশেষ দূত’ পদটি লাঙ্গলের চাষী এ কেমন নির্লজ্জভাবে তা সাদরে গ্রহণ করেছিলেন? যারা তিন দশক পল্লীবন্ধু খ্যাত লাঙ্গলের চাষীকে ‘স্বৈরাচার’ এর ধোয়াতুলে রাজপথ সরগম করার প্রাণপণ চেষ্টা করতো। উদ্দেশ্য হাসিল করতে লাঙ্গলের চাষীকে জেলের ভাতও খাওয়াতো। ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে তারাই আবার ‘বিশেষ দূত’ পদ আর ‘তথাকথিত বিরোধী দল’ অনুদান দিয়ে গলায় গলায় ভাব জমিয়ে ক্ষমতার মওকা মারছেন। রাজনীতিতে ঘোরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ওই যাত্রায় বাদ ছিল না বামপন্থীরাও। বরং বামপন্থীদের বিরুদ্ধে নৌকার মাঝি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর বহমানের চামড়া দিয়ে ঢুকঢুগি বাজানোর স্লোগানও দেওয়ার তথ্য-প্রমাণ জলজ্যন্ত। আর এখন বঙ্গবন্ধুর কন্যার চারপাশে বঙ্গবন্ধুর জিগির গাইতে মহাব্যধিব্যস্ত বামপন্থীরাও। একেই বলে রাজনীতিতে ‘যখন যা, তখন তা।’
প্রথম দিকে যদিও লাঙ্গল প্রতীক ওয়ালা আসন ভাগাভাগির গোল্লা মার্কা দশম সংসদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে জীবনের শেষ মুহুর্তে জনগণের থুথু থেকে বাঁচতে চেয়ে ছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন অপ্রিয় সত্য; জনবিচ্ছিন্ন নির্বাচনে অংশ নিলে জনগণ তাকে থুথু দেবেন। এ যাত্রায় জনগণ স্বৈরাচারারে কালিমা ভুলে তাকে সাড়াও দিয়েছিলেন যতেষ্ট। কিন্তু ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে লীগবাদীরা নাছড় বান্দা। উদ্দেশ্য হাসিল করতে আর অবস্থার বেগতিক দেখে ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ’ দেখিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার নামে লাঙ্গলের কান্ডারিকে ‘হাসপাতালে ভর্তি নাটক’ মঞ্চায়ন করে। ফলশ্রুতিতে ঈমান চোরদের পরিসংখ্যা বাড়তে থাকে। লাঙ্গলের কান্ডারি শিকার হন ঘরের শত্রুর ক্রমশ আক্রণের। শেষ অবধি ঘরের শত্রুদের বেইমানি আর স্বীয়ঈমানের বেহাল অবস্থার দরুণ গন্তব্যে পৌঁছিতে সক্ষম হননি লাঙ্গলের ধারক পল্লীবন্ধু উপাধিতে ভূষিত রাজনীতিতে মত পরিবর্তনের নাটের গুরু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
আজ বলার অপেক্ষা রাখে না, যে কাজ অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলে, সেই কাজকে যদি অসম্ভবের শিল্প হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, সেটা দোষের কিছু নয়। সুতরাং আওয়ামী লীগের এবং জাতীয় পার্টির ‘আতাত রাজনীতি’ যখন ক্ষমতার লোভে চির রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদ্বয়কে একঘাটে জল পান করাচ্ছে, নিশ্চয় ওই রাজনীতি শুধু ‘শিল্প নয়। অসম্ভবের শিল্পও বটে।
‘অবশ্যই’ বলার আগে বিচার করা জরুরি, কোনো উদ্দেশ্যে রাজনীতিকরা কী সম্ভাবনা সৃষ্টি করতেছেন, তা সুস্পষ্ট করা। শিল্পের সাথে রাজনীতির তফাত আছে। এক. অতি স্পষ্ট তফাত। দুই. বাস্তব তফাত। রাজনীতি কার্যক্ষেত্রে ক্ষমতা অর্জনের পথ ও প্রকরণ। সেকারণে শিল্পচর্চার মতো অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য বা আনন্দের সাধনায় রাজনৈতিককে চলে না। তাকে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নামতে হয়, সচরাচর আক্ষরিক অর্থেই নামতে হয়। কিন্তু গণতন্ত্রে ক্ষমতা অর্জনের প্রচেষ্টায় নীতি ও আদর্শের একটি স্বীকৃত ভূমিকা আছে। বাস্তব প্রয়োজন ও সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করে বিশুদ্ধ বা বিমূর্ত নৈতিকতার চর্চা নিশ্চয়ই অসম্ভব, কিন্তু কোনো নীতি না মেনে শুধুমাত্র ক্ষমতার স্বার্থে রাজনীতি করলে তাকে ‘শিল্প’ বলা জটিল। বর্তমানে ডিজিটাল বাংলায় ওই ক্ষমতাসর্বস্ব রাজনীতির স্ফূর্তিই প্রকট লক্ষণীয়। অন্য কোনো কারণে নয়, শুধুমাত্র দাঁড়িপাল্লা প্রতীক সর্মথকদের হেনেস্তা এবং ধানের শীষ স্লোগানের জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) ভোটের মাঠে চরম প্রতিহত করার তাড়নাতেই নৌকায় লাঙ্গল তুলে ‘জোর যার মুল্লুক তার রাজ্য’ দখল করার হীনমানসে স্বৈরাচার উপাধি দিয়েও শেষ অবধি রাজনীতির নাটের গুরুর হাতটি আগলে ধরে আওয়ামী লীগ প্রধান নির্বাচনী মঞ্চে অবতীর্ণ।
যদিও বিভিন্ন মহল থেকে মুখ ফুটে নৌকায় লাঙ্গল তুলে ক্ষমতার তীরে ভিড়ানোকে ‘বিষপান’-এর সমতুল্য আখ্যা দেওয়ার ঘটনাও অহরহ। ওই বিষগর্ভ রাজনীতিকে অনৈতিক আখ্যা দেওয়া অনর্থক, কারণ রাজনীতিকরা নৈতিকতার পাঠশালা খোলে বসেননি।
কিন্তু ক্যামেরার সামনে জোড়া দাঁড়াবার সময় নৌকার মাঝি এবং লাঙ্গল ওয়ালা নিশ্চয়ই একটি কথা বলতে পারেননি; যদি তাঁদের ওই আতাতি ‘বন্ধুত্ব’ ভোটের বাজারে সফল হয়, তার পরে তাঁরা কী করবেন? পরিস্থিতির, এবং হয়তো বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশদলীয় জোটের জনপ্রিয়তার চুট ঠেকাতে লাঙ্গলকে ড্রার্ম কার্ড আর রাজনীতিতে এরশাদকে নায়ক হিসেবে মানতে হয়েছে, কিন্তু বাংলার জনগণ জানেন, নৌকার সাথে লাঙ্গলের সম্পর্ক নাগরদোলার ছন্দে বাঁধা। বিএনপি জোটকে ঠেকানোর প্রয়োজনে ওই সত্য কিছু দিন নির্বাচনী শিকেয় তুলে রাখা যেতে পারে, কিন্তু শাসনের সুযোগ মিললে উভয়েই চাইবেন ওই সুযোগ আপন দলের স্বার্থে ব্যবহার করতে।
সেই অর্থে ক্ষমতার সুযোগ ছেড়ে দেওয়া আত্মঘাতের নামান্তর। আবার লাঙ্গল ওয়ালা পরিচিতির রাজনীতির ছক ভেঙে উন্নয়ন ও সুশাসনের নয়া ছক তৈরি করতে চেয়ে ছিলেন। মহাজোটবাদীদের হাত ধরে ওই চর্চা জারি রাখা সম্ভব হয়নি। তবে নিছক ভোটের তাগিদেই যদি জাতপাতের বৃত্ত ছেড়ে দিয়ে মহাজোটের শরীক দলগুলো সুশাসন ও উন্নয়নের পথে আসতে চায়, রাজনীতির কাঠামোয় পরিবর্তন অসম্ভব নয়। তার জন্য অবশ্যই নাগরিক সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে। বস্তুত, লীগ স্তবক আর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দল তথা গৃহপালিত বিরোধী দলের ‘নয়া রাজনীতি’ কতটা সফল হয়েছে, তা সমাজকে পরিচিতির পুরানো বলয় ছেড়ে দিয়ে মানসিকতায় কতটা অগ্রবর্তী ও আধুনিক করতে পেরেছে, তার প্রকৃত পরীক্ষা সময়ের ব্যাপারমাত্র। এখন সম্ভাব্যতার পরীক্ষা।
বিশেষ করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনীতিতে একটি বিশেষ শব্দ সংযোগ হয়েছিল। সেটি হলো ‘সংলাপ’। এখন আর ওই শব্দটিতে যথেষ্ট চমক নেই। ‘সংলাপ’ শব্দটির সঙ্গে এখন আমজনতার নিত্য ওঠাবসা। দেশের যত্রতত্র প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হিং¯্রতার অগণিত খবর মিলতেছে, তাদের একটি বড় অংশ সংলাপের আদলে ‘মন্তব্য’। ওই জাতীয় খবর তাই নাগরিকদের আর নতুন করে ভাবায় না। কিন্তু নৌকায় লাঙ্গলের মিলন ঘটনাটির মধ্যে এখনও নতুনত্ব শেষ হয়নি। এক. সেখানে শুধুমাত্র একটি ‘রাজনৈতিক আতাত’ হয়নি। বরং পরিপাটি ভাবে ‘ক্ষমতা আতাত’ ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
আজ আর বলার দোষের নয় যে, যারা রাজনৈতিক আতাতের আদলে ‘ক্ষমতা আতাত’ ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করেছে তারা জনগণের খাজনার টাকায় খেয়েপরা প্রশাসৈনিক ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’। (দুই) দেশের ভারপ্রাপ্ত অভিবাবক। (তিন) জরুরি অবস্থা জারিকারক। তারাই রাজনৈতি আতাতদের ক্ষমতার বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়েছে, অকুস্থলে উপস্থিত থেকে পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে।
আশার কথা হচ্ছে যে, বিশ্ব বিবেক উপলব্ধি করেছে ক্ষমতা উত্তেজনার স্বাদ নেওয়ার দুর্দম ইচ্ছার তাড়নাতেই ওই অপকর্ম। শুধু অভিনব নয়, ঘটনাটি ভয়াবহও বটে। কারণ যে নির্বাচনে ৩শত সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে প্রার্থী পাওয়া যায়নি। বাকী ১৪৬টি আসনে নির্বাচনের নামে ক্ষমতার ক্যারিশমায় ‘গায়েবি ভোট’ নাটক মঞ্চায়ন করা হয়। কিন্তু ঘটনাটিকে কোনো ভাবেই অকল্পনীয় বা বিরল বলা চলে না। বরং, এটা খুবই কল্পনীয়। কেনো কল্পনীয়? জবাবটি চারপাশের পরিবেশেই বিদ্যমান।
আধুনিকতম প্রযুক্তি ক্রমশ সহজলভ্য হয়ে দেশের প্রান্তিক মানুষটিরও মুষ্টিগত। যার দরুণ শহর থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষটিরও মাথায় রাজনৈতিক চিন্তা-ফিকির। অথচ, অনেক মানুষের সভ্যতার পাঠ এখনও অসম্পূর্ণ। রাজনীতিকে ঠিক কী রূপে এবং কতটা পরিমাণে ব্যবহার করলে কাঙ্কিত সুফল মিলবে, ওই বিষয়ে সম্যক জ্ঞানের অভাব প্রকট। জ্ঞান অর্জনে অনীহাও প্রবল। তুলনায় কুফলটি গ্রহণ করা অতিসহজ। তাতে নিষিদ্ধের স্বাদ গ্রহণের আনন্দও মেলে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- এক. স্মার্টফোন। দূরতম মানুষটির সঙ্গে তাৎক্ষণিক সংযোগ স্থাপন করার জন্য দৈনন্দিন জীবনে মোবাইল ফোনের প্রবেশ। অথচ, যথেচ্ছ অপব্যবহারের সৌজন্যে ওই যন্ত্রই এখন গোপনে ছবি তুলা, ব্ল্যাকইমেল করা এবং ‘উত্তেজনার স্বাদ নিতে’ অস্ত্রে পরিণত। সর্বোপরি, এটাতে একসঙ্গে অনেকে মিলে নিষিদ্ধের স্বাদ গ্রহণ করা যায়। প্রযুক্তির প্রতি বয়ঃসন্ধির আকর্ষণ স্বাভাবিক। সুতরাং অপরাধজগতে নাবালকদের পদচিহ্নও ক্রমবর্ধমান। অন্য দিকে, আধুনিক সমাজে সামাজিক নজরদারি বিলুপ্তপ্রায়। সন্তানের চালচলনের খুঁটিনাটি নজর করার প্রয়োজন মনে করেন না অভিভাবকরাও। সুতরাং, আগামী দিনে অপরিণত বুদ্ধিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের কী ধরণের ফল বয়ে আনতে পারে, তা আন্দাজ করার বিষয় নয়।
দুই. নির্বাচন। জনমতের প্রতিফলনের অন্যতম হলো জনতার রায়। সেকারণেই গণতন্ত্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠান হলো নির্বাচন কমিশন। বাংলাদেশে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠার পথ বারবার সঙ্কোচিত হওয়ার নজির অহরহ। এদেশের সব শাসনামলেই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি ও সন্ত্রাসের অভিযোগের অন্ত নেই। যদিও ‘ভোট কারচুপি’ আর ‘মিডিয়া ক্যু’ নির্বাচন প্রতিষ্ঠানটিকে ধংস করে দেয়। তারপরও পূর্বসুরিদের নিষিদ্ধ পথেই রাজনৈতিক লিডারদের নগ্ন প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত। এক্ষেত্রে কালের ইতিহাসের রেকর্ড ভেঙ্গেছে মহাজোট নামের নৌকার যাত্রীরা।
গণতান্ত্রিভাবে ক্ষমতা নিতে নির্বাচন ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন। অথচ, যথেচ্ছ অপব্যবহারের সৌজন্যে ওই নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানই এখন ক্ষমতায় যাওয়ার অস্ত্রে পরিণত। সর্বোপরি, এটাতে একসঙ্গে অনেকে মিলে নিষিদ্ধের স্বাদ গ্রহণ করছে। ক্ষমতার প্রতি ক্ষমতাকামীদের আকর্ষণ স্বাভাবিক। সুতরাং অপরাধজগতে ক্ষমতাকামীদের পদচিহ্নও ক্রমবর্ধমান।
সুতরাং, আগামী দিনে ক্ষমতার ক্যারিশমায় নির্বাচন ব্যবস্থায় ফলাফল কী হতে পারে, তা আন্দাজ করার জন্য ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা হওয়ার প্রয়োজন নেই। বস্তুত, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং মন্ত্রীসভা গঠন ঘটনা দু’টি সেই বিশাল হিমশৈলেরই একটি ক্ষুদ্র চূড়ামাত্র বললে দোষের কিছু হবে বলে অন্তত আমরা মনে করি না।
আমরা বলতে চাই, অপব্যবহারের ভয়ে প্রযুক্তি হতে দূরে সরে থাকা যেমন বিধেয় নয়। তেমন কারচুপির আশঙ্কায় নির্বাচন বর্জন করত প্রতিপক্ষকে খালি মাঠে রাজনৈতিক গোল দেওয়ার পথ নিরাপদ করে দেওয়া কা-জ্ঞানের পরিচায়ক নয়। বরং সুস্থ্য ভাবে বাঁচতে হলে প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হবে। গণতান্ত্রি প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হতে চাইলে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে হবে। এসবকে ধ্রুব ধরেই সমাধানের পথ খুঁজতে হয়। অবশ্যই ওই পথ রাষ্ট্র-নির্দেশিত না হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাধার প্রাচীর তুলে অপরাধ দমন করার পরিবর্তে যে পরিবেশ ওই শত শত অপরাধের জন্ম দিতেছে, তা শোধরানোর প্রচেষ্টা অধিক কার্যকর।
ক্ষমতার প্রতি কৌতূহল অস্বাভাবিক নয়। ওই আকর্ষণ শুধুমাত্র বিরোধীদেরই আছে, ক্ষমতাসীনদের নেই, এমন পক্ষপন্থী ধারণাও সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কিন্তু কৌতূহল যাতে বিকৃতির চেহারা না নেয়, সে দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। সুস্থ, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ যেমন বিকৃতির সম্ভাবনা কমায়। নিরপেক্ষ জনমত যাচাই ব্যবস্থা তেমন জনমতের প্রতি ফলন ঘটায়।
সুস্থ্য, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব পরিবারের, সমাজের। নিরপেক্ষ জনমত যাচাই ব্যবস্থা নিশ্চিত করণের সুযোগ, সক্ষমতা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কাজেই সমাজের কাজ যেমন রাষ্ট্র করতে পারে না। অভিভাবকের কাজ তেমন সবাইকে দিয়ে হয় না। রাজনৈতিকরা ছাড়া রাজনীতির ফলন ঘটাতে অন্য কারোর পক্ষে অসম্ভবই বটে। কাজেই আপনারে জাহির নয়, বরং আপনারে সজাগ রাখাই হবে সত্যিকারের রাজনীতির নেতৃত্ব।