দুর্দান্ত সিনেমার মত যে কাহিনী! ‘আমার সামনে আমার ভাই আফজালকে টর্চার করেছিল পুলিশ। আমার বাবাকেও খুব মেরেছিল। চেয়ারে মোটা রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে মারছিল। তখন আমি আমার ভাই-বাবাকে টর্চারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বলেছি, হ, আমরা এই কাজ করেছি। তখন পুলিশ আমাদের বলেছিল, ওসি, ডিসি, এসপি যে আসবে, যদি জিজ্ঞাসা করে, তাদের বলবি, তোরা সাঈদকে অপহরণ করে মেরে ফেলেছিস।’ উপরোক্ত কথাগুলো কিশোর আবু সাঈদ খুনের মামলার আসামি সোনিয়া আক্তারের। ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে এভাবে চলছিল কিশোর আবু সাঈদ অপহরণ ও খুনের ‘নাটক’। অথচ কিশোর আবু সাঈদ আদৌ খুনই হয়নি। এ খুনের মামলায় দুই দফা রায়ের জন্য দিনও ধার্য করেছিলো আদালত। আবু সাঈদ খুনের মামলার আফজাল ৩৩ মাস, সাইফুল ২৪ মাস এবং সোনিয়া ৬ মাস কারাভোগও করেছেন। এ হলো ‘নাটকের’ মূল কথা।
এতে প্রমাণিত হয় পুলিশ নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকে অপরাধ না করেও দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হয়। একটা স্বাধীন দেশের ডিবি অফিসে এসব কাজই কি চলে? ওই ডিবি পুলিশকে রিমান্ডে নিয়ে বের করা হোক, কার কাছ থেকে কত টাকার লেনদেনে, কেন সে এমন কা- করেছে। ডিবির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রুহুল বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এই খুনের মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছিলো’। তাহলে সে কর্তৃপক্ষ কারা? পুলিশ জনগণের নিরাপত্তা দেবে এই সত্যটি বিশ্বাস করা যায় কী? কোন একদিন এরকম ঘটনা কার জন্য অপেক্ষা করছে বলা কঠিন।
সোনিয়ার দাবি, এক দিন, দুই দিন না, ৯ দিন ডিবি অফিসে ফেলে নির্যাতন করে আমাদের কোর্টে হাজির করে। আমরা ডিবি অফিসের গারদঘরে ছিলাম। পুলিশ বলেছিল, তোদের বাবাকে এক শর্তে ছাড়তে পারি, যদি তোরা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিস, তাহলে তোদের বাবাকে ছেড়ে দিতে পারি। আমার বাবার মাথায়ও পিস্তল ঠেকিয়েছিল। বলেছিল, তোরা যদি কোর্টে গিয়ে না বলস, তাহলে তোর বাবাকে মেরে ফেলব। আমরা ভাবছি, সত্যি আমাদের মেরে ফেলবে। পরে আমরা বলছি, হ, আমরা কোর্টে গিয়ে বলব। সোনিয়া জানান, ওই ঘটনার পর থেকে তার বাবা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
আবু সাঈদ অপহরণ ও খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির এসআই রুহুল বলেন, নির্যাতন করার সব অভিযোগ মিথ্যা। নির্যাতনই যদি না করা হয়, তাহলে এমনি এমনি কেউ খুনের দায় স্বীকার করে নেবে? এটাই কি পুলিশের পেশাদারিত্বের উদাহরণ। তদন্ত কর্মকর্তা রুহুল আমিন ২০১৫ সালের ১৫ জুন আদালতে আফজাল, তার বোন সোনিয়া আক্তারসহ চারজনের নামে ৩০২ ধারায় অভিযোগপত্র দেন। এতে বলা হয়, আসামিদের গ্রেপ্তার করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মুঠোফোনের কললিস্ট সংগ্রহ করে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আসামিদের তিনি শনাক্ত করেন। অপহরণ করার পর ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল আবু সাঈদকে এমভি অভিযান নামের লঞ্চে নিয়ে আসা হয়। সেদিন রাত সাড়ে ১২টায় আবু সাঈদকে ঘুম থেকে তোলা হয়। এরপর আসামি আফজাল ও সাইফুল আবু সাঈদকে লঞ্চ থেকে ধাক্কা মেরে নদীতে ফেলে দেন। কত ‘দক্ষতার’ সাথে দেশের পুলিশ বাহাদুরি দেখানোর মত প্রমাণসহ বের করলো কারা কারা আসামি। আবু সাঈদ খুনের মামলা তারই একটি নজির! দেশের আদালতে কত মামলা ঝুলছে। বিচারকের হাতে কত কাজ। কত মানুষ বিচারের আশায় কাঁদছে। অথচ ঘুষখোর ‘ভাদাইম্মা’ ডিবি পুলিশের সাজানো একটি ভুয়া মামলায় বিচারপতিদের ৪ বছরব্যাপী কত মূল্যবান সময় নষ্ট করতে হয়েছে। এমনকি খুনের মামলায় দুই দফা রায়ের জন্য দিনও ধার্য করেছিলো আদালত। বিচারের শেষ পর্যায়ে জানা গেল ছেলেটি খুনই হয়নি।
কত বিচিত্র নাটক হয় এ দেশে! কিভাবে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। একজন তদন্ত কর্মকর্তা কি নির্লজ্জ মিথ্যাচার করলেন! আবার বলে, ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে মুঠোফোনের কললিস্ট সংগ্রহ করে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আসামিদের তিনি শনাক্ত করেন। ওই পুলিশকে ধরে ‘চেয়ারে মোটা রশিতে হাত-পা বেঁধে’ ওই স্টাইলে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। কার সার্থে, কি কারণে, কত লেনদেনের বিনিময়ে এরকম মিথ্যা অভিযোগপত্র দিলো।
মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, আবু সাঈদের বাবা আজম ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে অপহরণ মামলা করেন। আজম দাবি করেন, তার ছেলে সেদিন হাজারীবাগের বড় মসজিদ মাতৃপীঠ স্কুলের উদ্দেশে রওনা হয়। কিন্তু আর বাসায় ফেরেনি। ডিবি পুলিশ তদন্ত করে ৪ জনের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় ২০১৫ সালে অভিযোগপত্র দেয়।
আবু সাঈদ ফিরে আসায় পুলিশের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এই কথিত হত্যার ঘটনার আসামিরা দাবি করছেন, ডিবি অফিসে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে সাঈদ হত্যায় জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। স্বীকারোক্তি দেওয়ার ব্যাপারে সাইফুল বলেন, বরিশাল থেকে কালো কাপড় বেধে আমাদের ঢাকার ডিবি অফিসে নিয়ে আসা হয়। চোখ বাঁধা অবস্থায় পুলিশ টর্চার করেছে। পুলিশ বলেছিল, তোমরা বলবা, তোমরা সাঈদকে লঞ্চ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছ। যদি আদালতে এই কথা বলো, তাহলে তোমাদের আর মারা হবে না। কিন্তু আমরা তো এ ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।
সাইফুল বলেন, হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে আমাকে জানালার সঙ্গে বাধা হয়। আমাকে লাঠি দিয়ে মারধর করত। একদিন রাতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ডিবির পুকুরপাড়ে। এসআই রুহুল আমিন আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলে, তুই যদি ঘটনা না বলিস, তাহলে তোকে মেরে ফেলব। কোনো দিন মায়ের কোলে ফিরে যেতে পারবি না। তখন আমি বললাম, স্যার, আমাকে মারবেন না। তখন আমার মনে হয়েছিল, মরার থেকে বেঁচে থাকা ভালো। মিথ্যা কথাটা যদি সত্যভাবে বলি, বেঁচে তো থাকব। জীবনটা তো বাঁচবে।
জনৈক ভুক্তভুগি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে মূর্তমান আতংকের নাম ডিবি’, তিনি আরো বলেন, ‘ডিবি পরিচয়ে দেশে কি যে ঘটছে, তা বলে বোঝানো যাবে না। যারা এর শিকার শুধু তারাই হাড়ে-হাড়ে বুঝতে পেরেছেন’। বিষয়টা খুব লজ্জাজনক। যারা অপরাধ তদন্ত করে সত্য উদঘাটন করবে, তারাই কিনা অপহরণের নাটক সাজিয়ে নিরাপরাধ মানুষকে ফাঁসাচ্ছে। এভাবে রাষ্ট্রীয় ঝালে-তেলে রেখে, আইনের লোক হয়ে, সরকারি পোষাক, অস্ত্র, গাড়ি, বাড়ি ও রেসনের সুবিধাভুগি এসব দুষ্কৃতিকারী ও ডাকাতদেরকে আমরা কতদিন পুষবো?
ওরা মানুষকে আটকিয়ে, লটকিয়ে মানুষের চরম সর্বনাশ ও সর্বসান্ত করার কূটকৌশল খুব ভালোভাবেই রপ্ত করেছে। পাবলিকের প্রতি ওদের ভাবটা হলো, ‘মাইরও খাবি, সালামও দিবি, সেলামিও দিবি’। উপায় কি; এর ব্যতিক্রম হলেই লটকে দেবে! চোখ উল্টিয়ে, মাথায় পিস্টল ঠেকিয়ে পৈত্রিক সম্পত্তি ভোগ দখলের মতো পাবলিকের পকেটের টাকায় নিজের বৈধ অধিকার আছে মনে করে ‘বিষ্ঠা’ গেলে। ওরা ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের সাথে টাকার ভাগবাটোয়ারা করে খায়।
সরকার যেখানে মাদকের বিরুদ্ধে চলছে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। সেখানে গত ২১ আগস্ট ১২০০ পিস ইয়াবাসহ মাদক কারবারি আহম্মদকে গ্রেপ্তার করে নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) একটি দল। কিন্তু এ সংবাদ প্রকাশ্যে আসার সময় সেটা কমে আসে ৪২০ পিসে। এটুকুই নয়, গ্রেপ্তারের ৪৮ ঘণ্টা পর আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয় মাদক কারবারিকে। উক্ত মাদক কারবারি আহম্মদ শাহীন হত্যা মামলার আসামি এবং এলাকার শীর্ষ মাদক কারবারি জুয়েলের পিতা। কথা হচ্ছে, যাদের মাধ্যমে মানুষ শান্তিতে বসবাস করার চিন্তা-ভাবনা করে তারাই যদি এ রকম সন্ত্রাসী, মাদক কারবারিদের সাথে মিলিত হয়ে যায়, তাহলে মাদক নির্মূল তো দূরের কথা এলাকায় এদের তা-বে থাকতে পারবে কি কেউ?
পুলিশের স্বল্প কিছু অর্জন থাকলেও এই সব দুস্কৃতিকারীদের জন্য তা ধুলায় মিশে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, ঘুষখোর ও চাঁদাবাজ এসব পুলিশ সদস্যের অপকর্মের দায় গোটা বাহিনীর ওপর চাপিয়ে দেয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর ওপর অবিচারের নামান্তর।
দেশের প্রতিটি সরকারি বিভাগ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। তা এ মুহূর্তে দমাতে না পারলে দেশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রোগটি ছড়িয়ে গেছে, আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চপর্যায়ের উচ্চ বেতনভুক্ত কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক প্রভাব এসব দুর্নীতির সাথে জড়িত। ইতোপূর্বে গবেষণা সংস্থা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের’ এক প্রতিবেদনে এসেছে, আইন লঙ্ঘনের দায়ে পুলিশকে শাস্তি দেয়ার ঘটনা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম। প্রবাদ রয়েছে ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’! ডিবির এসআই রুহুল বেচারা আসলে ফেঁসে গেছেন। এরকম অপকর্মের অভ্যাস বহুদিনের। অতি লোভে আশপাশের অনেক কিছুরই হুশ থাকে না। এমন অপকর্ম তো বহু আগে থেকেই তাদের কাছে ডাল-ভাত। তাই এতো রাখঢাক ভয়-ভীতির কি আছে? ওরা ভাবে এখন ‘ধরা’ খাওয়ার জন্য লোকদেখানো সাময়িক বরখাস্ত, বহিস্কার, বিভাগীয় শাস্তির নাটকের আইওয়াসের মহড়া ছাড়া আর কি হবে?
দুষ্ট ও নিকৃষ্টদের কারণে সত্য আজ নিরবে কাঁদে। মানুষ এখন আর নেইকো মানুষ। মিথ্যায় জর্জরিত সাজানো মামলার কারণে নিরাপরাধ লোকগুলো (সোনিয়া, আফজাল, শাহীন, সাইফুল) পুলিশ দ্বারা নির্যাতিত হয়ে কতই না কষ্ট করল। এই বিচার কি তারা পাবে? আর বিচার পেলেও তাদের জীবনের হারানো দিনগুলো ফিরে পাবে? কথিত এই হত্যাকা- ও তার যে বিচার হচ্ছে, যা সাজানো মিথ্যা মামলা। এর থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই বিচারপ্রক্রিয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাক্ষী পর্যন্ত বহু লোক জড়িত আছেন, যারা ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব এবং অপরাধমূলক কার্যক্রমের তদন্তের জন্য কমিশন অব ইনকোয়ারি অ্যাক্টের অধীনে একটা তদন্ত কমিশন গঠন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি নয় কী?