আন্তর্জাতিক বন্দরে নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদারের আওতায় ২০১৭ সালের ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শন করেছিল মার্কিন একটি প্রতিনিধিদল। চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দুর্বল আখ্যা দিয়ে দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা (International Ship and Port Facility Security -আইএসপিএস কোড) নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিলো জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থার (International Maritime Organization) -আইএমও’র পক্ষ থেকে। দুই বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থার ঘাটতি দূর করতে যে ১৬ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্রতিনিধিদল, তা এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হলেও অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে।
সূত্রমতে, নির্দেশনাগুলোর মধ্যে কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও, মানুষ ও যানবাহন আসা-যাওয়ার ফটকে উন্নত মানের নিরাপত্তাব্যবস্থা স্থাপনসহ কয়েকটি নির্দেশনা বাস্তবায়নে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। তবে পুরো বন্দর এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা হয়নি। কনটেইনার খুলে আমদানি পণ্য খালাসের ব্যবস্থাটি বন্দরের ভেতর থেকে বাইরে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হলেও তাতে তেমন অগ্রগতি নেই। ফলে প্রতিদিন ১০-১২ হাজার মানুষ বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় যাতায়াত করে, যা বন্দরের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
এমতাবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ ৪২টি স্থাপনার নিরাপত্তাব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ডের প্রতিনিধিদলটি গত সপ্তাহে আবারও বাংলাদেশে আসে। আইএসপিএস কোড অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ ৪২টি স্থাপনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। তারা বন্দরের সংরক্ষিত এলাকার বিভিন্ন গেট, শেড ও জেটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং পণ্য হ্যান্ডলিং পর্যবেক্ষণ করেন। পরে চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করে অসম্পূর্ণ কাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়ে পাঁচ দফা সুপারিশ করে আমেরিকান কোস্টগার্ডের তিন সদস্যের ওই প্রতিনিধি দল। বন্দরের নিরাপত্তা বিশ্বমানে উন্নীত করতে সাইবার নিরাপত্তা, পণ্যবাহী কন্টেইনার স্ক্যানিং এবং বন্দরের ভেতরে পণ্য খালাস বন্ধের উপর জোর দেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। মার্কিন কোস্টগার্ড কর্মকর্তারা বন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি তারা বিশ্বমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিছু পরামর্শও দেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ আইএসপিএস কোড অনুযায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যেসব ব্যবস্থা নিয়েছেন তা পর্যবেক্ষণ করেন তারা।
সূত্র জানায়, জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা আইএমওর পক্ষে নির্দেশনার বেশিরভাগ বাস্তবায়নে বন্দর কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিলেও বেকায়দায় রয়েছে বন্দরের বাইরে ডেলিভারি কার্যক্রম শুরু নিয়ে। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বন্দরের অভ্যন্তর থেকে ডেলিভারি কার্যক্রম বাইরে সরিয়ে নেয়ার জোর সুপারিশ করেন। কারণ ভেতরে পণ্য ডেলিভারি হওয়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার চালক ও সহকারী বন্দরে প্রবেশ করে। তবে, বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল জুলফিকার আজিজ তাদের আশ^স্ত করে বলেছেন, পণ্য খালাসের পদ্ধতি বন্দরের বাইরে নেওয়ার জন্য বে টার্মিনালে ইয়ার্ড নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এদিকে বন্দরের প্রবেশ ও বের হওয়ার আলাদা পথে নিরাপত্তার যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, ডিজিটাল পাস ছাড়া বন্দরে এখন প্রবেশ বা বের হওয়ার সুযোগ নেই। এ পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার জনকে ডিজিটাল পাস দেওয়া হয়েছে, যাদের সবারই তথ্য আছে বন্দরের ডেটাবেইসে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সুপারিশের পর বন্দরে সিসিটিভি ক্যামেরার সংখ্যা ১২৮ থেকে বাড়িয়ে ৪৫৯টিতে উন্নীত করা হয়েছে। তবে বন্দরের হিসাবে, পুরো এলাকা তদারকির জন্য ৭০০ থেকে ৮০০ সিসিটিভি ক্যামেরা দরকার।
উল্লেখ্য, বন্দরের যেসব নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০০৪ সালের ১ জুলাই। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর জাতিসংঘের অধীন আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা বিভিন্ন বন্দরের নিরাপত্তাসংক্রান্ত ব্যবস্থা বা আইএসপিএস কোড (জাহাজ ও বন্দর স্থাপনার নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম) প্রণয়ন করে। জাহাজ বা কনটেইনারে বিপজ্জনক পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে যাতে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে ব্যবহার করা না হয়, সে জন্যই এই নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৪৮টি দেশের বন্দরে তা বাস্তবায়িত হয়েছে।