ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে ওঠা ‘বিতর্কের’ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু কেন? কারণ একটাই- ‘কুল রাখি না মান রাখি।’ আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন নগণ্য কর্মী ছিলাম, এখন নতুনধারার রাজনীতি প্রবর্তন করলেও এই ছাত্রলীগের কোন বিপদ দেখলে কথা বলবো, পথ দেখাবো বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে। সেই কাজটি অবশ্য শুধু আজ নয়; অন্তত গত ১০বছর করে আসছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায়নকে বিদায় জানানোর পাশাপাশি ২০০৯ থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতিকেও বিদায় জানিয়ে দীর্ঘদিন নিরব দর্শকের ভূমিকায় ছিলাম। অথচ আমার নেতৃত্বে কলা ভবনের সামনে মাননীয় প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তির দাবীতে প্রথম মানববন্ধন হয়। যেখানে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সহ-সভাপতি এটিএম শামসুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক অরুণ সরকার রানা, সাংবাদিক তানভীর আলাদীন, তৎকালিন ছাত্রনেতা শান্তা ফারজানা সহ সাহসী মানুষেরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর নেত্রীর মুক্তি ও নির্বাচনে বিজয়ের পর দুর্নীতি বেড়েছে, বেড়েছে অন্যায় আর অপরাধ। যা দেখে সরে এসেছি ধীরে ধীরে। ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাজনীতির নামে অপরাজনীতি, নীতির নামে দুর্নীতিতকে ‘না’ বলে গড়েছি ছাত্র যুব জনতার রাজনৈতিকধারা বাংলাদেশ এনডিবি। কিন্তু বরাবরের মত স্বাধীনতার পক্ষে ছিলাম আছি থাকবো বলেই কলম তুলে নিয়েছি ছাত্রলীগের বর্তমান সংকট নিয়ে কিছু লিখবো বলে। প্রথমত ওবায়দুল কাদের সাহেব যে বলেছেন, ‘আমি এ নিয়ে (ছাত্রলীগ) আর কোনো কথা বলব না। কারণ আমাদের সভাপতি দেশরতœ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি দেখছেন। এ নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। আমি একটা বিষয় বুঝি না, একটা ছাত্র সংগঠন নিয়ে এত লেখালেখি! আপনারা (সাংবাদিকরা) কি মনে করেন, দেশের অন্যান্য ইস্যুর তুলনায় ছাত্রলীগ ইস্যু এখন প্রাধান্য পায়?’ সে সকল কথা হলো- নিজকে বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা। তা না হলে যে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দের ৪-৬ পারসেন্ট চাঁদা দাবির সে ছাত্রলীগকে ইস্যুর বাইরে রাখার চেষ্টা মানে তিনি ছাত্রলীগের কল্যাণ চান না। চাইলে তিনি নিজে যেভাবেই হোক দ্রুত পদক্ষেপ নিতেন এবং সমাধানের ব্যবস্থা করতেন। যাতে করে ঐতিহ্যের রাজনীতিতে ছাত্রলীগের যে অবস্থান তা বহাল থাকে। তা না করে উল্টাপাল্টা কথা বলায় আজ জাতি জেনেছে যে, ৮ আগস্ট রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সঙ্গে তার বাসভবনে দেখা করে চাঁদা চেয়েছে ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। শুধু এখানেই শেষ নয়; জাতির পিতার দেশে, তাঁর আদর্শকে পায়ে ঠেলে উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার পেয়েছে- এমন কোম্পানির কাছ থেকে ভিসিকে টাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেন শোভন ও রাব্বানী। কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) তাতে রাজি না হওয়ায় তার সঙ্গে দুই নেতা রূঢ় আচরণ করেন। এরপর ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম তার বাসভবনে গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর বিষয়ে আলোচনা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেন, ওরা (শোভন-রাব্বানী) তোমাকেও কষ্ট দিল।’ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিকে কোন পথে নিয়ে আর অন্যায়ের রাস্তা প্রশস্থ হবে না, তা যদি এখই না ভাবা হয়; তাহলে হয়তো এমন আরো ঘটনা ঘটতেই থাকবে বলে আমি মনে করি। অবশ্য এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যারা দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলন করছে, তারা দুর্নীতির প্রমাণ করুক।’ এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান আন্দোলন, অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প, প্রকল্প বাস্তবায়ন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও শাখা ছাত্রলীগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান ভিসি। অন্যদিকে নির্বিঘেœ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঈদের আগে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে এক কোটি ও শাখা ছাত্রলীগকে এক কোটি টাকা দেয়া হয়েছে- এমন অভিযোগে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনে চালিয়ে যাচ্ছে একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশের রাজনীতি বা ছাত্র রাজনীতির একটা বড় অংশজুড়ে থাকা এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে-বিপক্ষে নানা কর্মসূচিতে সরগরম। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জাবি ভিসি। আমি যতদূর জেনেছি- ইদুল আজহার আগে ৮ আগস্ট রাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ভিসির বাসভবনে এসে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তারা ভিসিকে উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার পাওয়া কোম্পানি থেকে কয়েক পার্সেন্ট টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে বলেন। কিন্তু ভিসি তাতে রাজি না হওয়ায় তার সঙ্গে তারা রূঢ় আচরণ করেন। সেই সাথে অভিযোগ উঠেছে- ‘সেদিন তারা (শোভন ও রাব্বানী) আমাকে বলে, এত বড় প্রকল্প, আপনি আমাদের সহযোগিতা করেন, আমরাও আপনাকে সহযোগিতা করব। আপনি কোম্পানিগুলোকে বলে দেন তারা যেন আমাদের কিছু (পার্সেন্ট) টাকা দেয়। আমাদের টাকা দিলে আমরা স্থানীয় (জাবি) ছাত্রলীগকে তা থেকে কিছু দিয়ে দেব। কিন্তু আমি তাদের কথায় রাজি হইনি এবং মুখের ওপরে বলে দিয়েছি আমি কোনো টাকা-পয়সার মধ্যে নেই। তখন তারা আমাকে বলল, আপা (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয় দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন। সেজন্য আপনার কাছে এসেছি। তখনও তাদের কথায় সাড়া না দেয়ায় তারা আমার সঙ্গে বেশ উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা শুরু করে। এর কিছু সময় পর তারা চলে যায়।’ তারা কত পার্সেন্ট দাবি করেছিল- এমন প্রশ্নে ভিসি বলেন, ‘দু-এক পার্সেন্ট না, তারা চার কিংবা ছয় পার্সেন্টের কথা বলেছিল।
কতটা বেপরোয়া হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজে চাঁদা দাবী করতে পারে! অমি ভেবেই পাই না, যেখানে উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন কাজের জন্য এ বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে ৫টি আবাসিক হল (তিনটি ছাত্র ও দুটি ছাত্রীনিবাস) নির্মাণের জন্য ৩৬৭ কোটি টাকার টেন্ডার চূড়ান্ত হয়েছে। সেখানে ছাত্র হয়ে অন্য ছাত্রদের মঙ্গলের কথথা না ভেবে চাঁদা উঠিয়ে সেই প্রকল্পকে নষ্ট করে দেয়াার এই চেষ্টায় একবারও বুক কাঁপেনি! ভাবেনি একবারও দেশ ও মানুষের কথা! জাতির পিতার কথা, প্রধানমন্ত্রীর কথা!
অবশ্য আমি সাহসের জন্য ধন্যবাদ জানাবো বরাবরের মত প্রিয় শিক্ষক ফারজানা ইসলামকে। তিনি নির্ভিক ভাবে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সময় বলেছেন, ‘আপনি নাকি সব বিশ্ববিদ্যালয় দেখাশোনা করার জন্য তাদের (শোভন-রাব্বানী) দায়িত্ব দিয়েছেন?’ তখন প্রধানমন্ত্রী হেসে বলেন, তাহলে আপনাদের দায়িত্ব কী? আমি তাদের কেন এ দায়িত্ব দেব? এ সময় প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় নেতাদের বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন।’ এ সময় তিনি জাবি ছাত্রলীগ সম্পর্কেও কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানাকে ‘ভালো’ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম সুফিয়ান চঞ্চলকে ‘দূরে থাকে বা নিষ্ক্রিয়’ বলেও মন্তব্য করেছেন। আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ভিসি বলেছেন- প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে চলমান আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, ‘সম্মানী মানুষকে কেন (তদন্ত কমিটি করে) আমরা অসম্মানিত করব? যারা আপনাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলছে, তারাই প্রমাণ করুক। কোনো উড়ো চিঠি কিংবা উড়ো খবরের ভিত্তিতে কিছু করা হবে না।’ ভিসি আরও বলেন, ‘এ সময় প্রধানমন্ত্রী আমাকে দুশ্চিন্তা না করার পরামর্শ দিয়ে আমার প্রতি আস্থা প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বলেছেন, যদি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প না চায় তবে দেব না। আপনি না বলে দেন। তবে এ নিয়ে যেন আন্দোলন না হয়।’ এ সময় তিনি (প্রধানমন্ত্রী) পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ ও আড়িয়াল বিলের প্রকল্পকে উদাহরণস্বরূপ উপস্থাপন করেন বলেও জানান ভিসি।
কথায় আছে- ভবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। এই কাটি ভুলে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ওপর প্রধানমন্ত্রীর বিরূপ মন্তব্যের পর ভিসির কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য রাব্বানী প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন। রাব্বানীর অনুসারী বলে পরিচিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মাহবুবর রহমান সালেহী, ছাত্রলীগ কর্মী নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৪২ ব্যাচের রতন বিশ্বাসসহ চারজন ভিসির সঙ্গে দেখা করতে তার বাসভবনে যান। তবে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম তাদের সঙ্গে দেখা করেননি বলেও সূত্রটি নিশ্চিত করে। তবে সালেহী ওইদিন ভিসির সঙ্গে দেখা করতে যায়নি বলে দাবি করেন।
উদ্ধত কতটা হলে প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভিসি দেখা করে যে কথাগুলো বলেছেন, সেই কথাগুলোকে মিথ্যে বলতে পারে! ততটা উদ্ধত হওয়াতেই হয়তো এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা ভিসি ম্যামের সঙ্গে দেখা করেছি, সেটা সত্য। তবে আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটি মোটেও সঠিক নয়। ভিসি ম্যাম ঈদের আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন। তার একটি টাকাও আমাদের ছিল না। অথচ বলা হচ্ছিল, আমাদের টাকা দেয়া হয়েছে। পরে তার ছেলের মাধ্যমে তিনি আমাদের কল করিয়েছেন। তখন আমরা সেখানে গিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেখানকার একটি কাজের জন্য আমাদের ছাত্রলীগের সাবেক এক বড় ভাইয়ের ফার্মের জন্য বলেছিলাম। ভিসি ম্যাম সেই ফার্মকেও কাজটা দেননি। আমরা সেটা নিয়েও কিছু বলিনি। অথচ এখন উল্টো আমাদের নামে বলা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক শ কোটি টাকার কাজ হয়েছে, সেখানেই আমরা কিছু করিনি। কেউ আমাদের বিরুদ্ধে একটা কথা বলতে পারেনি। তাহলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কেন করব।’
এই বেপোরায়া সময়ে এসে পৌছে যাবো, ভাবিনি কখনো। অথচ হলো তাই। এই পরিস্থিতির উত্তরণ চাই। সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশকে বাঁচাতে তাই সবার এগিয়ে আসা চাই। তা না হলে হয়তো দেখা যাবে বেড়ায় ফসল খেয়ে ফেলছে...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি