দেশে উন্নয়নের ছোঁয়া অনবদ্য। দিন-রাত কেবল উন্নয়ন আর উন্নয়ন। এত উন্নয়নে নিরন্তর খুশি আমরা। কিন্তু যখন জানতে পেরেছি যে, এই উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয় যেতে যেতে বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্তও নিচ্ছে সরকার। এমনই এটি ভুল হলো- চারলেনের মহাসড়কে টোল আদায়। এতে ভাড়া বাড়বে, বাড়বে ভোগান্তিও।
আমাদের রাজনীতিকে কাজে লাগিয়ে অপরাধের স্বর্গরাজত্ব তৈরির চেষ্টায় অগ্রসর হচ্ছে বলেই গোষণা এসেছে- সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতাধীন চারলেনের মহাসড়কগুলোতে গাড়ি চলাচলের ওপর টোল আদায় হবে। এ লক্ষ্যে পরিকল্পনা সাজাচ্ছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। কোন মহাসড়কে কত টোল হবে, আদায় পদ্ধতি নির্ধারণে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব তৈরি করতে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হচ্ছে। ওই কমিটির সুপারিশের আলোকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-ফরিদপুর (ভাঙ্গা) ও জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ক বিবেচনায় রয়েছে।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের কথা না ভেবে, জনগনের কথ না ভেবে, একনেকের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জাতীয় মহাসড়কগুলো টোলের আওতায় আনার নির্দেশ কিভাবে দিলেন, তা আমার বোধগম্য নয়; যেখানে দেশ ও মানুষের জন্য উন্নয়ন; সেখানে সেই জনগনের কথা না ভেবে ক্রমশ সবগুলো সেক্টরে মূল্য বৃদ্ধি, টোল আাদায় সহ অসংখ্য দায় চাপিয়ে দেয়ার এই চেষ্টা থেকে সরে আসা প্রেেয়াজন বলে অমি মনে করি। আমার তো দূরের কথা, জনগনের কথা না ভেবে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন টোলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন মর্মাহত হয়েছি। আরো আশ্চর্য হয়েছি, গণমাধ্যম যখন বলেছে- এ সংক্রান্ত প্রস্তুতি শুরু করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা বলেন, মহাসড়কগুলোতে টোল আদায় সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন হবে। এছাড়া ঢাকা-রংপুর ও ঢাকা-ফরিদপুর (ভাঙ্গা) মহাসড়ক নির্মাণাধীন রয়েছে। তার উপর আবার এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন- চারলেনের সড়কগুলোতে টোল আরোপের পরিকল্পনা আছে। তবে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব তৈরি করব। তা অনুমোদনের পর কার্যকরের দিকে যাব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়েকটি চারলেন মহাসড়ক আছে, কিছু নির্মাণাধীন আছে। এসব বিবেচনায় রাখা হয়েছে। অন্যদিকে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা তারা গণমাধ্যমে জেনেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত লিখিত কোনো নির্দেশনা পাননি। তবে সড়ক বিভাগের সচিব চারলেনের মহাসড়কে কীভাবে টোল আদায় করা যায় তার একটি প্রস্তাব তৈরির বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আসার পরই এ সংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হবে। ওই কমিটি টোল নীতিমালা-২০১৪ অনুযায়ী এবং বাস্তব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি করবেন। তারা আরও জানান, বিদ্যমান নীতিমালায় সেতুর পাশাপাশি সড়কে গাড়ি চলাচলের ওপর টোল বিধান ও হার নির্ধারিত রয়েছে। অবশ্য বর্তমানে তিনটি মহাসড়কে টোল আদায় করা হচ্ছে। এ তিন মহাসড়কের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী টোলের হারেও ব্যবধান রয়েছে। এর মধ্যে নলকা-হাটিকামরুল-বনপাড়ার ৫০ কিলোমিটার সড়কে ২০০৩ সালের ১ মে থেকে টোল আদায় হচ্ছে। এ সড়কে ট্রেইলারে ১৯০ টাকা, হেভি ট্রাকে ১৫০ টাকা, বড় বাসে ৬০ টাকা, মাইক্রোবাসে ৩০ টাকা, ৩-৪ চাকার গাড়িতে ১০ টাকা ও মোটরসাইকেলপ্রতি ৫ টাকা হারে টোল আদায় করা হয়। ২০০৫ সালের ১০ মার্চ থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের জগদীশপুর-শেরপুর অংশে (রুস্তমপুর টোল প্লাজা) টোল আদায় করা হয়। ৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মহাসড়কে ট্রেইলারে ২৮০ টাকা, হেভি ট্রাকে ২২৫ টাকা, বড় বাসে ৭৫ টাকা, মাইক্রোবাসে ৪৫ টাকা, ৩-৪ চাকার গাড়িতে ১০ টাকা ও মোটরসাইকেলপ্রতি ৫ টাকা হারে টোল আদায় করা হয়। আর ২০০৮ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে টোল আদায় চলছে চট্টগ্রাম পোর্ট একসেস রোডে। মাত্র ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ হওয়ায় এ সড়কে টোলের হার অনেক কম। অবশ্য সবচেয়ে বড় কথা হলো- এক ফাঁকে কোন না কোনভাবে বলা হচ্ছে- মহাসড়কে টোল আরোপের ক্ষেত্রে এ তিনটি সড়কের টোল হার বিবেচনায় রাখা হবে।
তবে যতটুকু জানতে পেরেছি- টোল আরোপের আগে স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে বড় আকারের বৈঠক করতে হবে বা মহাসড়কগুলোতে বড় ধরনের অবকাঠামোগত পরিবর্তন ও স্থাপনা বসাতে হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তার অনেক আগেই টোল আদায় শুরু হওয়ায়বেড়েছে গাড়ি ভাড়া। এরই মধ্যে জনপ্রতি ২০ টাকা বাড়িয়ে বসে আছে মালিকপক্ষ। আমি যতদূর জানি- ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলা সড়ক রয়েছে। এছাড়া রাস্তার দুই পাশ দিয়ে অনেক সংযোগ সড়ক রয়েছে। একটি গাড়ি কোনো সড়ক দিয়ে এ মহাসড়কে উঠল, কোথায় যাবে তা শনাক্তের জন্য মহাসড়কে ব্যবস্থা রাখতে হবে। যে গাড়িটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবে আর যে গাড়িটি কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম যাবে তা চিহ্নিত করার জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বিষয়টি স্বীকার করে সড়ক বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, টোল আদায়ের আগে মহাসড়কে চলাচলকারী গাড়িগুলোকে বাড়তি সুবিধা দিতে হবে। এজন্য মহাসড়কে ধীরগতি ও দ্রুতগতির গাড়ির জন্য পৃথক লেনের দরকার হবে। স্বল্পদূরত্বের গাড়ির জন্য পৃথক সার্ভিস লেনের প্রয়োজন হবে। তারা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চারলেন হলেও এ মহাসড়কের সঙ্গে আলাদা সার্ভিস লেন নেই। এ দুটি মহাসড়কে ধীরগতি ও দ্রুতগতির গাড়ি একই সঙ্গে চলাচল করে। অপরদিকে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়কটির সঙ্গে পৃথক সার্ভিস লেন করা হচ্ছে। তবে এ সড়কটির কাজ ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া ‘সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্পের আওতায় এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর মহাসড়কটির সঙ্গে সার্ভিস লেন রাখা হচ্ছে। এটি শেষ হবে ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট। এর উপর আবার মরার উপর খড়ার ঘা’র মত করে চীনের ঋণে জর্জরিত হতে চলেছে বাংলাদেশ। যদিও বলা হচ্ছে যে, চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড কার্যক্রম সম্প্রসারিত হলে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেন চীনা ঋণের ফাঁদে না পড়ে। বেল্টের সুযোগসুবিধার সবক্ষেত্রেই আরও বেশি দরকষাকষি করতে হবে। খেয়ালও রাখতে হবে এই অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগের শর্তগুলোর দিকে। দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে টেন্ডার থেকে শুরু করে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের লক্ষ রাখতে হবে, বিআরআই যে ঋণ দিচ্ছে সেই ঋণে সুদের হার যাতে কম হয়। আমরা কেন ৩ শতাংশ দেব? ঋণ যেন এক শতাংশের নিচে হয়। আমরা যাতে ঋণের ফাঁদে না পড়ি। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হতে হবে রাজনীতির বাইরে গিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা।
তবে বাংলাদেশের উন্নয়ন আর অগ্রগতির উপর ভিত্তি করে একা সত্য বলেই মনে হচ্ছে- বিআরআই বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীন আমাদের দেশে বিনিয়োগ করছে এবং ভবিষ্যতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে। বিআরআইয়ের সুযোগসুবিধা নিয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা দরকার। বিআরআইয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নে অন্য দেশের সঙ্গে যেন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নষ্ট না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। প্রকল্পে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ যেন সমানভাবে উপকৃত হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিচার-বিবেচনা ছাড়া প্রকল্প নিলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। একইসঙ্গে প্রকল্প হতে হবে বাংলাদেশের সক্ষমতা বিবেচনায়। বিশ্ব বদলে যাচ্ছে দ্রুত। আমরা এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছি। সে কারণেই বাংলাদেশ যেকোনো ধরনের সামরিক জোটে যোগদান এড়িয়ে চলছে। তবে, নিজেদের স্বার্থরক্ষা করেই আমরা অন্য জোটে যোগ দিচ্ছি। আমরা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) যোগ দিয়েছি। এর মাধ্যমে আমরা লাভবান হব বলে আশা করি। এ উদ্যোগে যোগ দেয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি, ব্যবসা, বাণিজ্য, যোগাযোগসহ নানা বিষয়ে সহযোগিতা বাড়বে। বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্যে ইন্দো-প্যাসিফিক, ইউরো-এশিয়া ও বিআরআই উদ্যোগ আছে। আমরা সব উদ্যোগের সঙ্গে যাব। কোনো ক্ষতিকর কিছুর সঙ্গে থাকব না। যখন আমরা এসব নিয়ে দরকষাকষি করব, তখন জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেব। আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নের রাস্তা চাই, বাজারও চাই, কিন্তু সবকিছু যাচাই-বাছাই করে নেয়ার পর। যাতে করে কূলও থাকে মানও থাকে।
তা না হলে এই টোল, এই চাপিয়ে দেয়ার কারণে জনগনের জীবনমান যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তেমন ক্ষতিগস্থ বাংলাদেশের অর্থনীতি। এমনিতেই দেশের রেমিটেন্স সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির দ্বার ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এমতবস্থায় দেশে টোল, বিদেশে ঋণের ঝোল শেষে জামায় লেগে হ-য-ব-র-ল না হয়ে যায়; আমাদেরকে সব ভেবেই এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে ভালোবেসে আলো হেসে সবসময়...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি