বর্তমান দুনিয়ায় গণতন্ত্র একটি বিশ্বজনীন মতাদর্শ। মানুষের জীবনযাত্রার নানা কাল, পর্যায়ে যেমন চড়াই-উৎরাই থাকে। রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম প্রাচীনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রকেও নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে চলতে হয়েছে, আজও চলছে। জাতিসংঘ তার সকল সদস্য রাষ্ট্রকে নিজ নিজ জনগণের মাঝে গণতন্ত্রের গুরুত্ব, তাৎপর্য, নীতি, আদর্শসহ গণতন্ত্র সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি এবং গণতন্ত্র চর্চাকে উৎসাহিত করার গণসচেতনতা ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ২০০৭ সাল থেকে প্রতি বছর ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালন করে আসছে। যা বাংলাদেশের জন্য যুগপদ, সময়োপযোগী ও বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
এদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা বহুবার ঘাত-প্রতিঘাতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। ইতোপূর্বে ব্রিটিশ প্রভাবশালী পত্রিকা ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক জরিপে জানানো হয়, গণতন্ত্র প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৭টি দেশের মধ্যে ৮৫তম। ১১ জানুয়ারি (২০১৪) বিখ্যাত ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র পচে গেছে’। এতে স্পষ্ট যে, কার্যকর গণতন্ত্র থেকে এখনো অনেক দূর ও ঝুঁকির সম্মুখীন রয়েছে বাংলাদেশ। শুধু জাতীয় নির্বাচনে নয়, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনদের পেশিশক্তির কাছে হেরে গেছে গণতন্ত্র।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও নিবন্ধিত ৪০টি দলের মধ্যে ২৮টি দল গত দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। ওই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন না ঘটায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পেতে ব্যর্থ ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিলো। পরবর্তীতে গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। সে নির্বাচন যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ থেকে মুক্ত ছিলো না। শুধু বিএনপি কিংবা ঐক্যফ্রন্ট নয়, গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজ নির্বাচনের স্বচ্ছ্বতা, ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্রকৃতপক্ষে ২৮৮ সিট নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালি হয়নি। সরকার হিসাবে শক্তিশালি হয়েছে মাত্র।
গণতন্ত্র এমন একটি শাসন ব্যবস্থা, যেখানে নাগরিকের নীতিনির্ধারণ বা জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার থাকবে। জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি। এ ইচ্ছা সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গোপন ব্যালট অথবা অনুরূপ অবাধ ভোটদান পদ্ধতিতে হবে। গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল হবে বাকস্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা এবং সরাসরি অথবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনস্বার্থবিষয়ক কার্যাবলিতে জনগণের অংশগ্রহণের অধিকার ও সুযোগ থাকা। গণতন্ত্রের এমনি পুঁথিগত সংজ্ঞা আমরা সবাই জানি। কিন্তু বাস্তবতার সাথে পুঁথিগত সংজ্ঞার যোজন-যোজন ফারাক। তাই গণতন্ত্রের সংজ্ঞাও আজ অদল-বদল। রাজনীতিতে চালাকি বা কৌশল অবলম্বনের সুযোগ থাকলেও যেখানে দেশ ও জাতির কল্যাণ ও অকল্যাণের প্রশ্ন জড়িত সেখানে কৌশল অবলম্বনের কোনো সুযোগ আছে কী? যে কোনোভাবে ক্ষমতাই যেখানে মোদ্দা কথা, সেখানে গণতন্ত্র বড়ই অসহায়!
গণতন্ত্রের চলমান বাস্তব সংজ্ঞা বর্ণনায় বিভিন্ন রসিকজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেন, অন্ত্র, যন্ত্র, মন্ত্রকে গণতন্ত্র বলে! ‘অন্ত্র’ হলো জনগণ, ‘যন্ত্র’ হলো বিভিন্ন বাহিনী, আর ‘মন্ত্র’ হলো সত্য-মিথ্যার অপকৌশল। অর্থাৎ জনগণকে বিভিন্ন বাহিনী দিয়ে, অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে, অপকৌশলে ক্ষমতায় থাকার নাম হল গণতন্ত্র! আমাদের দেশে যারা নিজেদের গণতন্ত্রের চর্চাকারী বলে দাবী করেন, তাদের কাছে প্রশ্ন? কোন ধরণের গণতন্ত্রের চর্চা করেন?
বিশ্ববিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের শিক্ষাগুরু, আধুনিক জীববিজ্ঞানের জনক, বহু দার্শনিক তত্ত্বের প্রবক্তা, যার চিন্তা, জ্ঞান ও মনীষা প্রায় ২ হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতাকে বিকশিত করেছিল সেই মহাপ-িত এরিস্টটল গণতন্ত্রকে বিকৃত রাজতন্ত্র বলে অভিহিত করেছিলেন। প্রখ্যাত গ্রিক দার্শনিক আরেক আদি চিন্তক সক্রেটিসেরও পছন্দের তালিকায় স্থান পায়নি গণতন্ত্র। তার সাক্ষাৎ শিষ্য প্লেটো গুরুর দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ‘দ্য রিপাবলিক’ বইয়ে গণতন্ত্রকে সংখ্যাগরিষ্টের নামে মূর্খের শাসন বলে গালমন্দ করাসহ গণতন্ত্রকে ‘নাক গোনার গতিক’ বলে নিন্দা করেছেন। যে মত ও আদর্শের লক্ষ্যে যত ‘বেশী নাক’ পাওয়া যায় তা সত্য, অন্যদিকে গুনতিতে প্রতিপক্ষের চেয়ে ‘কম নাক’ মানেই তা অসত্য ও অনাদর্শ। তিনি গণতান্ত্রিক সরকারকে নিকৃষ্টতম সরকার বলেছেন। তিনি বলেন, এতে উচ্ছৃংখলতা এত বৃদ্ধি পায় যে, অবশেষে স্বেচ্ছাচারী নেতা সকল ক্ষমতা এক হাতে কুক্ষিগত করে নেয়। এছাড়াও হেনরি মেইন, লেকি প্রমুখ চিন্তাবিদ গণতন্ত্রের সমালোচনায় বলেন, গণতন্ত্র হল দারিদ্র্যপীড়িত, অজ্ঞ ও অক্ষমদের শাসন। কারণ তারাই সর্বদা সংখ্যাগুরু। টেলির্যান্ড বলেন, এটি শয়তানের শাসন। এমিল ফাগুয়ে বলেন, এটি হল অনভিজ্ঞদের শাসন। কেননা বিজ্ঞ ও জ্ঞানী লোকেরা কখনো দুয়ারে-দুয়ারে ধর্ণা দিয়ে ভোট চায় না। ফলে শুধু লোভী ও অপদার্থরাই ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসে। তারা অগ্নিঝরা ভাষণে মানুষকে ভুলিয়ে ভোট নেয়। অথচ শাসনকার্য এত সহজ নয় যে, কয়েকদিনের মধ্যেই সে সবকিছু রপ্ত করে নিবে। এজন্য দক্ষ ও নিপুণ হাতের প্রয়োজন।
এ কথা সত্যি যে, স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরও এদেশের জনগণ আজও জানে না গণতন্ত্র মানে কি, গণতন্ত্র আসলে কি? গণতন্ত্র কি শুধু কাগজে-কলমের সংজ্ঞা, নাকি একটি অর্থবহ চর্চা? আমাদের বিবেক আজ পদদলিত। পিষ্ট আজকে আমাদের গণতন্ত্র। কেউ আমরা ভাগ্য গড়ি আবার কেউবা ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলি। কষ্টার্জিত অর্জন আজ স্বার্থের কারণে হাত ছাড়া। বুঝতে অক্ষম এই গণতন্ত্র দিয়ে কী হয়? শুধু দেখা যায় গণতন্ত্রের নামে কেউ আগুন জ্বালায়, গাছ উপড়ে ফেলে, ভাঙচুর করে, একে অপরের মাথা ফাটায়, রাস্তা বন্ধ করে দেয়। আবার গণতন্ত্রের নামে কেউ মানুষ পেটায়, ঘর থেকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে, বিনা অপরাধে মানুষকে বন্দি করে। প্রকৃত জবাবদিহিতামূলক গণতন্ত্র আমাদের দেশে নেই। বড় দলগুলো আদর্শের বাইরে সুবিধাকেন্দ্রিক রাজনীতি নিয়েই অস্থির। আইন প্রয়োগকারীরা প্রকাশ্যভাবেই দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে ব্যস্ত।
গণতন্ত্র হল গণমানুষের মতামতের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করা। অবশ্য কারো মতে, জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস মেনে নিয়ে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনাকে গণতন্ত্র বলে। এগুলো হল সাধারণ মতামত। অবশ্য এর উল্টো ভিন্ন চিত্রই আমরা দেখতে পাই, তা হল- গণ মানুষের সম্পদ দখল করার আধুনিক পদ্ধতির নাম হল গণতন্ত্র। আবার কোন কোন প্রেক্ষাপটে অর্থ দাঁড়ায় এরকম- এক বা একাধিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠিবিশেষ কর্তৃক গণমানুষকে শাসন ও শোষণ করার বৈজ্ঞানিক ফর্মুলার নাম হচ্ছে গণতন্ত্র। কারো মতে, গণতন্ত্র হচ্ছে একটা ফাঁদ বিশেষ, যেখানে চতুর লোকগুলোর নিকট গণমানুষ স্রোতের ন্যায় এসে ধরা দেয় আর নিজেদের অজান্তেই তাদের খাঁচায় বন্দি হয়ে যায়।
১৯৯০ থেকে বর্তমানঅবদি সময়কালে দেশের বড় দু’দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পালাক্রমিক শাসণামলে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় গণপ্রত্যাশার কেন্দ্রস্থল জাতীয় সংসদ বহুলাংশে অকার্যকর থেকে যায়। জাতীয় সংসদের অকার্যকারিতা এবং সহিংস রাজনীতি গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র পুনর্বহাল এবং গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ব্যাপারে ’৯০ পরবর্তী সময়ে জনগণ আশান্বিত হয়েছিল। কিন্তু গণমানুষের সে আশা পূরণ হয়নি বড় দু’দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সংঘাতমূলক রাজনীতির কারণে।
নাগরিক সমাজের সরকারের প্রতি দায়িত্ব ও যথার্থ গণতন্ত্রায়নে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যার স্বীকৃতিও দিয়েছে জাতিসংঘ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, জাতিসংঘের ঘোষিত এই দায়বদ্ধতার স্বীকৃতি প্রথিবীর নানান স্থানে পড়ে পড়ে মার যাচ্ছে।
জাতিসংঘের ছাত্রছায়ায় বিশ্বমুরুব্বীরা স্বদেশে গণতন্ত্রের চর্চা করলেও, উত্তর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলির ক্ষেত্রে বিশ্বমুরুব্বীর অবস্থান সম্পূর্ণ উল্টো। নানা কারণে মূলধন, প্রযুক্তি ও বাজারের জন্য ধনী দেশগুলোর মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য হয়ে থাকা অনুন্যত রাষ্ট্রগুলো কোনক্রমেই এ দুষ্ট ফাঁদের বাইরে আসতে পারে না অথবা বলা চলে ইচ্ছে থাকলেও বের হবার সামর্থ অর্জন করতে পারে না। কয়েকটি ব্যতিক্রমের কথা বাদ দিলে বরং তারা বিশ্বের দিকে-দিকে প্রথমত ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক এলিটদের অগণতান্ত্রিক সরকারকে যুগের পর যুগ (যেমন- লিবিয়া, ইরাক, মিসর) সমর্থন দিয়েছিলো। শেষে সহিংস উপায়ে পিয়র গণতন্ত্র গলধঃকরণ করনোর উপায়ে জান-মালের হানিসহ ব্যাপক গণবিধ্বংসী উপায় অবলম্বনে সহায়তা করে। বহু বিশ্লেষক অবশ্য এই খাঁটি গণতন্ত্র উদ্ধারের মাঝে জঙ্গিপনা আবিস্কার ও বিশ্বজুড়ে সামরিক-রাজনৈতিক আধিপত্য অক্ষুণœ রাখা এবং দুর্বল রাষ্ট্রগুলির প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখবার দূরভিসন্ধি বলে থাকেন।
গণতন্ত্রের উন্নয়ন ও শক্তিশালীকরণে জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে জাতিসংঘের আহ্বান এবং আন্তর্জাতিক আইনের নির্দেশনা সত্ত্বেও এখনও পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রে উদ্বাস্তু হয়ে বসবাস করছে। আর যারা মাটি কামড়ে পড়ে আছে, তারা ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বর্বরতার শিকার হয়ে সর্বদা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বসবাস করছে। মিয়ানমারে বছরের পর বছর রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চলছে। মানবাধিকার সনদসহ আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশটির সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেশ থেকে বিতারিত করেছে।
সম্প্রতি ভারতের আসামে চূড়ান্ত নাগরিক পঞ্জির (এনআরসি) খেলায়, বিজেপি সরকারের মানবাধীকার পরিপন্থি সিদ্ধান্তের বলি হয়ে লাখো মানুষ, যুগের পর যুগ বসবাস করেও এখন জানতে পারছে তাদের কোন রাষ্ট্র নেই। নিজের জন্মভূমি, জায়গা-জমিন ও ঘর-বাড়ি রেখে যেতে হবে বন্দিশিবিরে! অর্ধশতাব্দী বা তারও বেশী সময় ধরে যারা বসবাস করছে, তাদের বিদেশী আখ্যা দিচ্ছে ক্ষমতাসীন ভারতীয় সরকার। উত্তর কোরিয়ার মতো একনায়কতান্ত্রিক দেশে মানুষ সব গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এরকম আরও উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উদযাপন উপলক্ষে প্রত্যাশা, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিতিসহ আমাদের দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির লক্ষণীয় উন্নতি ঘটু এই কামনা।