মানবশিশু জন্মলগ্ন থেকেই সৌন্দর্যপিপাসু। অজ¯্র মৌলিক জ্ঞান গুণের এক বিশাল সুবিন্যাস মানবশিশুর মাঝে। আর এ সুবিন্যাসের মাঝেই গোছানো আছে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য, সব ভবিষ্যৎ। তবে বহুকাল থেকে তারা তৃণমূল যেন এখনো পরাধীন, এখনো কাঁদছে ক্ষুধার্ত, বস্ত্রহীন, বসতহীন, শিক্ষাহীন, চিকিৎসাহীন, মাতা-পিতাহীন, পৃথিবীর সৌন্দর্য মানব পথশিশুরা। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই তারা অবহেলা, অনাদর, বঞ্চনা, লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে ধাপে ধাপে। বাবার কোলের অপার স্নেহ, মায়ের শাড়ির আঁচলে মুখ লুকানোর স্বর্গীয় সুখ তাদের কপালে জোটেনি। দারিদ্র্যের সর্বনিম্নে এদের বসবাস। প্রকৃতি এক নির্দয় খেলা খেলছে এদের সঙ্গে। অথচ আমরাই বলি আজকের শিশুরা আগামি দিনের কর্ণধার, দেশ ও জাতির সোনালি ভবিষ্যৎ। একদিন এরাই এ দেশটাকে পরিচালনা করবে। তাই তাদের বেড়ে ওঠার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল রাষ্ট্রের উন্নয়ন, সমাজ ও পরিবারের সুখ-শান্তি, রাজনৈতিক পরির্বতনের ধারা। তাহলে কেন বই-খাতার পাতা গুটিয়ে শৈশবেই এ অধিকারবঞ্চিত শিশুগুলো করে চলছে জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ? বিশেষ করে ব্যস্ত শহরে প্রভাত হলেই ময়লাযুক্ত ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটছে বাস টার্মিনাল থেকে রেলস্টেশন, শহরের অলিগলি সব জায়গায়। কাগজ কুড়ানো কিংবা ভিক্ষা করে চলে তাদের জীবন। রাষ্ট্র ও সমাজের অবহেলা, মানুষের ধিক্কার, গালিগালাজ, এমনকি শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় তাদের। ২০০৫ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ৫১ শতাংশ শিশু অন্যের গালিগালাজ শুনে ও ২০ শতাংশ শিশু শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে বড় হয়। যৌন নির্যাতনের শিকার ৪৬ শতাংশ মেয়েশিশু, সার্বিকভাবে ১৪৫ শতাংশ শিশু নানাভাবে নির্যাতনের শিকার। এসব শিশু অনেক সময় ক্ষুধার জ¦ালায় বিভিন্ন হোটেলের বাসি-পচা খাবার, এমনকি ডাস্টবিনে ফেলা ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত খাবারও খেয়ে থাকে। নোংরা স্থানে চলাফেরা ও ঘুমানোর কারণে অধিকারবঞ্চিত প্রায় দেশের ১০ লাখ পথশিশু মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। প্রায় ৪০ শতাংশ পথশিশু প্রতিদিন গোসল করতে পারে না, আর ৩৫ শতাংশ শিশু খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে। রাতে ঘুমানোর জন্য ৪১ শতাংশ শিশুর কোনো বিছানা নেই। আমাদের সমাজে ওদের মূল্যায়ন করা হয় না। তবে এসব পথশিশুর ক্ষুধার্তের সুযোগ নিয়ে কিছু অপরাধী চক্র প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে এদের দ্বারা মাদক বহনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। একসময় এরা মাদক বহন বা একাধিক কারণে নিজেরাই মাদকাসক্ত হয়। একটি জরিপের তথ্যমতে, প্রায় ৮৫ শতাংশ পথশিশু কোনো না কোনো মাদকে আসক্ত। ঢাকা বিভাগের মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে আর ১৭ শতাংশ মেয়েশিশু। তাদের বয়স ১০ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এ দেশের শিক্ষা, কৃষি তৈরি পোশাক শিল্প, বাণিজ্য, মাথাপিছু আয় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নাগরিক সুবিধা অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও আমরা পথশিশুদের বেলায় তেমন এগোতে পারিনি। এটা সত্য যে, দেশের সরকার পথশিশু-শিশুশ্রম রোধে কাজ করে যাচ্ছে বা শিশুদের রক্ষায় অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। দুঃখের বিষয় ও কষ্টদায়ক যে, তা পথশিশুদের হাত পর্যন্ত পৌঁছে না।
একটি জরিপে দেখা যায়, ৮৫ শতাংশ শিশু সরকারি বা বেসরকারি পর্যায় থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পায় না। এ জরিপের সঙ্গে আমি একমত পোষণ করি। কেননা আমিও যে শিশুশ্রমের শিকার। আমি মনে করি, শিশুদের জন্য সরকার যে অর্থ প্রতি বছর বরাদ্দ করে, তা যদি আমরা শিশু শ্রমিক বা পথশিশুরা পেতাম, তাহলে এ দেশে একটিও পথশিশু থাকত না।
পথশিশুদের যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনায় শিকার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। সম্প্রতি যৌন নির্যাতনবিরোধী নীতিমালা নিয়ে বেশ আলোচনা হলেও পথশিশু কিশোরীদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছে না কেউ। পথে-ঘাটে রাতযাপনের ফলে তারা নানাভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। অথচ সংশ্লিষ্টদের সেদিকে কোনো ভাবনা নেই। পথশিশু বলে আমাদের সমাজ তাদের মূল্যায়নও করে না। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা চাই নাগরিকত্ব। চাই মৌলিক অধিকার। শিক্ষা চাই, ভিক্ষা নয়। আমি আজ কয়েক লাখ পথশিশু শিশু শ্রমিকের পক্ষ হয়ে এ পত্রিকার মাধ্যমে আমাদের দুঃখ-কষ্ট জানাতে চাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কেন না আপনি আমাদের মাতা-পিতা। আপনি ছাড়া আমাদের পাশে কেউ দাঁড়াবে না জানি। আপনার জীবন যে জাতির জনকের আদর্শে গড়া। আপনি আমাদের আশা-ভরসা। মাতা, আপনি জানেন, এরইমধ্যে রাজন-রাকিবসহ অনেকে তাদের মূল্যবান জীবন দিয়ে বুঝিয়েছে আমরা শিশু শ্রমিক বা পথশিশুরা কতটা কষ্টে বা নিষ্ঠুরতার মধ্যে আছি। মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত আমরা সব শিশু আপনার মমতামাখা আঁচলের ছায়ায় আশ্রয় চাই। আমরা আর এ সমাজে পথশিশু হয়ে থাকতে চাই না। কুকুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে ডাস্টবিনে খাবার খেতে চাই না। পথে-ঘাটে ঘুমাতে চাই না। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে বাঁচতে চাই। গড়তে চাই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ। চাই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে। তাই অধিকারবঞ্চিত পথশিশু বা শিশু শ্রমিকদের আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তুলতে চাই উপযুক্ত শিক্ষা ও অনুকূল পরিবেশ। আমরা কয়েক লাখ অধিকারবঞ্চিত শিশু বিশ্বাস করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আপনি পথশিশুদের সুরক্ষায় ও শিশুশ্রম রোধে একটি ইতিহাস সৃষ্টি করবেন সুদৃষ্টি দিয়ে।